দেশোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা গড়তে হবে
সেই ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, ‘মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত’। সে অর্থে মাস্টার সাহেবের দৌড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যন্ত হওয়ার কথা। আমার মতো বেশকিছু মাস্টার ও নন-মাস্টারের দৌড় বড়জোর দৈনিক যুগান্তর পর্যন্ত। যুগান্তর ‘জাতীয় শিক্ষা-সেবা পরিষদ’ আত্মপ্রকাশের মূলনীতি দেশব্যাপী জনসমক্ষে প্রকাশ করে আসছে। এটাও পত্রিকার একটা জনসেবামূলক কার্যক্রম। তারাও চায় এদেশের মানুষ সুশিক্ষিত ও দেশপ্রেমী হোক। ‘জাতীয় শিক্ষাসেবা পরিষদ’ এদেশের মানসম্মত শিক্ষা ও সেবার উন্নয়নে নিয়োজিত একটি অরাজনৈতিক, অলাভজনক ও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও সামাজিক শিক্ষাকে একসঙ্গে নিয়ে কাজ করে। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার শত শত সুশিক্ষিত ব্যক্তি, শিক্ষা-গবেষক, অসংখ্য শিক্ষাবিদ সামাজিক এ আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত। দেশের কল্যাণে নিজেদের পকেট থেকে অর্থ খরচ করে আমরা ‘জাতীয় শিক্ষাসেবা পরিষদ’ টিকিয়ে রেখেছি ও সাধ্যমতো সেবা দিয়ে যাচ্ছি, জনসচেতনতা বাড়াচ্ছি।
এদেশে আমরা যত শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করছি, তা সময়োপযোগী ও দেশোপযোগী হচ্ছে না বলে দেখছি। এ দিয়ে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সুসংহত ও সুদৃঢ় করাও কঠিন বলে আমাদের মনে হয়। এদেশের রাজনীতিকরা রাজনীতি নিয়ে সদা ব্যস্ত। তাদের এদেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ভাবার সময় কোথায়! যারা ভাবেন, তাদেরও ক্ষীণদৃষ্টি আমাদের ভাবিয়ে তোলে। এর আগেও আমরা বিগত সরকারের বড়কর্তাদের সামনে একাধিক সেমিনার করেছি; তারা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন, শিক্ষা ও সেবার এ পদ্ধতি ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া আমাদের দেশের উপযোগী ও বাস্তবায়নযোগ্য। তারা সান্ত্বনা দিয়েছেন বটে; কিন্তু বাস্তবে তাদের বদ্ধমূল আদর্শের বাইরে কিছুই করেননি।
আমরা সেই শিক্ষাব্যবস্থাকেই আদর্শ ব্যবস্থা বলব, যেখান থেকে জনগোষ্ঠী মানসম্মত শিক্ষা পাবে। দেশে দেশপ্রেমী মানুষ তৈরি হবে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও সামাজিক শিক্ষাসেবার প্রক্রিয়া একসঙ্গেই চলতে থাকবে। দুর্ভাগ্য, রাজনৈতিক সরকার শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে অতটা সময় ব্যয় করতে চায় না। কাজ করার সময় বেছে বেছে দলীয় লোকজন ছাড়া তাদের আসরে অন্য কেউ কল্কে পায় না।
আমাদের চিন্তিত এ পদ্ধতি ও মডেলে সামাজিক শিক্ষা, সমাজ উন্নয়ন ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার উন্নয়ন একীভূত করে দেখা হয়। এছাড়া স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসা নির্বিশেষে ‘ইন্টিগ্রেটেড শিক্ষাপদ্ধতি’ প্রয়োজন। সেজন্য এ টেকনিক ও শিক্ষাব্যবস্থার রূপরেখা এদেশে নিশ্চিতভাবেই অধিকতর প্রয়োগযোগ্য। তেপ্পান্ন বছর ধরে তো দেখছি, এদেশের রাজনীতিকদের কাছে দেশের সংশ্লিষ্ট বিষয়ের গবেষক ও পেশাদারদের তুলনায় লাঠিয়াল বাহিনীর নেতা ও যারা রাজনীতি করতে গিয়ে জেলজুলুম ভোগ করেছেন, তাদের গুরুত্ব বেশি। দেশের উন্নয়নমূলক কোনো কাজের মেধা ও যোগ্যতা আছে, কী নেই-এটা কোনো বিবেচ্য বিষয় হয় না। নির্বাচনে জেতার সঙ্গে সঙ্গে পদ ভাগবাঁটোয়ারা নিয়েই যেখানে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যায়, সেখানে বিভিন্ন পেশাদার ও গবেষকদের মূল্যায়ন কতখানি? এসব বিবেচনায় নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকার একটা ভরসার জায়গা হতে পারত, অন্তত সেখানে সংস্কার আছে, রাজনীতি নেই; তবে সমঘরানার দৌরাত্ম্য ও তদবিরের মর্যাদা