ads

সাতই মার্চের ভাষণ, ইউনুসের বাটন এবং অন্যান্য


মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন জেনজিও সরকার আটটা জাতীয় দিবস পালন না-করার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে। জেনজিও মানে জেনজি যোগ এনজিও। এই আট দিবসের মধ্যে আছে 'সংবিধান দিবস'। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান গৃহীত হয়েছিল, কার্যকর হয়েছিল ঐ বছরের ১৬ ডিসেম্বর। গণপরিষদে সংবিধান গৃহীত হওয়ার দিনটাকে ২০২২ সালে 'সংবিধান দিবস' হিশেবে পালিত হয়েছে প্রথমবার। দিবসটা নতুন। তাই, এ নিয়ে কোনো আবেগ-অনুভূতি কাজ করছে না। এই দিবসের প্রয়োজনীয়তা কী, তাও অনুভব করতে পারছি না। জেনজিও সরকারের বাতিলকৃত বাকি সাত দিবসের একটা হলো 'স্মার্ট বাংলাদেশ দিবস'। বলাই বাহুল্য— এই দিবস বিগত আওয়ামি লিগ সরকারের মগজপ্রসূত উটকো দিবস। এই দিবসের ন্যূনতম প্রয়োজনীয়তা ছিল না, নেই, ভবিষ্যতেও থাকবে না। বোঝাই যাচ্ছে— দিবসপালনের নামে মোটা অঙ্কের টাকা বরাদ্দ নিয়ে সেই টাকার সিংহভাগ মেরে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই একদল সুবিধাভোগী আমলা আর একপাল ধড়িবাজ আওয়ামি লিগ-নেতা এই দিবস পয়দা করেছিলেন। 'স্মার্ট বাংলাদেশ' কথাটা কোথাও দেখলেই মনে পড়ে আওয়ামি লিগের পলায়নপটিয়সী সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কথা, ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসের ৬ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের 'অপরাজেয় বাংলা'র পাদদেশে ছাত্রলিগের সমাবেশে যিনি বলেছিলেন— 'আমি ছাত্রলিগকে বলতে চাই, আমি তোমাদের কাছে স্মার্ট বাংলা।' কাদের 'স্মার্ট বাংলা' পর্যন্তই বলতে পেরেছিলেন, 'বাংলাদেশ' আর বলতে পারেননি। এরই মধ্যে ছাত্রলিগের এক-দেড়শো নেতাসমেত মঞ্চ ভেঙে তিনি ভূপাতিত হয়েছিলেন। 'স্মার্ট বাংলাদেশ দিবস' পালনের ঘোষণা এসেছিল ২০২৩ সালের আগস্টে, দিবসটা পালিত হতে পেরেছে একবারই— ঐ বছরের ১২ ডিসেম্বর। কিন্তু 'স্মার্ট বাংলাদেশ দিবস' পালন করলে করা উচিত ৬ জানুয়ারি, যেদিন 'স্মার্ট বাংলাদেশ' কথাটা উচ্চারণ করতে গিয়ে ওবায়দুল কাদের ধূলিসাৎ হয়েছিলেন।




আর যে-ছয় দিবস বাকি থাকে, এর মধ্যকার পাঁচটাই শেখ পরিবারের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট। একটা হলো পনেরোই আগস্ট, যেদিন শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবার নিহত হয়েছিলেন। মুজিব জন্মেছিলেন মার্চের ১৭ তারিখে। আওয়ামি লিগের আমলে এই দিনটা পালিত হতো শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন হিশেবে, আবার 'জাতীয় শিশুদিবস' হিশেবেও। অর্থাৎ আওয়ামি লিগ শেখ মুজিবের জন্মদিনের সাথে লটকে দিয়েছিল শিশুদিবস। বলাই বাহুল্য— অন্য সরকারগুলোর আমলে ১৭ মার্চ কোনো দিবসই পালিত হয় না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য— জিয়াউর রহমানের জন্মদিন ১৯ জানুয়ারি। বিএনপির আমলে ঐদিন জাতীয়ভাবে জিয়ার জন্মদিন পালিত তো হতোই, সাথে লটকে দেওয়া হয়েছিল 'জাতীয় শিক্ষকদিবস'। কিন্তু আওয়ামি লিগ ক্ষমতায় গিয়ে, স্বভাবতই, দুটো দিবসেই পরিবর্তন আনে— জিয়ার জন্মদিন জাতীয়ভাবে উদ্‌যাপন বাতিল করে এবং শিক্ষকদিবসকে ১৯ জানুয়ারি থেকে সরিয়ে ৫ অক্টোবরে পাঠিয়ে দেয়। আরো উল্লেখ্য— আওয়ামি লিগ সরকার জিয়াউর রহমানের মাজারও চন্দ্রিমা উদ্যান থেকে সরিয়ে অন্যত্র প্রতিস্থাপন করতে চেয়েছে বহুবার। মজার ব্যাপার হলো— এই যে 'চন্দ্রিমা উদ্যান' লিখলাম, এই নামটাও ঐতিহাসিকভাবে মীমাংসিত না। অর্ধচন্দ্রাকার ক্রিসেন্ট লেকের সাথে মিল রেখে কবি ও রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আশির দশকে এই উদ্যানের নাম রেখেছিলেন 'চন্দ্রিমা উদ্যান'। এর পর নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে এর নাম হয় 'জিয়া উদ্যান', নব্বইয়ের দশকের মাঝের দিকে আওয়ামি লিগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর উদ্যানটা আবার হয়ে যায় 'চন্দ্রিমা উদ্যান'। বলাই বাহুল্য— ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত 'চন্দ্রিমা উদ্যান' ফের 'জিয়া উদ্যান' ছিল এবং ২০০৯ থেকে অদ্যাবধি এটা 'চন্দ্রিমা উদ্যান'। বাংলাদেশের এই উদ্যান এমনই এক উদ্যান— সরকার পরিবর্তন হলেই যেটার নাম স্বয়ংক্রিয়ভাবে বদলে যায়। জেনজিও সরকার উদ্যানটার নাম 'চন্দ্রিমা উদ্যান'ই রাখবে, নাকি 'জিয়া উদ্যান' ফিরিয়ে আনবে; নাকি রিসেট উদ্যান, মাস্টারমাইন্ড উদ্যান বা মেটিকিউলাস উদ্যান রাখবে— এখনও বোঝা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নাগরদোলা যে কতটা ঘূর্ণনশীল, তা এই এক উদ্যানের নামপরিবর্তন দেখলেই ঠাহর করা যায়।

শুধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনকেই না; আওয়ামি লিগ সরকার জাতীয় দিবস হিশেবে পালন করত শেখ হাসিনার মা শেখ ফজিলাতুন্নেছা এবং এমনকি দুই ভাই শেখ কামাল ও শেখ রাসেলের জন্মদিনকেও। একই ব্যক্তির 'জন্মদিনে'ও সরকারি ছুটি, 'মৃত্যুদিনে'ও সরকারি ছুটি— আওয়ামি লিগ দেশে এই ধারা চালু করেছিল প্রথমবার, শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষেত্রে; যা নিছকই অপ্রয়োজনীয় ছিল। ছুটি কেবল মৃত্যুদিনে রাখলেই চলত। শেখ হাসিনার মা-ভাইদের জন্মদিন কোন যুক্তিতে জাতীয় দিবস হিশেবে পালিত হতে পারে; এর কোনো ব্যাখ্যা কারো কাছে নেই, খোদ হাসিনার কাছেও না, এই জিনিশ ব্যাখ্যার ঊর্ধ্বে। হাসিনা অবশ্য নিজ পরিবারের সদস্যদের এবং নিজের নামে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন জিনিশের নামকরণে অকুণ্ঠ অসুস্থতার পরিচয় দিয়েছেন। 'পনেরোই আগস্ট ভেসে গেল পাঁচ আগস্টের জলে'— এই শিরোনামের একটা দীর্ঘ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছি শেখ পরিবারের সদস্যদের নামে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নামকরণে আওয়ামি লিগ কী পরিমাণ উন্মত্ত ছিল। দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে পঞ্চান্নটা; এর মধ্যে তেরোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম শেখ পরিবারের সদস্যদের নামে— ফজিলাতুন্নেছা ও হাসিনার নামে দুটো করে এবং মুজিবের একার নামে নয়টা। আওয়ামি লিগ আমলে প্রস্তাবিত একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নামও মুজিবের নামে। কুষ্টিয়ার ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে হল আছে মোট আটটা; এর মধ্যে শেখ পরিবারের নামেই চারটা— শেখ মুজিবুর রহমান, শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, শেখ হাসিনা ও শেখ রাসেলের নামে (অবশ্য সেখানে একইসাথে জিয়াউর রহমান এবং খালেদা জিয়ার নামেও হল আছে)। শের-এ-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে হাসিনা চারটি হলের নামকরণ করেছেন নিজ পরিবারের চার সদস্যের নামে। একটা নিজের নামে, একটা মায়ের নামে, বাকি দুটো দাদা-দাদির নামে। জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও চারটা হল শেখ পরিবারের নামে— মুজিব, ফজিলাতুন্নেছা, হাসিনা আর রাসেল; ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্পোর্টিং কমপ্লেক্সের নাম হাসিনার ভাইয়ের (কামাল) নামে, একটা গবেষণাগারের নাম স্বামীর নামে। যা হোক, হাসিনা মায়ের এবং দুই ভাইয়ের (কামাল-রাসেল) জন্মদিনকে জাতীয় দিবস হিশেবে পালন করতেন, এই দুই ভাইয়ের নামে বিভিন্ন স্থাপনার নামও রেখেছেন। কিন্তু আরেক ভাই জামালের নামে খুব-একটা উল্লেখযোগ্য কিছুর নাম তিনি রাখেননি, জামালের জন্মদিনকে তিনি জাতীয় দিবস হিশেবেও পালন করেননি। ১৯৪৯ (কামালের জন্মসাল) বা এর কাছাকাছি সালে জন্ম-নেওয়া অনেক মোসাহেবকে 'শেখ কামালের বন্ধু' পরিচয়ে শেখ হাসিনার কাছ থেকে অনেক সুবিধাও বাগিয়ে নিতে দেখা গেছে। কিন্তু কাউকে 'শেখ জামালের বন্ধু' পরিচয় দিতে দেখিনি বা শুনিনি। জামালের ব্যাপারে হাসিনা কেন এমন উদাসীন কিংবা নিজের এবং রেহানার জন্মদিনকেও কেন তিনি জাতীয় দিবস হিশেবে পালন করতেন না— বুঝে উঠতে পারছি না। নিজের জন্মদিন উপলক্ষে শেখ হাসিনা কেন প্রতিবছর এক সপ্তাহের সরকারি ছুটি ঘোষণা করেননি— ভাবতেই বিস্মিত হতে হয়।

