সামাজিক ব্যবসা কী
সামাজিক ব্যবসা হচ্ছে এমন ধরনের ব্যবসা যেখানে উদ্যোক্তা বা বিনিয়োগকারী একটি সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য ব্যক্তিগত লাভের আশা ছাড়াই বিনিয়োগ করেন। সামাজিক ব্যবসাকে নিজের আয়েই নিজের যাবতীয় ব্যয় মিটাতে হবে। এ ব্যবসাকে সম্প্রসারণ করার জন্য ব্যবসায়ের মুনাফাও পুনঃবিনিয়োগ করা হয়। সামাজিক ব্যবসা লোকসানহীন এমন প্রতিষ্ঠান যা লাভ বণ্টন না করে একটি সামাজিক সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে উত্সর্গীকৃত। ব্যক্তিগত মুনাফা অর্জন না করে স্বার্থহীন লক্ষ্যস্থির করে কেউ কি সামাজিক ব্যবসা চালু করতে আগ্রহী হবেন? সামাজিক ব্যবসায়ে বিনিয়োগের টাকাই বা কোত্থেকে আসবে? বিনিয়োগের টাকা সকল স্তরের মানুষের কাছ থেকেই আসবে যেহেতু তারা স্বার্থহীন সামাজিক ব্যবসা চালু করে মানসিক সন্তুষ্টি অর্জন করবেন। অনুদান নির্ভর কর্মসূচির একটি সমস্যা হচ্ছে, এটা সবসময় অন্য কারো সিদ্ধান্তের উপর নির্ভরশীল। এ জাতীয় প্রতিষ্ঠান নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে না। কল্যাণমূলক কাজ করতে গিয়ে অনুদান বাবদ যে টাকা খরচ হয়ে যায়, সে টাকা আর ফিরে আসে না। কারণ, টাকার ব্যবহারের ক্ষেত্রে দাতব্য কর্ম হচ্ছে একমুখী রাস্তা। কিন্তু দাতব্য কর্মসূচিকে যদি সামাজিক ব্যবসায়ে রূপান্তরিত করা যায়, তাহলে তা সামাজিক সমস্যা সমাধানের একটি শক্তিশালী কাঠামোতে পরিণত হয়। কারণ, এখানে বিনিয়োগের টাকা বার বার ব্যবহার করা যায়। অথচ অনুদানের টাকা শেষ হয়ে যায় এক দফায়। সামাজিক ব্যবসায়ের টাকা অমর। এটাই সামাজিক ব্যবসায়ের শক্তি। সমাজের সদস্যদের জীবনধারায় পরিবর্তন এনে দেয়ার আনন্দ উপভোগ করতে শুধু অনুদান খাতের টাকাই নয় বরং অনেকেই সামাজিক ব্যবসায়ে বিনিয়োগও করবেন। সামাজিক ব্যবসায়ে বিনিয়োগকারীরা শুধু টাকাই বিনিয়োগ করেন না, তাদের সৃষ্টিশীলতা, যোগাযোগের দক্ষতা, প্রযুক্তিগত মেধা, জীবনের অভিজ্ঞতাসহ অনেককিছুই বিনিয়োগ করে পৃথিবীটাকে পাল্টে দিতে। আমাদের অর্থনৈতিক তত্ত্বগুলো যদি একবার মানব প্রকৃতির বহুমুখী বাস্তবতাকে স্বীকার করে নেয়, তাহলে শিক্ষার্থীরা একদিন পড়বে ব্যবসা দু’ ধরনের হয়: এক. ব্যক্তিগত মুনাফামুখী সনাতন ব্যবসা ও দুই. সমাজকল্যাণমুখী ব্যক্তিগত মুনাফাবিহীন সামাজিক ব্যবসা। বড় হওয়ার পর তারা সিদ্ধান্ত নেবে, কোন্ ধরনের ব্যবসায় তারা বিনিয়োগ করবে। কোন্ ধরনের ব্যবসায় তারা চাকরি করবে। কেউ ব্যক্তিগত মুনাফামুখী ব্যবসায় যাবে, কেউ অধিকতর সুন্দর পৃথিবী গড়ার লক্ষ্যে সামাজিক ব্যবসায়ে জড়াবে। যারা এখনও বিদ্যালয়ের গণ্ডিতে রয়েছে, তারাও সামাজিক ব্যবসায়ের ডিজাইন নিয়ে চিন্তা শুরু করতে পারে। শুধু তাই নয়, সামাজিক ব্যবসা তারা নিজেরাই শুরু করতে পারে। সামাজিক ব্যবসার ৭টি মূলনীতি : দারিদ্র্য বিমোচনসহ এক বা একাধিক বিষয় যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি ও পরিবেশগত খাতে বিরাজমান সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিগত মুনাফাহীন কল্যাণকর ব্যবসা এটি। সকলের অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জন করাই এ ব্যবসার লক্ষ্য। সামাজিক ব্যবসায় বিনিয়োগকারীরা শুধু তাদের বিনিয়োগকৃত অর্থই ফেরত পাবে, এর বাইরে কোনো প্রকার লভ্যাংশ নিতে পারবে না। বিনিয়োগকারী তার বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত নেয়ার পর বিনিয়োগকৃত অর্থের মুনাফা কোম্পানির সম্প্রসারণ কাজে ব্যবহূত হবে। এ ব্যবসা হবে পরিবেশবান্ধব। এখানে যারা কাজ করবেন তারা ভালো কাজের পরিবেশ ও চলমান বাজার অনুযায়ী বেতন-ভাতা পাবেন। সামাজিক ব্যবসা হবে আনন্দের সাথে ব্যবসা। সামাজিক ব্যবসায় কী এবং কী নয় : পুঁজিবাদের তাত্ত্বিক কাঠামোকে সম্পূর্ণতা দিতে হলে আমাদের আরেক ধরনের ব্যবসা এই কাঠামোতে যোগ করতে হবে। ব্যবসার মধ্যে মানুষের বহুমাত্রিক প্রকৃতিকে স্বীকৃতি দিতে হবে। আমরা যদি আমাদের বর্তমান ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে “সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনকারী প্রতিষ্ঠান” বলে আখ্যায়িত করি তাহলে আমাদের আলোচ্য নতুন ধরনের ব্যবসাকে আমরা বলতে পারি “সামাজিক ব্যবসা”। উদ্যোক্তারা সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করবেন নিজের ব্যক্তিগত লাভের জন্য নয়, সুনির্দিষ্ট