"রূপালির আলো" - পতিতপাবন মণ্ডল
রূপালির বয়স কত আর হবে ? বছর ৩৫ হয় তো, দেখে মনে হয় আরো বেশি। বেসরকারি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকা রূপালি গ্রামের মেঠোপথ ধরে হেঁটে যাওয়ার সময় আজও তার চোখে ভাসে কামালের সেই কথা— "তুমি নারী, শুধু রান্নাঘরই তোমার জগৎ!" রূপালি জানতেন, কামালের রাগ আসলে বেকারত্বকে বয়ে বেড়ানোর ক্ষত। তিনি ঠিক করলেন, কামালের মানসিক যুদ্ধে তারই হতে হবে ঢাল। রাতে ৫ বছরের মেয়ে টুনিকে ঘুম পাড়িয়ে সে কামালের পাশে বসল। কোনো অভিযোগ নয়, শুধু বলল, "তোমার হাতটা দেখি? তোমার এ সুন্দর হাত দিয়ে ফুল দিয়ে আমাকে বরণ করেছ, আমাদের মেয়েকে আদর কর। এই হাত দিয়েই তো তুমি আমাদের খেতগুলো ফসলে ভরে তুলতে পার। ..." তুমি পারবে। আমি জানি, তুমি পারবে!
৪০ বছর বয়সী দিকভ্রান্ত, সদ্য মাদকাসক্ত কামাল প্রথমে উপেক্ষা করলেও রূপালির ধৈর্য আর মমতা তাঁকে টেনে আনলো জীবনে। তিনি কামালকে গ্রামের অব্যবহৃত জমিতে সবজি চাষের প্রস্তাব দিলেন ও তা চাষ করতে জোর করল। যুব উন্নয়ন কেন্দ্রের সাহায্যে বীজ আর ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থাও করল । কামালের হাত কাঁপছিল মদের নেশায়, কিন্তু রূপালির চোখে আস্থা-ভালোবাসা-স্বপ্ন দেখে কামাল বিশ্বাস নিয়ে পুরোদমে কাজ শুরু করল।
এদিকে রূপালি মেয়েদের জন্য তৈরি করা তার "আলোর পাঠশালা" উন্নত করার জন্য অধিক পড়ালেখা শুরু করল। বাড়াল অভিভাবকদের সাথে মতবিনিয়। মায়েদের বোঝালেন, "মেয়েরা শিক্ষিত হলে গোটা পরিবার বদলে যায়!" ধীরে ধীরে তার স্কুলে ছাত্রী সংখ্যা বাড়ত শুরু করল। অতিযত্নে সে মেয়েদের পড়ায়। এতে দ্রুত ফলও পেল সে।
আব্দুল, যে কামালকে মদের সঙ্গ দিত, সে দেখল কামালের চাষাবাদে সাফল্য। রূপালির উৎসাহে আব্দুলও যোগ দিল সবজি চাষে ও পাশিপাশি সবজির ব্যবসায়।
মৌসুমি বৃষ্টিতে কামালের ফসল নষ্ট হওয়ার উপক্রম হলো। হতাশায় সে আবারও মদের দিকে হাত বাড়াল। রূপালি ঠান্ডা মাথায় মেয়ে টুনিকে কামালের কোলে দিয়ে বলল, "তুমি হেরে গেলে তোমার মেয়ের বিশ্বাসও ভেঙে যাবে। আর তার আত্মবিশ্বাাস হারিয়ে গেলে আমরা তাকে বড়ো মানুষ বা তোমার স্বপ্নের ডাক্তার বানাতে পারব না। রূপালির চোখের জলে কামালের হৃদয় গলল। যে যাত্রায় গ্রামের লোকজনের সহযোগিতা ও নিজেদের অপ্রাণ চেষ্টায় অধিকাংশ ফসল বাঁচানো গেল।
এর পর আর তাদের পিছে তাকাতে হয়নি। কামালের সবজি চাষ আজ সমগ্র উপজেলায় বিখ্যাত। রূপালির স্কুল থেকে পাশ করা মেয়েরা মাধ্যমিকেও বৃত্তি পেয়েছে। আব্দুল এখন কামালের পার্টনার, মদ্যপান ছেড়ে সে বিয়ে করেছে। এক সন্ধ্যায় কামাল, রূপালির হাত ধরে বলল, "তুমিই আমার জীবন বদলে দিয়েছ... তুমিই আমার দেবী ...।
গ্রামের বৈশাখী উৎসবে রূপালিকে সম্মাননা দেওয়া হয়। মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, "নারীর শক্তি মানে অস্ত্র নয়, সে শক্তি মানে অন্ধকারে আলো জ্বালানো।" টুনি মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে স্বপ্ন দেখে, সে বড়ো হয়ে ডাক্তার হয়ে গ্রামের সেবা করবে। — যেন আরও অনেক জীবন বদলে দিতে পারে…
No comments
Thank you, best of luck