শেখ পরিবারের চার সদস্যের জন্মদিনকে জাতীয় দিবস হিশেবে পালন করা নিষ্প্রয়োজন। শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন দলীয়ভাবে পালন করা যেতে পারে, জাতীয়ভাবে না। ফজিলাতুন্নেছা বা কামাল-রাসেলের জন্মদিন, এমনকি, দলীয়ভাবেও পালনের প্রয়োজন নেই; পালন করা যেতে পারে পারিবারিকভাবে। পঁচাত্তরের পর শেখ পরিবারের কেউ আওয়ামি লিগের সভাপতি না-হলে মুজিবকে ছাড়া ঐ পরিবারের আর কাউকে জাতি মনে রাখত না, রাখার দরকারও নেই। ইতিহাসে তাদের কোনো বিশেষত্ব নেই। কিন্তু পনেরোই আগস্ট এবং সাতই মার্চকে জাতীয় দিবস হিশেবে পালন না-করার ভেতর অসৎ উদ্দেশ্য আছে, দুরভিসন্ধি আছে, রিসেট বাটন আছে। যদি 'জাতির পিতা' হিশেবে মানা না-ও হয়, এটুকু মানতেই হবে— শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘিরেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা-আন্দোলন আবর্তিত হয়েছে। তিনিই ছিলেন অবিভক্ত পাকিস্তানের দুই অংশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। মুজিবের হাতে ক্ষমতা পাকিস্তানি শাসকদের ক্ষমতা হস্তান্তর করা না-করা নিয়েই সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা চালিয়েছিল, কারাবন্দি মুজিবের নামেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল, যুদ্ধজয়ের পর মুজিবের হাতেই অস্থায়ী সরকার ক্ষমতা তুলে দিয়েছিল। আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, জিয়াউর রহমান, আবদুস সাত্তার, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বা খালেদা জিয়ার আমলে শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয়নি; কেননা উল্লিখিত প্রত্যেকেই মুজিবহত্যার সরাসরি সুবিধাভোগী। মুজিব নিহত না-হলে এদের কেউই কখনও রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধান হতে পারতেন না। অবশ্য মুজিবের স্বাভাবিক মৃত্যু হলে হাসিনারও কখনও প্রধানমন্ত্রী হওয়া হতো না, থেকে যেতেন গৃহিণী অথবা গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামি লিগের মহিলা-বিষয়ক সম্পাদক কিংবা ধানমন্ডি থানা যুব মহিলা লিগের সহ-সভাপতি। শেখ হাসিনা কুড়ি বছর ক্ষমতায় থাকতে পেরেছিলেন 'স্বজন হারানোর বেদনা'কে সুচারুভাবে বাজারজাত করে। ক্ষমতার সর্বশেষ মাসেও তিনি 'স্বজন হারানোর বেদনা'কে পুঁজি করে টেলিভিশনে ভাষণ দিয়েছিলেন। যা হোক, জেনজিও সরকারের শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী জাতীয়ভাবে পালন না-করার সাধারণ অর্থ দাঁড়ায়— এই সরকারও মুজিবহত্যার সুবিধাভোগী অথবা সুবিধাভোগীদের প্রকল্প বাস্তবায়নকারী। এর বাইরে ভিন্নকিছু ভাবার অবকাশ থাকে না। শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে সরকারি ছুটি বাতিল করা যায়, কিন্তু দিনটা জাতীয়ভাবে পালন না-করার সুযোগ নেই।

স্বাধীনতার সরাসরি ঘোষণা দেওয়া শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। দিলে তাৎক্ষণিকভাবে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহমামলা হতো, বিচারে নিশ্চিতভাবে তার মৃত্যুদণ্ড হতো এবং সেই দণ্ড কার্যকরে পাকিস্তান সরকার বিন্দুমাত্র দেরি করত না। অবিভক্ত পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের প্রধান হওয়ায় তাকে অপেক্ষা ও দেনদরবার করতে হয়েছে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য। কিন্তু তিনি বুঝতে পেরেছিলেন শাসকগোষ্ঠী কোনোভাবেই ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না এবং সামরিক আগ্রাসন চালাবে। তাই, ৭ মার্চের ভাষণে তিনি সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা না-করে বলেছিলেন এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। যুদ্ধকালে সাধারণ মানুষের কী করণীয়, সরকারি কর্মচারীদের কী করণীয়, আওয়ামি লিগের কী করণীয়— ভাষণে তা তিনি সরাসরিই বলেছেন। যার যা-কিছু আছে, তা-ই নিয়ে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানানোর মাধ্যমে দেশের মানুষকে মুজিব গেরিলাযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে বলেছিলেন। 'আমি যদি হুকুম দেবার না-ও পারি' বাক্যের মধ্য দিয়ে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তিনি হয়তো যুদ্ধকালে সরাসরি দিক্‌নির্দেশনা দিতে পারবেন না। খাজনা-ট্যাক্স দেওয়া বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশদানের মধ্য দিয়ে তিনি অসহযোগ আন্দোলনের আহ্বান জানিয়েছিলেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ সে-মতেই চলেছিল। ঐ সময়টায় পূর্ব পাকিস্তান তার অঙ্গুলিহেলনেই চলেছে। পূর্ব পাকিস্তানে তৎকালে তিনিই ছিলেন সরকার। ফলে, তার ঐ কৌশলী ভাষণেই জনগণ পরিষ্কারভাবে বুঝে গিয়েছিল পাকিস্তান আর অবিভক্ত থাকছে না; বিভক্তি অনিবার্য, স্বাধীনতা সময়ের ব্যাপার মাত্র।

