শিক্ষকের পেশাগত দক্ষতা উন্নয়ন জরুরি
- শিক্ষার্থী,
- যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম,
- মানসম্মত শিক্ষক এবং
- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
এ ছাড়া আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে, যেগুলো মানসম্মত শিক্ষার জন্য বিবেচনায় রাখতে হয়। এসবের মধ্যে রয়েছে,
- শিখন-শেখানোর অনুকূল পরিবেশ,
- শিক্ষার্থী মূল্যায়ন প্রক্রিয়া,
- সহপাঠক্রমিক কার্যাবলি ইত্যাদি।
- শিক্ষার্থীদের একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার উপযোগী করে গড়ে তোলা,
- পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর দক্ষতা অর্জন,
- সর্বোপরি উন্নত নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন একজন ভালো মানুষ হিসাবে শিক্ষার্থীদের তৈরি করা।
এসব উদ্দেশ্যে শিক্ষকরা কাজ করে থাকেন। কাজেই দেখা যায়, এসব দিকও মানসম্মত শিক্ষার সঙ্গে অনেক গুরুত্বপূর্ণভাবে জড়িয়ে রয়েছে। এসবের কোনো একটি দিককে অবহেলা করে মানসম্মত শিক্ষা প্রত্যাশিতভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
মানসম্মত শিক্ষার সঙ্গে শিক্ষক প্রশিক্ষণের বিষয়টি আরও অধিক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, যে কোনো শিক্ষাস্তরে নির্ধারিত শিক্ষাক্রম নির্দিষ্ট পদ্ধতি ও কলা-কৌশল অনুসরণ করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শিক্ষার্থীদের কাছে তুলে ধরাই একজন আদর্শ শিক্ষকের প্রধান দায়িত্ব। একইসঙ্গে শিক্ষার্থীরা ওই শিক্ষাক্রমে বর্ণিত বিষয়বস্তু কতটুকু অর্জন করতে পারল, তা মূল্যায়নের নির্ধারিত মানদণ্ড অনুযায়ী যাচাই করা শিক্ষকের দায়িত্বের অংশ। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে ধরে রাখার জন্য শিক্ষককে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন উদ্যোগ উদ্ভাবন ও সেগুলো কার্যকরভাবে প্রয়োগ করতে হয়। শ্রেণিকক্ষের একঘেয়েমিমূলক পরিবেশ দূর করে শিখন-শেখানো কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণে আধুনিক শিক্ষা উপকরণ এবং তথ্যপ্রযুক্তিগত সামগ্রী ব্যবহারের মাধ্যমে পাঠদানে আনতে হয় বৈচিত্র্য। এসব দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হলে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হতে হবে। প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষক দিয়ে হয়তো সাময়িকভাবে পাঠদানের কাজটি চালিয়ে নেওয়া যেতে পারে; কিন্তু তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আকর্ষণীয় ও পদ্ধতিসম্মত হয় না বলেই মানসম্মত শিক্ষা হয়ে যায় সুদূরপরাহত। তবে মানসম্মত শিক্ষা শুধু এককভাবে শিক্ষক প্রশিক্ষণের ওপরই নির্ভর করে না। এর সঙ্গে আরও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদানও জড়িত রয়েছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, শিক্ষার উপাদানের কোনো একটি উপাদান যদি অপর্যাপ্ত কিংবা দুর্বল হয়ে থাকে, তাহলে তা পুরো শিক্ষাস্তরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সংক্ষিপ্তভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দেশে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষার প্রধান তিনটি স্তর রয়েছে। স্তরগুলো হলো-১. প্রাথমিক শিক্ষা, ২. মাধ্যমিক শিক্ষা ও ৩. উচ্চশিক্ষা। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা স্তরের মধ্যে উচ্চমাধ্যমিক নামে আরেকটি শিক্ষাস্তর আছে। যেটিকে আমরা একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি হিসাবে অভিহিত করে থাকি। মূলত উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা প্রায় একই ধরনের পড়ালেখা করলেও উচ্চ শিক্ষাস্তরে গিয়ে সেটি বহু ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। কোনো শিক্ষার্থী উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা উত্তীর্ণ হওয়ার পর উচ্চ শিক্ষাস্তরে কী পড়ালেখা করবে, তা নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। যেমন-উচ্চমাধ্যমিক বা এইচএসসি পরীক্ষা পাশের পর কেউ সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে বা সাধারণ কলেজে সাধারণ বিষয় নিয়ে অনার্স কোর্সে পড়ালেখা করতে পারেন, কেউ চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে মেডিকেল কলেজে পড়ালেখা করতে পারেন, আবার কেউ কেউ প্রকৌশল বিষয় নিয়ে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে বা প্রকৌশল কলেজে পড়ালেখা করতে পারেন। এসবের বাইরে কৃষি বিষয় নিয়ে পড়ালেখা করার জন্য রয়েছে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ও আছে। আছে অ্যারোনটিক্যাল, এভিয়েশন, ম্যারিটাইম ইত্যাদি বিষয় নিয়ে পড়ালেখার সুযোগ। এগুলোর সবই উচ্চশিক্ষার আওতাভুক্ত। এসবের বাইরে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা পাশের পর অনেকেই দেশপ্রেমের টানে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীতে অর্থাৎ সেনা, নৌ কিংবা বিমানবাহিনীর কোনো একটিতে যোগদান করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে থাকেন। বিভিন্ন পর্যায়ের পরীক্ষার মাধ্যমে যারা চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হন, কেবল তারাই সংশ্লিষ্ট বাহিনীর নিজস্ব প্রশিক্ষণ একাডেমিতে সাফল্যের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করার পর বাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। তাদের এ কমিশনপ্রাপ্তির মাধ্যমে তারা দেশ সেবার দুর্লভ ও গৌরবোজ্জ্বল সুযোগ নিয়ে চাকরিতে যোগদান করে থাকেন।