কিছু সামাজিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য। পুঁজিবাদের কট্টর প্রবক্তাদের কাছে এটা রীতিমতো অবমাননাকর মনে হতে পারে। মুনাফা ছাড়া ব্যবসা! এ ধারণাটা পুঁজিবাদের ধর্মতত্ত্বে নেই। তবে এই সত্যটা তারা মেনে নেবেন যে, সকল ব্যবসা কোম্পানি যদি সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনকারী ব্যবসা না-ও হয় তাতে নিশ্চয়ই মুক্তবাজার অর্থনীতির মহাভারত কিছু অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। পুঁজিবাদকে তো উন্নততর করাই যায়। বর্তমানে আমরা যে পথে এগোচ্ছি সে পথে আমরা সামাজিক সমস্যার সমাধান পাচ্ছি না। সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনকারী প্রতিষ্ঠান হতে হবে—এ বিষয়ে জেদ ধরে আর সেটাকেই কোনো এক ধরনের সিদ্ধ সত্য হিসেবে বিচার করে আমরা এমন এক ভুবন গড়েছি যা বহুমাত্রিক চরিত্রের মানবসত্তাকে অগ্রাহ্য করে। সে কারণেই সনাতন ব্যবসা আমাদের সবচেয়ে জরুরি সামাজিক সমস্যাগুলোর প্রতিকারে অক্ষম থেকে যায়। মানবমনের সত্যিকারের বহুমুখিতাকে আমাদের উপলব্ধি করা দরকার। এটা করতে হলে আমাদের প্রয়োজন নতুন ধরনের এক ব্যবসা যা ব্যক্তিগত লাভের গোলক ধাঁধা ছেড়ে অন্য লক্ষ্যে মনোনিবেশ করে। এ হবে এমন এক ব্যবসা যা সর্বাত্মকভাবে সমাজ ও পরিবেশের সমস্যার সমাধানে নিয়োজিত থাকে। গড়নের দিক থেকে নতুন এই ব্যবসা প্রচলিত মুনাফামুখী ব্যবসারই অনুরূপ কিন্তু উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের দিক থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। অন্য সব ব্যবসার মতোই এই সামাজিক ব্যবসাতেও লোক নিয়োগ করা হয়, পণ্য/সেবা তৈরি হয়, আর এসব পণ্য বা সেবা প্রদান করা হয় উদ্দেশ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ একটা মূল্যে। কিন্তু এর নেপথ্যে থাকে এর লক্ষ্য, আর বিচার্য কিছু বিষয়, যার নিরিখে সাফল্যের মূল্যায়ন করা হয়। এর লক্ষ্য হলো: এ পণ্য বা সেবা যাদের জীবনকে স্পর্শ করছে তাদের জন্য বিশেষ একটা কল্যাণ নিশ্চিত করা। এই সামাজিক ব্যবসা অবশ্যই মুনাফা করতে পারে, কিন্তু যারা এতে পুঁজি বিনিয়োগ করেন ও একে সহায়তা দেন তারা এ ব্যবসা থেকে কোনো ব্যক্তিগত মুনাফা নেন না। শুধু তারা নির্দিষ্ট সময় পরে বিনিয়োগকৃত পুঁজির সমপরিমাণ টাকা তুলে নিতে পারেন। সামাজিক ব্যবসা তাই এমন একটা কোম্পানি যা মুনাফাতাড়িত নয়, বরং মানব কল্যাণ তাড়িত, আর তার পেছনে থাকে দুনিয়া বদলানোর কাজে ভূমিকা পালনের একটা অদম্য স্পৃহা। সামাজিক ব্যবসায় কোনো দাতব্য প্রতিষ্ঠান নয়। এটা সকল দিক থেকেই ব্যবসা। সামাজিক উদ্দেশ্য হাসিল করার সাথে সাথে এ ব্যবসাকে তার সকল খরচ তুলে নিতে হয়। এক্ষেত্রে সনাতন ব্যবসার সঙ্গে মিল থাকলেও এই ব্যবসা সনাতন ব্যবসা থেকে ভিন্ন চিন্তায় চলে, কাজও চলে ভিন্নভাবে। এর সাথে দাতব্য প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্যের দিক থেকে মিল আছে, কিন্তু কাজের প্রকৃতিতে মিল নেই। আর এ তফাত্গুলোই সামাজিক ব্যবসাকে অন্য ব্যবসা থেকে এবং দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে একেবারেই আলাদা করে তোলে। আজকের দুনিয়ার বহু সংগঠন সামাজিক সুবিধা সৃষ্টিতে নিয়োজিত। তাদের বেশিরভাগই তাদের কর্মসূচি থেকে কোনো আয় করে না। মুনাফাবিহীন এবং আয়বিহীন প্রতিষ্ঠান ও এনজিওগুলো তাদের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ব্যক্তিগত বা দাতা সংস্থার দান, ফাউন্ডেশনের মঞ্জুরি, সরকারি সহায়তা ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে। কিন্তু তাদের নিজস্ব কোনো বিশেষ আয় থাকে না বলে তারা বাধ্য হয় তাদের সময় ও উদ্যমের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ অনুদানের অর্থ সংগ্রহে ব্যয় করতে। সামাজিক ব্যবসা এরকম নয়। এ ব্যবসা পরিচালিত ও সম্পাদিত হয় ঠিক মুনাফা অর্জনকারী সনাতন ব্যবসারই মতো, যেমন এর লক্ষ্য থাকে পুরো খরচটাই উঠিয়ে আনা; তবে তাদের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত থাকে এমন সব পণ্য বা সেবা সামগ্রী তৈরিতে যেগুলো মানুষের জন্য সামাজিক উপকার নিয়ে আসে। এ ব্যবসা যেসব পণ্য বা সেবাপণ্য তৈরি করে তা এমন মূল্যে বাজারজাত করে যাতে করে এর উত্পাদন ও বাজারজাতকরণের সকল ব্যয় পুষিয়ে নিতে পারে অথচ সেগুলো কোনো না কোনো সামাজিক সমস্যার সমাধান নিশ্চিত করে। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, একটা সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিক্রি করার পণ্য বা সেবাপণ্য কেমন করে সামাজিক সুবিধা দেয়? এর অসংখ্য উপায় আছে। যেমন ধরুন : একটা সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অত্যন্ত উঁচু গুণমান সম্পন্ন পুষ্টিকর খাদ্যপণ্য খুব কম দামে গরিব ও অভুক্ত শিশুদের জন্য পূর্বনির্ধারিত বাজারে বিক্রি করতে পারে। এ প্রতিষ্ঠানের পণ্য সস্তায় বিক্রি করা যায়। যেহেতু ব্যবসাকে বিলাসবাহুল্যের পণ্যবাজারে অন্য পণ্যের সাথে প্রতিযোগিতায় আসতে হয় না তাই এই পণ্যের জন্য নজরকাড়া দামি মোড়কের দরকার হয় না। ব্যয়বহুল বিজ্ঞাপনেরও দরকার হয় না। আর এই প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ মুনাফা করার বাধ্যবাধকতায়ও থাকে না। একটা সামাজিক কোম্পানি স্বাস্থ্যবীমা বাজারজাত করে তার মাধ্যমে গরিবের সাধ্যের মধ্যে চিকিত্সা সেবা প্রদান করতে পারে। একটা সামাজিক ব্যবসা নবায়নযোগ্য সৌরবিদ্যুত্ যুক্তিসঙ্গত দামে পল্লী জনপদের গ্রাহক, যাদের অন্য কোনোভাবে বিদ্যুত্ পাওয়ার উপায় নেই, তাদের কাছে বিক্রি করতে পারে। একটা সামাজিক ব্যবসা কোম্পানি আবর্জনা, পয়ঃবর্জ্য ও অন্যান্য ফেলনা দ্রব্যকে (যা অন্যথায় দরিদ্র এলাকায় কিংবা রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাহীন মহল্লায় দূষণ করে) পুনঃচক্রায়িত করার কাজে লাগাতে পারে। উল্লিখিত প্রতিটি ক্ষেত্রে বা আরও অনেক ধরনের সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব যার পণ্য বা সেবা বিক্রি করে মুনাফা হবে আর একইসাথে গরিব ও বৃহত্তর জনসমাজও উপকৃত হবে। তবে যদি সামাজিক উদ্দেশ্যতাড়িত কোনো কোনো প্রকল্প তার পণ্য বা সেবার জন্য এমন একটা দাম বা ফি ধার্য করে যার মাধ্যমে পুরো উত্পাদন খরচ উঠিয়ে আনা কখনো সম্ভব হবে না, তাহলে সেটা আর যা-ই হোক সামাজিক ব্যবসা হবে না। এ রকম প্রকল্প বা ব্যবসা তার লোকসান পোষানোর জন্য ভর্তুকি বা দানের ওপর চিরনির্ভরশীল থাকবে। ফলে তাকে দাতব্য প্রতিষ্ঠানের শ্রেণিতে ফেলতে হবে। কিন্তু একবার যদি এরকম প্রকল্প, স্থায়ীভাবে তার ব্যয় পুরোপুরি ওঠাতে সক্ষম হয় তাহলে ওটা সমাজিক ব্যবসার শ্রেণিতে উন্নীত হবে। কোনো ব্যবসায়িক উদ্যোগের পুরো খরচ উঠে যাওয়ার ঘটনাটা অর্থাত্ ব্রেক-ইভেনে পৌঁছা, এমন এক আনন্দদায়ক মুহূর্ত যা নিয়ে রীতিমতো উত্সব করা যায়। সামাজিক লক্ষ্য তাড়িত কোনো প্রকল্প একবার পরনির্ভরতার নিম্নাভিমুখী মাধ্যাকর্ষণ শক্তির টান কাটিয়ে উঠতে পারলে সেটা মহাশূন্য পাড়ি দেয়ার জন্য তৈরি হয়ে যায়। এ ধরনের প্রকল্প স্বনির্ভর, প্রবৃদ্ধি ও প্রসারের সম্ভাবনায় হয়ে উঠে সমুজ্জ্বল। সামাজিক ব্যবসার সংখ্যা ও পরিধির বৃদ্ধি মানে সামাজিক কল্যাণ ও সমৃদ্ধির বৃদ্ধি। আগেও উল্লেখ করেছি যে, সামাজিক ব্যবসার পরিকল্পনা ও পরিচালনায় সনাতন ব্যবসার সঙ্গে অনেক মিল পাওয়া যাবে। এতে পণ্য, সেবা, গ্রাহক, বাজার, খরচ ও রাজস্ব সবই আছে—নেই সর্বাধিক মুনাফা করার নীতি, যার স্থলাভিষিক্ত হয় সমাজ কল্যাণের নীতি। কোনো দাতব্য প্রতিষ্ঠান, এনজিও বা কোনো মুনাফাবিহীন এবং আয়বিহীন প্রতিষ্ঠানের সাথে সামাজিক ব্যবসার গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে আরও একটি সনাতন ব্যক্তিগত মুনাফা অর্জনকারী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মতোই। সামাজিক ব্যবসার মালিকরা তাদের বিনিয়োগের টাকা তুলে নিতে পারে এবং মালিক হিসেবে বহাল থাকতে পারে। সামাজিক ব্যবসার এক বা একাধিক মালিক থাকতে পারে। সামাজিক ব্যবসা সরকারি, বেসরকারি বা দাতব্য কিংবা সকল রকমের মিশ্র মালিকানাতেও চলতে পারে। সনাতন ব্যবসার মতোই সামাজিক ব্যবসা অনির্দিষ্টকালের জন্য লোকসান গুনতে পারে না। তবে এ ব্যবসায় কোনো মুনাফা হলে সেটা এ ব্যবসায় পুঁজি বিনিয়োগকারীদের হাতে ফিরে যায় না। পুঁজি বিনিয়োগকারী শুধু যে পরিমাণ পুঁজি বিনিয়োগ করেছেন সেটা ফেরত নিতে পারেন। এর বেশি কোনো টাকা লভ্যাংশ হিসেবে নিতে পারবেন না। সামাজিক ব্যবসায়ে যে মুনাফা হয় সেটা বিনিয়োগকারীদের হাতে তুলে না দিয়ে ব্যবসায়ে পুনঃনিয়োগ করা হয়। পরিশেষে এই মুনাফা আসলে যায় উদ্দিষ্ট উপকারভোগীদের হাতে সুলভ পণ্য, উন্নততর সেবা ও আরও সহজপ্রাপ্যতার আকারে। সামাজিক ব্যবসায়ে মুনাফা করাটা গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য