সাতই মার্চের ভাষণই যেহেতু অবিভক্ত পাকিস্তানের কফিনে চূড়ান্ত পেরেক ঠুকে দিয়েছিল, তাই সাতই মার্চকে ম্লান করে দেওয়ার পরিকল্পনাও স্বাধীন বাংলাদেশে একাধিকবার গৃহীত হয়েছে। আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের শাসনামলে, ১৯৭৬ সালে, রেসকোর্স ময়দানে (সোহ্‌রাওয়ার্দি উদ্যান) তৎকালীন বিমানবাহিনীপ্রধান মোহাম্মদ গোলাম তাওয়াব তিনদিনব্যাপী এক 'সিরাত মাহফিল' আয়োজন করেছিলেন। তারিখ হিশেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল ৭ মার্চকেই, কারণ পাঁচ বছর আগের এই দিনে শেখ মুজিবুর রহমান একই মাঠে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। মাহফিলে বক্তব্য রাখেন লিবিয়া ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা, যাদের অধিকাংশই বাহাত্তরের দালাল আইনে সাজাপ্রাপ্ত। বক্তব্য রাখেন তরুণ মওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীও। স্বাধীনতাবিরোধীদেরকে একযোগে মাঠে নামালে মুক্তিযোদ্ধারা কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখান, তা পরখ করে দেখাই ছিল ঐ মাহফিল আয়োজনের উদ্দেশ্য। আলোচ্য মাহফিল থেকে দাবি ওঠে জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকা পরিবর্তনের, এমনকি বাংলাদেশকে 'ইসলামি প্রজাতন্ত্র' ঘোষণারও। সেই মাহফিলে স্লোগান দেওয়া হয়েছিল— 'তাওয়াব ভাই, তাওয়াব ভাই, চান-তারা পতাকা চাই।' খালেদা জিয়ার সাবেক প্রেস-সচিব মারুফ কামাল খানের কলাম পড়ে জানলাম— ঐ মাহফিলে, গোলাম আজমের লিখিত বক্তব্যও পড়ে শোনানো হয়েছিল। যে-রেসকোর্স ময়দান থেকে 'এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম' ডাক এসেছিল, সেই ময়দানেই সেই ডাকের পাঁচ বছর পর চান-তারা পতাকা চেয়ে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত সম্প্রদায় প্রতিশোধ নিয়েছিল।

১৯৭৬ সালের ৭ বা ৮ মার্চের পত্রপত্রিকায় ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণসংক্রান্ত কোনো খবর ছাপা হয়নি বা ছাপতে দেওয়া হয়নি। ১৯৭৭ সালে ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় এক কলামে 'আজ ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ' শিরোনামে একটা খবর প্রকাশিত হয়েছিল। পুরো খবরে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম এড়িয়ে যাওয়া হয়েছিল। ১৯৭৮ সালে ইত্তেফাকে ৭ মার্চ যে-খবরটা প্রকাশিত হয়েছিল, তাতে মুজিবের নামের উল্লেখ ছিল— 'আজ হইতে সাত বৎসর পূর্বে এই দিনে ঐতিহাসিক সোহ্‌রাওয়ার্দি উদ্যানে লক্ষ সংগ্রামী জনতার সম্মুখে সেদিনের সর্বাপেক্ষা প্রাণপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান সংগ্রামে ঝাঁপাইয়া পড়ার উদাত্ত আহ্বান জানাইয়াছিলেন।' ১৯৭৯ সালে ৭ মার্চসংক্রান্ত খবরে কিছু পত্রিকা মুজিবের নামের আগে 'বঙ্গবন্ধু' ও ১৯৮০ সালে 'জাতির জনক' খেতাব ব্যবহার করে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে ১৯৮৪ ও ১৯৮৫ সালে সাতই মার্চ নিয়ে কোনো খবর প্রকাশিত হয়নি। অবশ্য ১৯৮৪ সালের ৬ থেকে ১৩ মার্চ পর্যন্ত সংবাদপত্রের কর্মচারীরা ধর্মঘটে ছিলেন। ১৯৮৬ সালের সংবাদপত্রে সাতই মার্চ উপলক্ষে আওয়ামি লিগের আয়োজিত সভা-সমাবেশের বর্ণনা থাকলেও তাতে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম উল্লিখিত ছিল না। তবে, ১৯৮৭ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সংবাদপত্রে ৭ মার্চের খবর মুজিবের নামসহই ছিল। অর্থাৎ সাতই মার্চকে ম্লান করার চেষ্টা সায়েমের আমলে ছিল, জিয়ার আমলে ছিল, ছিল এরশাদের আমলেও।