আছে বলে আমাদের বিশ্বাস। এ অনুমান সত্য না-ও হতে পারে। এ ক্ষেত্রে আমরা উপেক্ষিত ও অসহায়। সব শিক্ষকের টাকার নেশা না থাকলেও দেশের শিক্ষা ও সেবার বিষয়ে গলদটা কোথায় এবং কীভাবে অতি সহজে এগুলো দূর করে এ জনগোষ্ঠীকে সুশিক্ষিত ও মানবসম্পদে রূপান্তরিত করা সহজ হয়; কোন পদ্ধতি ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় একসঙ্গে সামাজিক শিক্ষা ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সার্থকভাবে বাস্তবায়ন সহজসাধ্য হয়; এগুলো গবেষণার বিষয় হলেও এ পদ্ধতি ও টেকনিকগুলো আমাদের নখদর্পণে। ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাদান আমাদের পেশা ও ব্রত। এখন প্রশ্ন, শিক্ষার উন্নয়নে কাজ করার সুযোগ দান কি হচ্ছে? নিজেদের ঢোল নিজে না পেটাতে পারলে অন্যের কর্ণকুহরে শব্দ প্রবেশ করানো এ যুগে কঠিন। আমরা সার্ভিস দিতে প্রস্তুত, লাভটা কিন্তু পুরোটাই এ জনগোষ্ঠীর।
শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে যদি বাংলাদেশি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে অন্য জাতিগোষ্ঠী থেকে আলাদা স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্যবোধ তৈরি করা না যায়, তবে বাংলাদেশিরা দেশপ্রেম, জাতীয় উন্নয়ন ও দেশাত্মবোধ সৃষ্টিতে ব্যর্থ হবে; যে একটি কারণে আমরা তেপ্পান্ন বছর ধরে ভুগছি। ‘আমরা বাঘের ভয়ে উঠেছি গাছে, ভূত বলছে পেয়েছি কাছে’। এ দোদুল্যমানতা নিয়েই তো আমরা বাংলাদেশে বাস করছি। আমি নিশ্চিত, এ ছাত্র-জনতার বিপ্লবের পরও শিক্ষার নামমাত্র ও আংশিক পরিবর্তন ছাড়া আশানুরূপ কিছু হবে না, যা নিয়ে আমরা আবারও অনির্দিষ্টকাল ভুগতে চলেছি। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে অন্তত স্বাধীন দেশের উপযোগী একটা ভালো শিক্ষাব্যবস্থার শুরু করা যেত। সে সময় এখনো হাতে আছে। এ দেশের সামাজিক শিক্ষা খুব উন্নত, নাকি ক্রমাবনতিশীল, প্রত্যেক সচেতন মানুষ অবহিত। আমাদের গবেষণায় বলে, অবনতিশীল সামাজিক শিক্ষা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মানকেও ঠেলে নিচে নামায়, আবার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অবনতিশীল মানও সামাজিক শিক্ষাকে নিুমুখী করে। এটাকে আমরা বিশাল সার্কেলও বলতে পারি। একটি চলক অন্য চলকের ওপর সহনির্ভরশীল পজিটিভ প্রভাব বিদ্যমান। এসবই প্রমাণ করে, আমরা কোথায় চলেছি এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা ও সামাজিক শিক্ষাব্যবস্থার কার্যক্রম একসঙ্গে হওয়া দরকার।
এদেশ আমাদের, একথা সংবিধান বললেও বাস্তবে আমরা আমাদের দেশ বলে দাবি করতে পারি না। দুচোখে যা দেখি: এদেশ লাঠিয়াল বাহিনীর প্রধানদের এবং চাটুকারদের। যাদের যোগ্যতা আছে, দেশকে দেওয়ার অনেক কিছু আছে, তাদের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা নেই। যাদের লাঠির জোর আছে, তোষামোদকারী আছে, তারাই ক্ষমতাধর, সর্বেসর্বা; সব অধিকার ও কর্তৃত্ব তাদের, আমরা তাদের প্রজা; অলক্ষ্যে চিরবিদায় নিতে হবে। এত শক্ত কথা লিখতে আমি বাধ্য হচ্ছি; লজ্জাও পাচ্ছি। কিন্তু বাস্তবতা হলো: না লিখে গত্যন্তর নেই। ঢাকঢাক-গুড়গুড় না করে সত্য কথা বলে ফেলাই ভালো। কারণ জীবনসূর্য অস্তগামীপ্রায়, যে কোনো সময় মেঘে ঢেকে যাবে। বর্তমানে দেশরক্ষা ও আত্মমর্যাদাশীল জাতি গড়ার জন্য দেশোপযোগী সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা অধিক প্রয়োজন। আমাদের কাছে সামাজিক শিক্ষার আশু উন্নয়নের নির্ভরযোগ্য মডেল আছে, যা একাধিকবার এ কলামে প্রকাশিত হয়েছে।