কোনোভাবে ক্ষুণ্ন না করেও দুটি কারণে সামাজিক ব্যবসাকে মুনাফা করতে হবে। কারণ দুটি হলো: প্রথমত, বিনিয়োগকারীদের পুুঁজি ফিরিয়ে দিতে আর দ্বিতীয়ত, দীর্ঘমেয়াদে সামাজিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনে নিয়োজিত থাকার জন্য। একটা সনাতনী সর্বোচ্চ মুনাফামুখী ব্যবসার মতোই সামাজিক ব্যবসার জন্যও একটা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা থাকা দরকার। সামাজিক লক্ষ্য অর্জনের প্রেরণায় এবং খরচ পুষিয়ে নেবার প্রেরণায় সামাজিক ব্যবসা তার কর্মতত্পরতার দিগন্ত নানাভাবে প্রসারিত করতে পারে। এটা করা যেতে পারে নতুন ভৌগোলিক এলাকায় ব্যবসা সমপ্রসারিত করে, উত্পাদিত পণ্যসামগ্রী বা প্রদত্ত সেবার পরিসর বাড়িয়ে বা মান উন্নত করে, গবেষণা ও উন্নয়ন প্রয়াস বাড়িয়ে দিয়ে, উত্পাদন দক্ষতা বৃদ্ধি করে, নতুন নতুন প্রযুক্তি প্রবর্তন করে এবং বিপণন বা সেবা প্রদানের বেলায় উদ্ভাবনী পদ্ধতি ব্যবহার করে। এভাবে সুলভ মূল্যে পণ্য ও সেবা নিয়ে দরিদ্রতর ভোক্তাদের কাছে পৌঁছানোও সহজ হয়। অবশ্য সামাজিক ব্যবসার মূলকথা হলো, কোনোরকম লোকসান না দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করা ও একইসাথে জনসাধারণ ও গোটা পৃথিবীর সেবা করা, বিশেষ করে যারা সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত তাদের সর্বোত্তম উপায়ে সেবা করা। সামাজিক ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করলে বিনিয়োগের টাকা ফিরে পেতে কতো সময় লাগবে-এমন প্রশ্নের জবাবে বলা যায়, সামাজিক ব্যবসায়ের বিনিয়োগ প্রস্তাবপত্রে কী মেয়াদে বিনিয়োগ ফিরিয়ে দেয়া হবে তার সুনির্দিষ্ট উল্লেখ থাকতে পারে। এটা পাঁচ, দশ বা বিশ বছরও হতে পারে। সামাজিক ব্যবসায়ে বিনিয়োগের তহবিল একবার হাতে ফেরত আসার পর বিনিয়োগকারীরা ঠিক করতে পারেন এই তহবিলটা নিয়ে তারা কী করবেন। এ মূলধন হয় তারা একই সামাজিক ব্যবসায়ে আবার বিনিয়োগ করতে পারেন, নয় আরেক সামাজিক ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করতে পারেন, এমনকি হয়তো মুনাফামুখী ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে পারেন, কিংবা ঐ অর্থ তাদের ব্যক্তিগত কাজে ও উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারেন। এটা সম্পূর্ণ তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্তের ব্যাপার। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন দেখা দিতে পারে, কেন বিনিয়োগকারীরা তাদের অর্থ সামাজিক ব্যবসায়ে নিয়োজিত করবে? মোটামুটি বলতে গেলে বিষয়টা এরকম: মানুষ যে সন্তুষ্টির জন্য অর্থ বা সম্পদ দান করে সে ধরনের ব্যক্তিগত সন্তুষ্টি সামাজিক ব্যবসা থেকেও পেতে পারে। আর বলাবাহুল্য এ সন্তুষ্টি আরও অনেক বেশিই হতে পারে; কেননা যে কোনো দাতব্য কর্মে প্রদত্ত দানের টাকার মতো একবার কাজ করে এর কার্যক্ষমতা থেমে যাবে না বরং সমাজের আরও বেশি লোকের উপকারের জন্য একটা কাজ করেই চলবে। গোটা বিশ্ব জুড়ে মানুষ ফি বছর শত শত কোটি ডলার দান করে দাতব্য উদ্দেশ্যে। তারা আরও মানুষের উপকারের জন্য এমনিভাবেই অর্থ দিতে উদ্গ্রীব। তবে সামাজিক ব্যবসায়ে বিনিয়োগের সাথে এর বিশাল পার্থক্য রয়েছে। প্রথমত, সামাজিক ব্যবসায়ে কেউ একজন যে ব্যবসা গড়ে তা স্বনির্ভর। প্রতি বছর ঐ ব্যবসায়ে নতুন করে টাকা ঢালার দরকার নেই। সামাজিক ব্যবসা স্বচালিত, সে নিজেকে টিকিয়ে রাখে, নিজেই সমপ্রসারিত হয়। এ ব্যবসার পত্তন একবার হওয়ার পর নিজেই বাড়ে, আর নিয়ে আসে আরও বেশি সামাজিক উপকার। দ্বিতীয়ত, সামাজিক ব্যবসায়ে যারা বিনিয়োগ করেন তারা তাদের টাকা ফেরত পান। তারা ফেরত পাওয়া অর্থ একই অথবা ভিন্ন সামাজিক ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করতে পারেন। আর এভাবে একই মূলধনের অর্থ সমাজের জন্য আরও উপকার আনতে পারে। সামাজিক ব্যবসা এমন একটা ব্যবসা যেখানে উদ্যোক্তা তার দক্ষতা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা ব্যবহার করে ব্যবসার পাশাপাশি সামাজিক সমস্যার সমাধান করতে পারেন। এ ব্যবসায়ে বিনিয়োগকারীরা তাদের মূলধন ফিরে পাবার পরও তিনি এর মালিক থেকে যান ও এর ভবিষ্যত্ কর্মপন্থাও নির্ধারণ করেন। এ কারণে নিজ স্বকীয়তা ও সৃষ্টিশীলতা বিকাশের সুযোগ সামাজিক ব্যবসাকে আরো রোমাঞ্চকর করে তোলে।