শাহবাগে যে-শিশুপার্কটি আছে; সেটি স্থাপন করেন জিয়াউর রহমান, ১৯৭৯ সালে। সেই সুবাদে পার্কটি বিএনপির আমলগুলোয় 'শহিদ জিয়া শিশুপার্ক' নামেও পরিচিত ছিল। কিন্তু এই পার্ক অরাজনৈতিক না। এই পার্কের পেছনেও গভীর রাজনীতি আছে। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ যে-জায়গাটায় দাঁড়িয়ে ভাষণ দিয়েছিলেন, সেই জায়গা যাতে ভবিষ্যতে কখনও চিহ্নিত করা না-যায় এবং 'রেসকোর্স ময়দান' বা 'সোহ্‌রাওয়ার্দি উদ্যান' নামোচ্চারণের সাথে-সাথে মানসপটে ৭ মার্চের ভাষণ ভেসে না-উঠে যেন অন্যকিছু ভাসে; সেজন্য ঠিক ঐ জায়গায় বা এর কাছাকাছি স্থানে শিশুপার্ক নির্মাণ করা হয়েছিল। শাহবাগে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত শিশুপার্ক-নির্মাণের মাধ্যমে, বাংলাদেশের মুক্তি-আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ একটা স্থান ইতিহাস থেকে মুছে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে; রেসকোর্স ময়দানকে পাদপ্রদীপের বাইরে নিয়ে যেতে চাওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য— শেখ হাসিনাও 'শেখ রাসেল রোলার স্কেটিং কমপ্লেক্স' নির্মাণ করে ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানকে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে ব্যবহারের অনুপযোগী করে দিয়ে রেখে গেছেন, যাতে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও আওয়ামি লিগের মতো সোহ্‌রাওয়ার্দি উদ্যানে সমাবেশ করে বা করতে বাধ্য হয়।

নির্মলেন্দু গুণের 'স্বাধীনতা— এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো' কবিতার কিছু পঙ্‌ক্তি এ রকম— 'এই শিশুপার্ক সেদিন ছিল না, এই বৃক্ষে-ফুলে শোভিত উদ্যান সেদিন ছিল না, এই তন্দ্রাচ্ছন্ন বিবর্ণ বিকেল সেদিন ছিল না। তা হলে কেমন ছিল সেদিনের সেই বিকেল বেলাটি? তা হলে কেমন ছিল শিশুপার্কে বেঞ্চে-বৃক্ষে ফুলের বাগানে ঢেকে দেওয়া এই ঢাকার হৃদয় মাঠখানি? জানি, সেদিনের সব স্মৃতি মুছে দিতে হয়েছে উদ্যত কালো হাত। তাই দেখি— কবিহীন এই বিমুখ প্রান্তরে আজ কবির বিরুদ্ধে কবি, মাঠের বিরুদ্ধে মাঠ, বিকেলের বিরুদ্ধে বিকেল, উদ্যানের বিরুদ্ধে উদ্যান, মার্চের বিরুদ্ধে মার্চ' (রচনাকাল ১৯৮০)। ৭ মার্চের সব স্মৃতি মুছে দিতে কালো হাত উদ্যত হয়েছিল বলে গুণ এখানে যে-অভিযোগ করেছেন, সেই কালো হাত কার; তা নিশ্চয়ই বলার আর অপেক্ষা রাখে না। কবি নির্মলেন্দু গুণের সাথে কথা বলে জেনেছি— 'উদ্যানের বিরুদ্ধে উদ্যান' বলতে তিনি সোহ্‌রাওয়ার্দি উদ্যানের (রেসকোর্স ময়দান) বিরুদ্ধে দাঁড়-করানো শিশুপার্ককে বুঝিয়েছেন। শেখ মুজিবের জীবদ্দশায় রাজনৈতিক সমাবেশ রেসকোর্স ময়দানেই হতো। তার মৃত্যুর পর 'বহুদলীয় গণতন্ত্র' চালু হলেও সামরিক শাসন জারি থাকার কারণে রাজনৈতিক সমাবেশের অনুমতি ছিল না। পরবর্তীকালে জিয়াউর রহমান 'ঘরোয়া রাজনীতি'র অনুমতি দেন এবং গুলিস্তানে জিপিওর পার্শ্ববর্তী খালি জায়গায় (মুক্তাঙ্গন) ক্ষুদ্র পরিসরে সভা করার সুযোগ দেন। এই প্রক্রিয়াকেই গুণ 'মাঠের বিরুদ্ধে মাঠ' বলেছেন। পনেরোই আগস্টের পর শাসকগোষ্ঠীকে তোয়াজ করার জন্য অখ্যাত অনেক কবি শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে কবিতা লিখেছিলেন এবং প্রগতিশীল কিছু কবি নিপীড়িত হওয়ার ভয়ে পনেরোই আগস্টের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান নেননি। 'কবির বিরুদ্ধে কবি'— এখানে প্রথমোক্ত 'কবি' স্বয়ং মুজিব (৭ মার্চের ভাষণ কবিতার মতো ছিল বিধায়) আর দ্বিতীয়োক্ত 'কবি' হলেন ঐ দুই শ্রেণির কবিসম্প্রদায়। আর 'মার্চের বিরুদ্ধে মার্চ' বলতে গুণ শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণের বিপরীতে স্বাধীনতাবিরোধীদের ১৯৭৬ সালের ৭ মার্চের 'সিরাত মাহফিল' আর সামরিক শাসকদের মার্চপাস্টকে (কুচকাওয়াজ) বুঝিয়েছেন।