এদেশে যতবার নতুন করে শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে, বিষয়টাকে তারা এভাবে ভাবেননি, অন্তত দেশরক্ষার জন্য হলেও স্বদেশপ্রিয় সুশিক্ষিত মানুষ প্রশিক্ষণ দিয়ে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তৈরি করা দরকার, যাদেরকে প্রকৃতপক্ষে দেশসম্পদ বলা যাবে। আমরা লেখা ও পড়ার নাম করে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেশে মানবআপদ, দুর্নীতিবাজ, দেশ-বিক্রেতা ও গোলাম শ্রেণি তৈরি করছি। সামাজিক শিক্ষার উন্নতি ছাড়া দেশ ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার উন্নতি সম্ভব নয়, এটাও তারা ভাবেননি। আবার সামাজিক শিক্ষা ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মধ্যে কর্মমুখী শিক্ষা ছাড়াও জীবনমুখী শিক্ষা এবং মানবতাবোধ-সঞ্চারক শিক্ষা, দেশপ্রেম শিক্ষা অবশ্যম্ভাবী। নিজ স্বতন্ত্র অথবা কতিপয়তন্ত্র পুরো জনগোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এজন্য শিক্ষাব্যবস্থার এ দীনহীন অবস্থা। আবার যে শিক্ষাব্যবস্থা নতুন করে তৈরি করা হয়, বাস্তবায়ন সমস্যা নিয়ে ভাবা হয় না। তাই বাস্তবায়ন সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। সেজন্য বাস্তবায়ন সমস্যার সমাধান আগে করা প্রয়োজন। নইলে বাজেটের টাকা শেষ হয়ে যাবে; কিন্তু শিক্ষার মান বাড়বে না। যত নীতি কথাই খাতা-কলমে সুপারিশ করা হোক না কেন, বাস্তবে লবডঙ্কা হবে। যত অপাঙ্ক্তেয় কথাই বলি না কেন, সবকিছুকে নিশ্চয়তা দিয়েই বলা যায়। আমরা মূলত জনগোষ্ঠীর শিক্ষা ও সেবার উপায় ও অবলম্বন নিয়ে দাদির কবর থেকে অনেক দূরে বসে কান্নাকাটি ও হা-হুতাশ করছি। তাই নিজেদের তুলে ধরতে বাধ্য হচ্ছি। এদেশে যে শিক্ষাব্যবস্থা চলছে এবং আবারও যা হতে চলেছে, আমরা কোনোভাবেই এগুলোকে মেনে নিতে পারছি না। এতে আমাদের মতো স্বাধীনচেতা জনগোষ্ঠীর প্রয়োজন মিটবে না। দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে সামাজিক শিক্ষা প্রদান প্রয়োজন, যেমন-নিরক্ষর জনগোষ্ঠীর উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা দেওয়া; প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দেশপ্রেম ও দেশসেবার মনোভাব জাগ্রত করা; ধর্মীয় মূল্যবোধ, মানবতা, সততা, ন্যায়নিষ্ঠা ইত্যাদি মানবিক গুণাবলি জাগিয়ে তোলা; জনগোষ্ঠীর পজিটিভ মানসিকতা ও জীবনমান উন্নয়নমুখী শিক্ষা, সমাজ উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ, সফট স্কিলস ডেভেলপমেন্ট প্রশিক্ষণ, ক্যাপাসিটি বিল্ডিং, স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রশিক্ষণ একসঙ্গে দেওয়া। সন্ধ্যাবেলা স্কুল ও মাদ্রাসার অব্যবহৃত কক্ষ ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের নানামুখী জীবনভিত্তিক উন্নয়নমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ পরিচালনা করা যায়। প্রয়োজন শুধু উদ্যোগ সৃষ্টির ও স্থানীয় প্রশাসনের সদিচ্ছা। এসব কাজ সমন্বিতভাবে করতে হলে সমাজের অভ্যন্তর ভাগ থেকে কিছু সুশিক্ষিত, সমাজহিতৈষী ও ধার্মিক লোককে বেছে নিতে হবে। এরা এখনো সমাজেই বসবাস করেন। ধার্মিক বলছি এ কারণে, মানবসেবা ও সৃষ্টিসেবা একটা বড় ইবাদত বা উপাসনা, এটি মানবসেবীকে বোঝাতে হবে। গ্রামীণ সমাজে দিন শেষে সাধারণ মানুষ চায়ের দোকানে গল্পগুজব করে সময় কাটান। কেউবা রাজনৈতিক কূটকৌশল নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। অবসর সময়কে জীবন উন্নয়নমুখী কাজে ব্যবহার করা যায়। প্রতিটি ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তাদের সহযোগিতা নেওয়া প্রয়োজন। তবে সেক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নামটা একটু টেনে লম্বা করা বাঞ্ছনীয় হবে। মূলত মানুষের অসাধ্য বলতে কিছু নেই। আমরা রাজনীতিকরা এ দেশের মানুষকে অমানুষ ও স্বার্থবাদী বানিয়েই উন্নয়নের সব দরজা বন্ধ করে দিয়েছি। এখান থেকে বেরিয়ে আসা খুব সহজ কাজ। ইচ্ছা থাকলে উপায়ের অভাব নেই। লালন গেয়েছিলেন, এই মানুষে আছে রে মন, যারে বলে মানুষ রতন।
অধ্যাপক হাসনান আহমেদ এফসিএমএ: সাহিত্যিক, গবেষক ও শিক্ষাবিদ; প্রেসিডেন্ট, জাতীয় শিক্ষাসেবা পরিষদ
No comments
Thank you, best of luck