(গতকাল প্রকাশের পর) ব্যবসায়ের ক্ষেত্র সমপ্র্রসারণ: সামাজিক ব্যবসা প্রবর্তনের পর বাজার হঠাত্ করেই যেন একটা কিছু অভিনব ও আগ্রহ উদ্দীপক বিকল্প খুঁজে পায়, ক্রমে এ ব্যবসা হয়ে উঠে আরও কৌতূহলোদ্দীপক, আকর্ষণীয় ও প্রতিযোগিতামূলক। সামাজিক ব্যবসার প্রচারণার বিষয়টি সমান মর্যাদায় বাজারে এসে যায়, অনেক ক্ষেত্রেই বিজ্ঞাপন বা প্রচারণায় অর্থব্যয় ছাড়াই। সামাজিক ব্যবসা একই বাজারে মুনাফামুখী ব্যবসার পাশাপাশি তার তত্পরতা চালাবে। অনেক সময় এ ব্যবসা সনাতন ব্যবসার সাথে প্রতিযোগিতায় নামবে, আর সনাতন মুনাফামুখী ব্যবসাকে কৌশলগতভাবে পিছু হটিয়ে দেবেও হয়তো। আর তাদের কাছ থেকে বাজারের ভাগও খসিয়ে নেবে ঠিক আর সব প্রচলিত ব্যবসার মতোই। যদি কোনো সামাজিক ব্যবসা কোনো একটি বিশেষ পণ্য বা সেবা বাজারে নিয়ে আসে যা মুনাফামুখী ব্যবসাও তৈরি ও বিক্রি করে তাহলে সেক্ষেত্রে গ্রাহক ঠিক করবে কাদের পণ্য কিনবে বা কাদের সেবা গ্রহণ করবে। যেমনটি এখন তারা বিভিন্ন প্রতিযোগী মুনাফামুখী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্য থেকে বাছাই করে থাকে। তারা বিচার-বিবেচনা করে দেখবে পণ্য বা সেবার দাম, গুণমান, সুবিধা, প্রাপ্যতা, ব্রান্ড ভাবমূর্তি ইত্যাদি চিরাচরিত বিষয় যা গ্রাহকদের পছন্দকে প্রভাবিত করে থাকে। এক্ষেত্রে একটি অতিরিক্ত বিষয় বা কারণ গ্রাহককে প্রভাবিত করবে সেটা হলো সামাজিক ব্যবসা যেসব সামাজিক উপকার নিয়ে আসে। সামাজিক ব্যবসা কোম্পানিগুলো নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করবে। কোনো ব্যবসায়ী কত বেশি দক্ষতার সঙ্গে সমাজের সমস্যার সমাধান দিতে পারে তার উপর নির্ভর করবে প্রতিযোগিতার সাফল্য। যদি একই বাজারে দুই বা ততোধিক সামাজিক ব্যবসা কোম্পানি ব্যবসা পরিচালনা করে তাহলে সেটা গ্রাহক ঠিক করবে কোন্ কোম্পানিকে তারা বেছে নেবে। এখানে আবার বেশিরভাগ গ্রাহকের জন্য প্রধান সিদ্ধান্ত নির্ধারক হবে পণ্য ও সেবার মান। তবে সামাজিক ব্যবসাসমূহের মধ্যে যে প্রতিযোগিতা হবে সেটা হবে বন্ধুত্বপূর্ণ, পরস্পরের প্রতি সম্মান দেখিয়ে, যে এগিয়ে যাবে তাকে অন্যরা বাহবা দেবে। কারণ তাদের লক্ষ্য এক—সমাজের মঙ্গল করা। এই প্রতিযোগিতা সনাতন ব্যবসার প্রতিযোগিতার মতো পরস্পর বিধ্বংসী প্রতিযোগিতা হবে না। বিনিয়োগ আকর্ষণ করার ব্যাপারেও সনাতন ব্যবস্থার মধ্যে প্রতিযোগিতা হয়। মুনাফামুখী কোম্পানিগুলো মূলধন বা বিনিয়োগ পাবার জন্য প্রতিযোগিতায় নামে। এখানে তাদের মধ্যে যে বিষয় নিয়ে প্রতিযোগিতা হয় তা হলো ভবিষ্যতে আরও বেশি মুনাফা করার সম্ভাবনা কার কত বেশি, সমপ্রসারণের সুযোগ কার কত বেশি ইত্যাদি। যদি বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী মনে করে, দুই কোম্পানির মধ্যে ‘ক’ কোম্পানি ‘খ’ কোম্পানির চেয়ে বেশি মুনাফা করতে সক্ষম তাহলে বিনিয়োগকারীর দল ‘ক’ কোম্পানির শেয়ার কিনতে ছুটবে। তারা আরও আশা করে যে, তারা কোম্পানির শেয়ার মূল্য বাড়ার কারণেও লাভবান হবে। কোম্পানির সম্পদ বাড়ার কারণে শেয়ারের মূল্যমান বেড়ে যাবে। এ বিষয়টি ইতিবাচক একটা চক্রের সূচনা করে, যার কারণে ‘ক’ কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়ে চলবে ও তাতে বিনিয়োগকারীরা খুশি হবে। এর উল্টো ঘটনা ঘটে সামাজিক ব্যবসার ক্ষেত্রে। যখন দুটি সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগকারী পেতে প্রতিযোগিতায় নামে তাদের ঐ প্রতিযোগিতা সর্বাধিক ভবিষ্যত্ মুনাফা করার ভিত্তিতে হয় না, প্রতিযোগিতা হয় কে কী পরিমাণ সামাজিক উপকার নিশ্চিত করতে পারবে তার ভিত্তিতে। প্রতিটি সামাজিক ব্যবসায় দাবি করবে যে, সমাজ ও পৃথিবীর জনসাধারণকে তারা তাদের প্রতিযোগীর চেয়ে আরও ভালো সেবা প্রদান করতে পারবে, সামাজিক সমস্যা দ্রুত ও নিশ্চিত সমাধান দিতে পারবে। আর এ ব্যবসা তাদের দাবির সপক্ষে একটা ব্যবসায় পরিকল্পনা গড়ে তুলে তার পক্ষে প্রচারণা চালাবে। সামাজিক ব্যবসায়ের বিনিয়োগকারীরা বিভিন্ন সামাজিক ব্যবসার পরিকল্পনাগুলো পুংখানুপুংখরূপে যাচাই করে দেখবে। কারণ তারা তো তাদের অর্থ বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা করেছে সমাজের উপকারের জন্য। তারা নিশ্চিত হতে চাইবে তাদের বিনিয়োগ সর্বাধিক কল্যাণ নিয়ে আসবে। যেমন মুনাফা প্রত্যাশী বিনিয়োগকারীরা আগামীতে সবচেয়ে বেশি মুনাফা প্রত্যাশা করে, প্রত্যাশা করে তাদের স্টক-শেয়ারের দামও বাড়বে, তেমনি একজন সামাজিক বিনিয়োগকারীও চাইবে