হুমায়ূন আহমেদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র 'আগুনের পরশমণি' মুক্তি পায় ১৯৯৪ সালে। তিনি 'ছবি বানানোর গল্প' বইয়ে লিখেছেন— 'হঠাৎ অন্য একটা চিন্তা আমাকে অভিভূত করে ফেলছে। আমি সেটা নিয়েই ভাবছি। খুব অস্থির বোধ করছি। আমি বানাচ্ছি মুক্তিযুদ্ধের ছবি। সেই ছবিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে কোনো-না-কোনোভাবে উপস্থিত করা যায় না? মূল চিত্রনাট্যে তিনি নেই। উপন্যাসেও নেই। অবরুদ্ধ ঢাকা নগরীর তিন দিনের কাহিনীতে তার উপস্থিতির প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু আমি একটা ছবি বানাচ্ছি— সেই ছবিতে তিনি থাকবেন না? আমার ছবি কেন বাংলাদেশ টেলিভিশন হবে? বাংলাদেশ টেলিভিশনে তিনি নিষিদ্ধ, আমার ছবিতে কেন নিষিদ্ধ হবেন? অনেকগুলি সমস্যা দেখা দিল। এক. যে চিত্রনাট্যে সরকারি অনুদান পেয়েছি, সেই চিত্রনাট্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নেই। তাকে নিয়ে এলে অনুদান কমিটি আমাকে ধরবে। দুই. আমি ছবি শেষ করে ফেলেছি। এখন কোথায় তাকে আনব? আনলে এমনভাবে আনতে হবে যেন আরোপিত মনে না হয়। সেটা কি সম্ভব? তিন. ধরা যাক, তাকে ভালোভাবেই আনলাম; সেন্সর বোর্ড কি আমাকে ছাড়পত্র দেবে? সূর্যের চেয়ে বালি সব সময় গরম থাকে। সেন্সর বোর্ড বিষয়ক বালি খুবই উত্তপ্ত থাকার কথা।

ছবির নির্বাহী প্রযোজক মোজাম্মেল হোসেন সাহেবকে আড়ালে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম আমি বঙ্গবন্ধুকে কোনো-না-কোনোভাবে ছবিতে আনার পরিকল্পনা করেছি— আপনি কী বলেন? মোজাম্মেল সাহেব আঁতকে উঠে বললেন, সর্বনাশ এই কাজটা করবেন না। নিজের মহাবিপদ নিজে ডেকে আনবেন না। আমি ছবির সাথে যুক্ত আমার আরো কিছু ঘনিষ্ঠজনকে জিজ্ঞেস করলাম। আশ্চর্যের কথা হলো সবাই বললেন, কাজটা ঠিক হবে না। সবার আপত্তি অগ্রাহ্য করলাম। ছবিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠ যুক্ত হলো। ছবিটি শুরু হচ্ছে মতিনউদ্দিন সাহেবকে (আবুল হায়াত) দিয়ে। মতিন সাহেব শর্টওয়েভে বিবিসি ধরার চেষ্টা করছেন। আমি করলাম কী— বিবিসির বদলে করে দিলাম স্বাধীন বাংলা বেতার। স্বাধীন বাংলা বেতারে তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রকণ্ঠ প্রচারিত হতো। সাতই মার্চের ভাষণের এক অংশ— এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। বজ্রকণ্ঠের পরপরই আমি একটা গান ব্যবহার করলাম— জয় বাংলা, বাংলার জয়। কোথাও ছন্দপতন হলো না। বরং পুরো বিষয়টায় একটা প্রতীকী ভাব চলে এল। মুক্তিযুদ্ধের একটা ছবি শুরুই হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রকণ্ঠ দিয়ে। আমি ছবিটির দুটি ভার্সন তৈরি করলাম। একটিতে বজ্রকণ্ঠ আছে, অন্যটিতে নেই। বজ্রকণ্ঠ আছে এই প্রিন্টটি সেন্সরে জমা দিলাম। সেন্সর বোর্ডের সদস্যরা ছবি দেখলেন। তাদের অনেকের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। বোর্ডের সভাপতি বললেন, ছবি ঠিক আছে তবে কয়েকটি ব্যাপারে কিছু পরিবর্তন করতে হবে। প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের পরেই ছাড়পত্র পাওয়া যাবে। শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রকণ্ঠ বাদ দিতে হবে, নগ্ন করে দুটি মানুষকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে সেটা বাদ দিতে হবে, পাকিস্তানি মিলিটারি কথাটি বাদ দিতে হবে। আমরা সার্কভুক্ত দেশ, আমরা এমন কিছু করতে পারি না যা সার্কের চেতনা ক্ষুণ্ণ করে।' অর্থাৎ খালেদা জিয়ার আমলেও চলচ্চিত্রে সাতই মার্চের ভাষণ সংযোজন দুরূহ ছিল, যদিও উল্লিখিত চলচ্চিত্রে হুমায়ূন আহমেদ শেষ পর্যন্ত সাতই মার্চের ভাষণ রেখেছিলেন এবং খালেদা জিয়া চলচ্চিত্রটা নিজেও দেখেছিলেন। এই চলচ্চিত্র নির্মাণে খালেদা সহযোগিতা করেছিলেন বলেও হুমায়ূন আহমেদ উল্লেখ করেছেন।

