ads

জীবনের স্পর্শ



হলিউডের বিখ্যাত অ্যাকশান সুপার স্টার জেট লি কেন হঠাৎ রুপালি পর্দা থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন? এটা কি ভেবে দেখেছেন? এটা কি শুধুই তার শারীরিক অসুস্থতা নাকি অন্য কোন ঘটনা? এটা এমন এক চমকপ্রদ কাহিনি যা তার জীবনটাকে পুরোপুরি পালটে দেয়।

২০০৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর, জেট লি ছুটি কাটাতে খুব গভীর রাতে মালদ্বীপের ফোর সিজনস হোটেলে পৌঁছান। সাথে স্ত্রী আর ছোটো দুটো কন্যা। অদ্ভুত সুন্দর, নির্জন এক শান্তিপূর্ণ দ্বীপ। অবকাশ যাপনের জন্য উৎকৃষ্ট।

পরদিন সকালে ৭:৫০ মিনিটে জেট লি অনুভব করেন হোটেলে মৃদু ভুমিকম্প। কিন্তু তেমন ভয়ের কিছু না। ছোটো মেয়েরা সৈকতে যাওয়ার জন্য বাবা মাকে খুব তাড়া দিচ্ছে। তাই দ্রুত প্রাতঃরাশ পর্ব শেষ করে প্রায় ১০:১০ মিনিটে তারা সৈকতে পৌঁছেন। সমুদ্রের তীর ধরে তারা হাঁটছেন আর ছোটো দুটি মেয়ে মনের আনন্দে দৌড়াচ্ছে। কিন্তু কয়েক পলকের মাঝে কিছু বুঝে ওঠার আগে দেখা গেলো- তীব্র গতিতে ছুটে আসছে পানির জোয়ার। সমূদ্রের গভীর তলদেশে তৈরি হয়েছে সুনামি। এটা সিনেমার কোনো সাজানো দৃশ্য না। একেবারে জীবন্ত কাহিনি। এটা ঘটছে তাদের চোখের সামনে।

একটা পর একটা বিশাল ঢেউ আচড়ে পড়ছে। পানি এতো দ্রুত গতিতে বাড়ছে বালুকাবেলা উপভোগ করা মানুষরা আতঙ্কে চিৎকার শুরু করে। কেউ কেউ প্রাণ বাঁচাতে দৌঁড়ায় হোটেলের দিকে। জেট লি তখন তার চার বছরের মেয়ে জেনেকে তুলে নেন। আর তাদের সাথে থাকা ন্যানি দু বছরের জাডাকে কোলে নিয়ে দৌঁড়াতে থাকে। পানি তখন তাদের হাঁটু থেকে কোমর স্পর্শ করে ফেলেছে। হোটেলের দিকে আরেক পা ফেলতে না ফেলতেই পানি তাদের বুক পর্যন্ত ওঠে। কয়েক সেকেন্ড দেরি হলে পানির প্রবল স্রোতে ভেসে যাবে জেট লি'র পুরো পরিবার।

জেট লি এবার তার মেয়ে জেনেকে কাঁধে তুলে নেন এবং অন্য হাতে স্ত্রীকে ধরে সর্বোচ্চ সংগ্রাম করছেন- হোটেলে পৌঁছাতে। তিনি এবার পেছন ফিরে দেখেন অনেক মানুষ পানির তোড়ে ভেসে গেছে। সমূদ্রের পানিতে সব কিছু একাকার হয়ে গেছে। তিনি আরো অবাক হয়ে দেখেন- তাদের ন্যানি আর দু বছরের মেয়ে জাডা আর তাদের সাথে নেই। তার স্ত্রী উন্মাদের মতো কাঁদতে শুরু করেছে।

জেট লি দেখেন কিছুদূরে পানির স্রোতের মাঝে পড়ে জীবন বিপন্ন ন্যানি আর দুবছরের কন্যা জাডা। জেট লি ভাবছেন- তিনি এখন কাকে উদ্ধার করবেন। স্ত্রীর হাত ছেড়ে দিবেন, কাঁধে রাখা মেয়েকে স্ত্রীর হাতে সঁপে দিবেন। নাকি ন্যানি আর কন্যাকে উদ্ধার করতে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়বেন।

জীবনে অর্জিত এতো ধন সম্পদ যা কিনা মূহুর্তের ইচ্ছায় তাকে মালদ্বীপে অবকাশ যাপনে পৌঁছে দিয়েছে। সেই ধন সম্পদ এখন তার কোনো কাজে আসছে না তার অসহায় ছোটো মেয়ের জীবন বাঁচাতে। জেট লি উন্মাদের মতো সাহায্যের আশায় চিৎকার করা শুরু করেন এবং দেখেন এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। দুজন জেলে ন্যানি আর তার শিশু কন্যাকে উদ্ধার করে তাদের দিকে ছুটে আসছে।