তার কোম্পানি, যেটি সমাজের কোন সমস্যা সমাধানে নিয়োজিত, সেটি যেন লক্ষ্যের একেবারে কাছাকাছি পৌঁছুতে পারে। এমনিভাবে, প্রতিযোগী সামাজিক ব্যবসা তাদের দক্ষতা বাড়াতে পরস্পরের সাথে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হবে এবং আরও ভালোভাবে মানুষ ও পৃথিবীর সেবা করবে। সামাজিক ব্যবসার এটা এক বিরাট শক্তি। সামাজিক ব্যবসা মুক্তবাজার প্রতিযোগিতার সুবিধাগুলো নিয়ে আসে সামাজিক উন্নয়নের ভুবনে। সামাজিক ব্যবসায় বিনিয়োগ আকর্ষণ করার জন্য আমি একটা আলাদা স্টক এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান প্রস্তাব করছি। যে স্টক এক্সচেঞ্জ ‘সামাজিক স্টক মার্কেট’ নামে পরিচিত হবে। আর এ বাজারে তালিকাভুক্ত থাকবে কেবল সামাজিক ব্যবসার কোম্পানিগুলো। সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার কেনাবেচার জন্য এরকম একটি বাজার থাকলে তা থেকে অনেক উপকার পাওয়া যাবে। এই বাজার তারল্য তৈরি করবে, নগদায়ন সম্ভব হলে শেয়ার মালিকদের পক্ষে সামাজিক ব্যবসায়ে প্রবেশ ও প্রয়োজনে বেরিয়ে যাওয়া সহজ হবে। যেমন মুনাফামুখী ব্যবসাগুলোর বেলায় তা সম্ভব তাদের স্টক এক্সচেঞ্জ থাকার কারণে। সামাজিক স্টক এক্সচেঞ্জ এর মাধ্যমে সম্ভব হবে সামাজিক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোর জনযাচাই ও মূল্যায়ন। ফলে একটা স্বাভাবিক নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা গড়ে উঠবে সরকারি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার পরিপূরক হিসেবে এর ফলে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে, বাজারের সম্ভাব্য সমস্যা, যেমন প্রতারণা, মিথ্যা প্রতিবেদন, ফাঁপিয়ে তোলা দাবি, ছদ্ম ব্যবসা ইত্যাদি সামাল দিতে পারবে, আর এতে জনসমক্ষে সামাজিক ব্যবসা ভাবমূর্তির উন্নতি হবে। আসবে আরও অর্থ, আরও উদ্যম, বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তা, উভয় পক্ষ থেকেই। দুই ধরনের সামাজিক ব্যবসা সামাজিক ব্যবসার ধারণা বিকশিত হবার এই প্রাথমিক পর্যায়ে আমরা এ ব্যবসার সাধারণ একটা রূপরেখা মাত্র পেতে পারি। কাল পরিক্রমায় একদিন সামাজিক ব্যবসা গোটা পৃথিবী জুড়ে গড়ে উঠবে, আর সুনিশ্চিতভাবেই এ ব্যবসার বৈশিষ্ট্য ও আকার-আঙ্গিকগুলো সুসমন্বিতভাবে দাঁড়িয়ে যাবে। এখন আমি দুই ধরনের সামাজিক ব্যবসার কথা তুলে ধরছি। প্রথম ধরনের ব্যবসার কথা আমি ইতিমধ্যেই বলেছি। এ কোম্পানিগুলো তার মালিকের জন্য সর্বোচ্চ মুনাফা করার পরিবর্তে সামাজিক উপকার সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাবার ওপর মনোনিবেশ করে। এ দারিদ্র্য হ্রাস, গরিবের জন্য স্বাস্থ্য পরিচর্যা, সামাজিক ন্যায় বিচার, টেকসই প্রযুক্তি ইত্যাদিকে লক্ষ্য করে এসব ব্যবসা গড়ে উঠবে। এ ব্যবসার বিনিয়োগকারীরা আর্থিক দিক থেকে পুরস্কৃত হবার চেয়ে আত্মিক সন্তুষ্টিকে প্রাধান্য দেয়। দ্বিতীয় ধরনের ব্যবসা ভিন্ন ধরন ও শৈলীতে পরিচালিত হবে। এগুলো হবে সর্বোচ্চ মুনাফাকারী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কিন্তু এর মালিকানা থাকবে দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী। এ ধরনের ব্যবসার ক্ষেত্রে সামাজিক উপকারটি আসে এই যে এই ব্যবসার মুনাফা ও শেয়ারের মূল্যমান বৃদ্ধির সুফল সরাসরি গরিবদের হাতে যাবে আর তার ফলে গরিব মানুষের দারিদ্র্য কমে আসবে, কিংবা তারা পুরোপুরি দারিদ্র্যমুক্ত হবে। দরিদ্র মানুষকে মুনাফার সুযোগ দিয়ে দারিদ্র্যমুক্ত করাই হলো এই সামাজিক ব্যবসার লক্ষ্য। এখন দুটি সামাজিক ব্যবসার মধ্যে পার্থক্যগুলো লক্ষ্য করুন। প্রথম ধরনের সামাজিক ব্যবসার বেলায় পণ্য, সেবা বা ব্যবসার পরিচালনা পদ্ধতির প্রকৃতিই সমাজ কল্যাণ সাধন করে। এ ধরনের সামাজিক ব্যবসার গরিবদের সহায়তার জন্য তাদের জন্য যথা উপযুক্ত পণ্য দিতে পারে। এ ধরনের ব্যবসা পরিবেশকে দূষণমুক্ত করতে পারে, সামাজিক বৈষম্য কমাতে পারে, মাদকাসক্তি, পরিবারিক সহিংসতা, বেকারত্ব বা অপরাধ হ্রাস বা উপশমে কাজ করতে পারে। কোনো ব্যবসা এ ধরনের লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করার পাশাপাশি পণ্য ও সেবা বাবদ আয়ের অর্থে খরচ মেটাতে সক্ষম হলে তাকে সামাজিক ব্যবসা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যায়। এ ব্যবসা তার বিনিয়োগকারীদেরকে কোনো মুনাফা প্রদান করে না। শুধু তারা বিনিয়োগের অর্থ ফেরত