অনেকেই আশঙ্কা করছেন— জেনজিও সরকার আপাতত সাতই মার্চে হাত দিয়েছে; এর পর হাত দেবে ছাব্বিশে মার্চে, এর পর ষোলোই ডিসেম্বরে। এই দুই দিবসে হাত অনেক আগেই দেওয়া হয়ে গেছে। ১৯৮১ সালে, জিয়াউর রহমানের আমলে, ঘোষণা আসে— ২৬ মার্চ 'স্বাধীনতাদিবস' হিশেবে পালিত না-হয়ে 'জাতীয় দিবস' নামে পালিত হবে এবং ১৬ ডিসেম্বর 'বিজয়দিবস' হিশেবে পালিত না-হয়ে পালিত হবে 'স্বাধীনতাদিবস' হিশেবে। এর সুস্পষ্ট অর্থ হলো— এই ভূখণ্ডের লোকজন ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানের নাগরিক ছিল, ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই দেশ পাকিস্তানই ছিল। এর ফলে ২৬ মার্চের স্বাধীনতাঘোষণা, ১০ এপ্রিল অস্থায়ী সরকারগঠন (মুজিবনগর সরকার) ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র (অস্থায়ী সংবিধান) প্রণয়ন, ১৭ এপ্রিল অস্থায়ী সরকারের শপথগ্রহণ অবৈধ হয়ে যায়; একাত্তরের যুদ্ধটা 'মুক্তিযুদ্ধ' না-হয়ে পরিণত হয়ে যায় 'বিচ্ছিন্নতাবাদী' যুদ্ধে। ১৯৭২ সালে যে 'দালাল আদেশ' পাশ করা হয়েছিল; সেই আইন অনুযায়ী বিচার করা সম্ভব ছিল শুধু দেশীয় দালালদের, পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের না। বাংলাদেশের 'স্বাধীনতাদিবস' যদি ১৬ ডিসেম্বর হয়, তা হলে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ভূখণ্ডের সবাইকে পাকিস্তানের নাগরিক বলে গণ্য করতে হয়। সে হিশেবে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঐ দালালরাও ছিল পাকিস্তানের নাগরিক। এর মানে দাঁড়ায়— ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ভূখণ্ডে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের বিচার করার জন্য বাংলাদেশ কোনো আইনই তৈরি করতে পারবে না (যেহেতু বাংলাদেশের আইন দিয়ে পাকিস্তানিদের বিচার করা যায় না)। ভবিষ্যতেও যেন কেউ এ-দেশীয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আইন তৈরি করতে না-পারে, জিয়াউর রহমান সেজন্য 'স্বাধীনতাদিবস' ২৬ মার্চের বদলে '১৬ ডিসেম্বর' পালন করতে চেয়েছিলেন। ১৯৮১ সালের মে মাসেই নিহত হওয়ায় জিয়া ১৬ ডিসেম্বর একবারও স্বাধীনতাদিবস পালন করে যেতে পারেননি। ঐ বছরের ২৬ মার্চ 'জাতীয় দিবস' পালন করায় তিনি ব্যাপক প্রতিবাদের মুখোমুখি হন এবং ঘোষণা দেন— পরের বছর থেকে ২৬ মার্চ 'জাতীয় দিবস' হিশেবে পালিত না হয়ে 'স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস' হিশেবে পালিত হবে। এই তথ্য নিয়েছি সাবেক তথ্যপ্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়িদের 'জেনারেল জিয়ার রাজত্ব' ও সাংবাদিক আবেদ খানের 'ষড়যন্ত্রের জালে বিপন্ন রাজনীতি' বই থেকে। এ-ব্যাপারে আরো বিশদ বর্ণনা আছে আমার 'আমিত্ববাদের দেশে ডামিত্ববাদের দেশে' বইয়ে।