তিনি বুঝতে পারলেন- জীবন আর মৃত্যুর ফারাক ন্যানো সেকেন্ডেরও কম। এক মূহুর্ত আগে তার মনে হচ্ছিলো - এই পৃথিবীর সবকিছু ভীষণ অন্ধকার। পরক্ষণেই মনে হলো- কোনো এক অলৌকিক শক্তি যেন খুলে দিয়েছেন তার বেঁচে থাকার আরেকটি দুয়ার। তারা হোটেলে ফিরেন। ঘণ্টা খানেক আগে যে শহর ছিলো পূর্ণ বিভায় আলোকিত শহর। তা হয়ে গেছে এক ভুতুড়ে নগর। বিদ্যুৎ নেই, যোগাযোগ নেই, স্যাটেলাইট ফোন নেই। এমনকি দুদিনের জন্য হোটেলে সঞ্চিত খাবার ছাড়া আর কোনো খাবারও নেই।

নিষ্প্রাণ হোটেলের বিছানায় দু মেয়েকে বুকের সাথ জড়িয়ে জেট লি ভাবছেন- ঈশ্বর তাকে নতুনভাবে যে জীবন দিয়েছেন। নিশ্চয়ই এর পেছনে কোনো এক অর্থ আছে। তিনি ভাবছেন- সমূদ্র থেকে তো বাঁচলাম। কিন্তু মাটির গর্তে চলে যাওয়ার আগে এই জীবনটাকে অর্থবহ করে তোলার জন্য কি কিছু করে যেতে পারলাম। জেটলি বলেন- জীবনের ৪১টি বছর শুধু নিজেকে জেট লি বানাতেই কাটিয়েছি। প্রমাণ করতে চেয়েছি- আমি কত বড়ো তারকা। আমি বিশেষ কিছু। কিন্তুু আজ বুঝতে পারছি- যে জেলে আমার কন্যার জীবন বাঁচিয়ে দিলো- তারাই মানবতার সবচেয়ে বড়ো হিরো। তারাই সত্যিকারের তারকা। এই ভাবনাই পাল্টে যায় তার জীবন।

সিদ্ধান্ত নিলেন- অবসর নেওয়ার জন্য আর অপেক্ষা করা যাবে না। শুরু করে দিতে হবে মানুষের জীবন বদলের কাজ। ছবির জগৎ থেকে বিদায় নিয়ে ২০০৭ সালে শুরু করলাম "ওয়ান ফাউন্ডেশন" নামক চ্যারিটি সংগঠন। ছবির জন্য খুব সামান্য কাজ করবো। কিন্তু মূল প্রায়োরিটি হবে আমার চ্যারিটি। আমি এই বিশ্বাস ছড়িয়ে দিতে চাই - প্রতিটি মানব প্রজাতিরও একটি দায়িত্ব রয়েছে। এটা শুধুমাত্র তখন নয়, যখন আপনি শুধুমাত্র মিলিয়ন ডলার উপার্জন করবেন। এটি শুরু করা যায় যেকোনো মূহুর্ত থেকে। এটা শুরু করা যায়- যেকোনো জায়গা থেকে। এটা শুরু করা যায় শুধু মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসার অনুভব থেকে।

এটি শুধুমাত্র টাকা সংগ্রহের ব্যাপার নয়, বরং মানুষের বিশ্বাস পরিবর্তন করার ব্যাপার। এটা ভালোবাসার ভাইরাস ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপার। আমি জীবনের অগ্রাধিকারগুলো পুনর্বিবেচনা করতে শুরু করলাম। আমি কি শুধুমাত্র ছবির অ্যাকশান হিরো হয়েই জীবন শেষ করে বিলাসের জীবন কাটিয়ে দিবো। নাকি মানুষের জীবন বদলের জন্য মানুষের পাশে দাঁড়াবো। আমি দ্বিতীয় অপশনটাই বেছে নিলাম।

সেদিন থেকেই সংকল্প করেছেন তিনি, তার বাকি জীবনটা মানুষের কল্যাণে ব্যয় হবে। আমার এই মানব জীবন তখনই তাৎপর্যময় হবে, যখন আমার কারণে পৃথিবীর কোনো না কোনো বিপন্ন গৃহে অন্তত একটু হাসি ফুটে উঠবে।


No comments

Thank you, best of luck

Theme images by sbayram. Powered by Blogger.