পায়। দ্বিতীয় ধরনের সামাজিক ব্যবসার আওতায় যেসব পণ্য সামগ্রী বা সেবা উত্পাদিত হয় তাতে অন্য কোনো পণ্য বা সেবা থেকে আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। এ ধরনের কোম্পানি সামাজিক উপকার তৈরি করে শুধু গরিব মানুষকে ব্যবসার এবং সম্পদের মালিক বানিয়ে দিয়ে। এ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক হন গরিব ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষ (এই গরিব ও সুবিধাবঞ্চিতদের সংজ্ঞা আগে থেকেই নির্ধারণ করে দেয়া থাকবে)। কোম্পানির লাভ অভাবী মানুষের উপকারে যাবে। সামাজিক ব্যবসা ও সামাজিক উদ্যোগের (স্যোশাল ইন্টারপ্রেনিয়রশিপ) পার্থক্য অনেক লোকই সামাজিক ব্যবসার কথাটা যখন প্রথমবারের মতো শোনে তখন মনে করে ‘আমি তো এ সম্বন্ধে জানি, এটা স্যোশাল ইন্টারপ্রনিয়রশিপের আরেক নাম।’ কেননা, প্রথমবার শুনলে সামাজিক ব্যবসাকে সামাজিক উদ্যোগ বলে মনে করা হয়। আমার বন্ধু বিল ড্রেটন তাঁর অশোকা ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সামাজিক উদ্যোগের ধারণাকে পূর্ণাঙ্গতা দিয়ে একটা বিশ্ব আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। আজ ‘সামাজিক উদ্যোগ’ একটা স্বীকৃত আন্দোলন। অশোকা ফাউন্ডেশন ছাড়াও আরও কয়েকটি ফাউন্ডেশন যেমন: জেফ স্কোল (ই’বে-র প্রথম কর্মী ও সিইও) প্রতিষ্ঠিত স্কোল ফাউন্ডেশন ও ক্লাউস শোয়াব (ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম-এর প্রতিষ্ঠাতা) প্রতিষ্ঠিত শোয়াব ফাউন্ডেশন ফর স্যোশাল এন্টারপ্রেনিয়রশিপসহ অনেক ফাউন্ডেশন রয়েছে যারা সামাজিক উদ্যোগ উন্নয়নে আত্মনিবেদিত। বিশ্বের সর্বত্র সামাজিক উদ্যোক্তাদের খুঁজে বের করা, তাদেরকে সহায়তা ও উত্সাহ দেয়াই এই ফাউন্ডেশনসমূহের মিশন। ‘সামাজিক উদ্যোগ’ ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ উভয়ের মাঝেই একটা পরিচিত ধারণা হয়ে উঠেছে। আমেরিকান বিজনেস ম্যাগাজিন ‘ফাস্ট কোম্পানি’ ফি বছর ২৫ জন সেরা সামাজিক উদ্যোক্তার তালিকা প্রকাশ করে। এটা তারা করে বিশ্বের সবচেয়ে কার্যকর সমাজ সেবা সংগঠনগুলোকে মনোযোগের উজ্জ্বল প্রদীপের নিচে এনে তাদের কয়েকটিকে তহবিলের ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্য। ‘সামাজিক উদ্যোগ’ এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য বিষয়ের মর্যাদা পেয়েছে। আর এভাবে জ্ঞানচর্চার এ বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের আনুমানিক ৩০টি উচ্চতর ব্যবসায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যক্রমের তালিকাভুক্ত হয়েছে। ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুকুয়া স্কুল অব বিজনেস-এ বর্তমানে শিক্ষকতায় নিয়োজিত ড. জে গ্রেগরি ডি’স এ বিষয়ে প্রথম কোর্স চালু করেন ১৯৯৫ সালে হার্ভার্ডে। ‘সামাজিক উদ্যোক্তা’ ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে সব সমস্যার মোকাবেলায় অপরিহার্যতাবোধ থাকা দরকার সে সব সমস্যার একটা কিছু হেস্তনেস্ত করতে মানুষের মনে এ ধারণা একটা শক্তিশালী ইচ্ছাশক্তির সৃষ্টি করে। এ আন্দোলন আজ এ ধারণাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বলেই আমরা আজ পৃথিবী জুড়ে দেখতে পাই যে, একটা সুবিশাল পরিসরের বহুলোক অন্য মানুষের সাহায্য-সহায়তার জন্য দারুণ সব কাজ করে চলেছে। গ্রামীণ ব্যাংক ও তার অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রায়ই এ আন্দোলনের তাত্পর্যপূর্ণ প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। সামাজিক ব্যবসা সামাজিক উদ্যোগেরই একটা উপশাখা। যারা সামাজিক ব্যবসার পরিকল্পনা করে সামাজিক ব্যবসা পরিচালনা করে তারা সবাই সামাজিক উদ্যোক্তা। কিন্তু সব সামাজিক উদ্যোক্তা সামাজিক ব্যবসায় নিয়োজিত নয়। সামাজিকভাবে দায়িত্বশীল কোম্পানি সনাতন মুনাফামুখী ব্যবসায়ের ব্যবস্থাপকরা কোম্পানিকে সামাজিকভাবে দায়িত্বশীল রূপে তৈরি করার চেষ্টাও করেছেন। এ প্রয়াসের অন্তর্ভুক্ত হয়ে কখনও সখনও একটা মুনাফাকারী ব্যবসা মুনাফার সাথে সাথে কিছু সামাজিক সুবিধে বা সেবা প্রদান করে। কর্পোরেশনগুলো এ পদক্ষেপ কয়েকটি কারণে নিতে পারে : কোম্পানির মালিকের বা কোনো ক্ষমতাশালী কর্মকর্তার ব্যক্তিগত মূল্যবোধ কার্যকর করার জন্য কোম্পানির জন্য একটা অনুকূল প্রচারের সুবিধে লাভের জন্য, কিংবা নীতি বা ব্যবসাগত কিছু দোষ-ক্রটি থেকে থাকলে