জেনজিও সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনুসকে ভয়েস অব আমেরিকার সাংবাদিক আনিস আহমেদ সম্প্রতি প্রশ্ন করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডি ৩২-এর বাসভবন ভস্মীকরণ, মুজিবের ভাস্কর্য বিনষ্টকরণ এবং পনেরোই আগস্টের সরকারি ছুটি বাতিলকরণ প্রসঙ্গে। আনিস এই তিন প্রসঙ্গ তোলার পরপরই ইউনুস ক্ষেপে গিয়েছিলেন এবং চোখে-মুখে তিরিক্ষি ভাব ফুটিয়ে বলেছিলেন— 'ছাত্ররা বলেছে যে, আমরা রিসেট বাটন পুশ করেছি। এভরিথিং ইজ গন। অতীত নিশ্চিতভাবে চলে গেছে।' কিন্তু তীব্র সমালোচনার মুখে এই রিসেট বাটন তত্ত্বের ব্যাখা দিতে বাধ্য হয়েছে ইউনুসের প্রেস উইং। বিবৃতিতে প্রেস উইং বলেছে— 'মুহাম্মদ ইউনুস রিসেট বাটন চাপার কথাটি উল্লেখ করে দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতি, যা বাংলাদেশের সব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করেছে, অর্থনীতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছে এবং কোটি মানুষের ভোটাধিকার ও নাগরিক অধিকার হরণ করেছে, সেটি থেকে বের হয়ে এসে নতুনভাবে শুরু করার কথা বুঝিয়েছেন। তিনি কখনোই বাংলাদেশের গর্বিত ইতিহাস মুছে ফেলার কথা বলেননি।' কিন্তু ইউনুস রিসেট বাটন টেপার কথা ভোটাধিকারহরণ, অর্থনীতিধ্বংস বা দুর্নীতির প্রসঙ্গে বলেননি। শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবন ভস্মীকরণ বা তার ভাস্কর্য বিনষ্টকরণ প্রক্রিয়ার সাথে ইউনুসের দেওয়া নতুন ব্যাখ্যায় উল্লিখিত দুর্নীতি, ভোটাধিকারহরণ বা অর্থনীতিধ্বংসের সম্পর্ক নেই।
পনেরোই আগস্টের সরকারি ছুটি বাতিলের পর সাতই মার্চকে জাতীয় দিবস হিশেবে পালন না-করার জেনজিও সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে— ইউনুস ও তার পারিষদবর্গ মুক্তিযুদ্ধের নামনিশানা রাখতে চায় না; কথিত বাটন পুশ করে তারা সাতচল্লিশপরবর্তী তেইশ বছরের পুরো ঘটনাপ্রবাহই রিসেট করতে চায়। জেনজিও সরকারের প্রায় সব কর্মকাণ্ড দেখেই প্রতিভাত হয়— সমন্বয়করা জুলাই মাসে 'তুমি কে, আমি কে— রাজাকার, রাজাকার' স্লোগান মন থেকেই দিয়েছিল। সাতই মার্চকে অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়ার চেষ্টা বাংলাদেশের সব শাসকই করেছেন। আর নার্সিসিস্ট শেখ হাসিনা এবং তার অত্যুৎসাহী শাগরেদরা সাতই মার্চের ভাষণের অপব্যবহারের মাধ্যমে জাতিকে জ্বালিয়ে মেরে গেছেন। আগস্টের ১৫, ডিসেম্বরের ১৬ এবং মার্চের ৭ ও ১৭ তারিখে রাস্তাঘাটে মাইক বসিয়ে আওয়ামি লিগের লোকজন সাতই মার্চের ভাষণ বাজিয়ে গণবিরক্তি উৎপাদন করেছেন। কোনো-কোনো বছর বিশেষ দিবসগুলোয় আওয়ামি লিগ সরকার সাতই মার্চের ভাষণের কিয়দংশকে দেশের সবার মোবাইল ফোনের কলার টিউন হিশেবে বাধ্যতামূলকভাবে সেঁটে দিয়েছে, যা রীতিমতো বেআইনি। অন্যান্য সরকারের অবদমনচেষ্টা আর আওয়ামি লিগ সরকারের অতি-আদিখ্যেতা সত্ত্বেও সাতই মার্চ ইতিহাস থেকে কখনও মুছে যায়নি, যাবে না। মুক্তিযুদ্ধের পাঁচ বছর পর রেসকোর্স ময়দানে সিরাত মাহফিল আয়োজন করে চান-তারা পতাকা চেয়ে সাতই মার্চকে ম্লান করা যায়নি, সত্তর-আশির দশকে পত্রপত্রিকায় খবর ছাপতে না-দিয়ে বা দায়সারা খবর ছাপতে বাধ্য করে সাতই মার্চকে ম্লান করা যায়নি, নব্বইয়ের দশকে চলচ্চিত্রে সাতই মার্চের ভাষণ সংযোজনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেও সাতই মার্চকে ম্লান করা যায়নি; একুশ শতকের কুড়ির দশকে জেনজিও সরকারের 'মেটিকিউলাস ডিজাইন' সাতই মার্চকে দাবায়ে রাখতে পারবে— সে-আশা দুরাশামাত্র। শেখ মুজিবুর রহমানের ঐ সতেরো মিনিটের ভাষণই পাকিস্তানি শাসকদের তেইশ বছরের শোষণের অকাট্য দলিল। ঐ ভাষণই পাকিস্তানকে রিসেট করে দিয়েছে। এই দলিল ছিঁড়ে ফেলার সাধ্য কারো নেই। যতবার ছেঁড়ার চেষ্টা করা হবে, ততবার ধ্বনিত হবে নির্মলেন্দু গুণের প্রমত্ত পঙ্‌ক্তি—
'শতবছরের শতসংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন। তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল, হৃদয়ে লাগিল দোলা; জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার, সকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাহার বজ্রকন্ঠ বাণী! গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি— এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম!'

আখতারুজ্জামান আজাদ

No comments

Thank you, best of luck

Theme images by sbayram. Powered by Blogger.