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা পাশের পর যারা বিভিন্ন বাহিনীতে কমিশন লাভের উদ্দেশ্যে প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচিত হয়ে থাকেন, তাদের প্রশিক্ষণ গ্রহণকালীন নির্ধারিত উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যে কোনো একটিতে অনার্স কোর্সে যুগপৎ পড়ালেখাও করতে হয়। এখানে উচ্চ শিক্ষাস্তরে পড়ালেখার যেসব সুযোগ ও প্রতিষ্ঠানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তার সবই ভর্তির পূর্বযোগ্যতা হিসাবে শিক্ষার্থীদের নির্ধারিত জিপিএসহ উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। কাজেই যেসব শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষাস্তরে প্রবেশ করবে, তাদের পূর্ববর্তী স্তরের শিক্ষা স্বাভাবিকভাবেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাস্তরের শিক্ষকদের উন্নত মানের অধিকারী হতে হবে। দেখা যায়, সামরিক বা বেসামরিক যে পর্যায়েই শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করুক না কেন, শিক্ষাশেষে তাদের দেশের সেবায় মনোযোগ দিতে হয়। কাজেই উচ্চশিক্ষার গুণগত মানের ওপর নির্ভর করে দেশে কী ধরনের মানসম্মত শিক্ষিত ও দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরি হবে, যাদের ওপর দেশের সামগ্রিক পরিচালনার দায়িত্বভার অর্পিত হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নের জন্য দেশে-বিদেশে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের সুযোগ থাকতে হবে। আর প্রশিক্ষণও হতে হবে মানসম্মত। বর্তমানে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য দেশে ১৪টি সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল। কিন্তু উচ্চমাধ্যমিক স্তরের প্রায় ৫০ হাজার শিক্ষকের জন্য তেমন কোনো বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান নেই বললেই চলে। শুধু সারা দেশে পাঁচটি উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট রয়েছে কলেজ পর্যায়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য। একদিকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য এসব প্রতিষ্ঠান যেমন অপর্যাপ্ত, অন্যদিকে এ পাঁচটি প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানপ্রধান হিসাবে অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষদেরও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ কারণে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের প্রকৃত শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের সুযোগ আরও কমে যায়।
এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে, দেশে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের প্রায় ১০ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের অভাব রয়েছে। অপরদিকে, এ বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীকে যারা পড়াবেন, তাদের পাঠদানের মান, পাঠদানে আধুনিক পদ্ধতি ও কলা-কৌশল প্রয়োগ, শ্রেণিকক্ষে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়ে কতটুকু দক্ষতা রয়েছে, সেটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। শিক্ষকদের আধুনিক ও উপযুক্ত প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমেই তাদের পেশাগত দক্ষতা অর্জন সম্ভব হবে। কারণ, উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের পরবর্তী উচ্চশিক্ষা গ্রহণের লক্ষ্যে উপযুক্ত যোগ্যতা অর্জন এবং তাদের একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার উপযোগী দক্ষতাসম্পন্ন করে গড়ে তুলতে হলে ওই স্তরের শিক্ষকদের মানসম্মত প্রশিক্ষণের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষক দিয়ে গুণগত মানসম্মত পাঠদান সম্ভব নয়। শিক্ষার্থীদের উন্নত চিন্তা-চেতনায়, শিক্ষা ও জ্ঞানে, মূল্যবোধ ও মনন-মানসিকতায়, নীতি-নৈতিকতায় উচ্চমাত্রার নাগরিক হিসাবে গড়ে তুলতে হলে তাদের পড়ালেখার মানও আধুনিক ও বৈশ্বিক কারিকুলামের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে।
মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান : অধ্যাপক ও সাবেক অধ্যক্ষ, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ
No comments
Thank you, best of luck