তা নিয়ে সমালোচনা এড়ানোর জন্য; যেসব গ্রাহক বা ভোক্তা লেনদেন বা কেনাকাটার ক্ষেত্রে ব্যবসার সামাজিক ভাবমূর্তিকে গুরুত্ব দেয় তাদেরকে আকর্ষণ করার জন্য; সরকারি নিয়ামক বা আইন পরিষদ সদস্য যারা কোম্পানিকে প্রভাবিত করার মতো আইন প্রণয়নের বিষয় বিবেচনা করছেন তাদের বন্ধুত্ব ও সমর্থন লাভের জন্য; যেসব সামাজিক সংগঠন বা জনস্বার্থরক্ষা গোষ্ঠী কোম্পানির সমপ্রসারণে বাধা দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধাচরণ কমানোর জন্য; নতুন বাজার, যে বাজার এখন অলাভজনক হলেও আগামীতে প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে এমন বাজারে জায়গা করে নেয়ার জন্য আর সেই সাথে সাধারণ জনগণের সমর্থন পাবার জন্য। হয়তো বিভিন্ন উদ্দেশ্যাবলির কোনো মিশ্রণ একটা বিশেষ কোম্পানিকে একটি বিশেষ সিদ্ধান্তে নিয়ে যায়। তবে কোম্পানিগুলো যেহেতু সর্বোচ্চ মুনাফাকারী ব্যবসা সেহেতু তাদের সিদ্ধান্ত হবে সেই মুনাফা বাড়ানোর জন্য সহায়ক। তাই এসব কোম্পানির কোনো সামাজিক কল্যাণের লক্ষ্য থাকতেও পারে, তার জন্য তারা কাজ ও করতে পারে কিন্তু সব কিছুই গৌণ হয়ে যায়, যদি তা ব্যবসার মূল লক্ষ্য অর্থাত্ মুনাফার সাথে সংঘাত দেখা দেয়। পরিশেষে আমি বলব আমি যেসব সাংগঠনিক কাঠামো নিয়ে আলোচনা করেছি, যেমন: সমবায়, মুনাফাবর্জিত উদ্যোগ, বা সামাজিক পর্যায়ে দায়িত্বশীল মুনাফাকারী ব্যবসা কোনোটার মাঝেই সত্যিকার সামাজিক ব্যবসার মৌলিক শক্তি নিহিত নেই। আর সে কারণেই বিশ্বজুড়ে জোরালো আবেদন রয়েছে এই নতুন ধারণা সামাজিক ব্যবসাটা পরখ করে দেখার জন্য। যখন সামাজিক ব্যবসার ধারণা সুপরিচিত হয়ে উঠবে, আর বিশ্বের সকল দেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করবে, যখন এই নতুন ব্যবসায়ের চলার পথে নতুন সৃষ্টির ঢল নামবে তখন আমাদের এ বিশ্বের নব রূপান্তরের অমিত সম্ভাবনার পথ খুলে যাবে। সামাজিক ব্যবসা কারা করবে? সামাজিক ব্যবসার ধারণা এখনও নতুন, অপরিচিত। এ ব্যবসা কে সৃষ্টি করবে, কেন করবে, এ বিষয়টা গোড়ায় কল্পনা করা বেশ শক্ত মনে হতে পারে। সকলেই সনাতন ব্যবসা উদ্যোক্তাকে জানে, চেনে। আর এসব উদ্যোক্তার সুখ্যাতি বা কুখ্যাতি যা-ই থেকে থাকুক তাদের মূল্যবোধ ও লক্ষ্য আমাদের মোটামুটি জানা। সামাজিক ব্যবসার প্রতিষ্ঠাতাদের বেলায়ও এক সময় এই একই কথা একদিন প্রযোজ্য হবে কিন্তু এখন সে পরিচিতি নেই। আমার ধারণা, সুযোগ পেলে প্রতিটি মানুষই সামাজিক ব্যবসায়ের সম্ভাবনাময় অংশীদার হতে এগিয়ে আসবে। সামাজিক ব্যবসায়ের জন্য প্রেরণার উত্স প্রতিটি মানুষের অন্তরে নিহিত রয়েছে। আমরা নিত্য মানুষের এ অন্তর্নিহিত প্রেরণার স্ফুলিঙ্গ প্রত্যক্ষ করি। মানুষ তাদের পৃথিবীর ব্যাপারে যত্নবান, তাদের পরস্পরের প্রতিও। মানুষের মাঝে পরোপকারের একটা সহজাত প্রেরণা রয়েছে। তারা তাদের নিকটজনের জীবনের উন্নয়ন কামনা করে। আর যদি সুযোগ হয় তারা চায় এমন একটা পৃথিবীতে বসবাস করতে যেখানে অভাব, রোগ-ব্যাধি, ও অকারণ দুঃখ-দুর্দশা নেই। এ কারণেই মানুষ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে শত শত কোটি টাকা দান করে দাতব্য কর্মসূচিতে ও সমাজ সেবার উদ্যোগে। তারা এমনকি তুলনামূলকভাবে কম পারিশ্রমিক পেলেও সমাজসেবা খাতে ক্যারিয়ার গড়ায় নিজের জীবন উত্সর্গ করে। আর এই একই প্রেরণা বহু লোককেই সামাজিক ব্যবসায়ে নিয়ে আসবে যখন এই নতুন পথ সুপরিচিত হয়ে উঠবে, মানুষ একে ভালো করে উপলব্ধি করবে। ভবিষ্যতের সামাজিক ব্যবসার সৃষ্টি যেসব সুনির্দিষ্ট উত্স থেকে হতে পারে তার প্রারম্ভিক কয়েকটির বর্ণনাঃ সকল আকার ও আয়তনের কোম্পানি তাদের নিজস্ব সামাজিক ব্যবসা শুরু করতে চাইবে। অনেকে তাদের বর্তমান ‘সামাজিক দায়িত্বশীলতা’ (সি.এস.আর) কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে মুনাফার একটা অংশ সামাজিক ব্যবসায় বিনিয়োগ করবে। অন্যেরা সমাজের বঞ্চিতদের সাহায্য করার পাশাপাশি নতুন বাজারের সন্ধানে সামাজিক ব্যবসা সৃষ্টি করবে। তারা অন্যান্য কোম্পানি বা সামাজিক ব্যবসায় উদ্যোক্তাদের সহায়তায় ও তাদের সাথে অংশীদারিত্বে নিজেরাই সামাজিক ব্যবসা তৈরি করবে। ফাউন্ডেশনগুলো সামাজিক ব্যবসায়ের জন্য পৃথক বিনিয়োগ তহবিল গড়ে তুলবে। ফাউন্ডেশনগুলো সাধারণত সনাতন দাতব্য কর্মক্ষেত্রে তাদের অর্থদান করে থাকে। তবে তার পাশাপাশি ফাউন্ডেশনগুলো সামাজিক ব্যবসা তহবিল গঠন করতে পারে। সামাজিক ব্যবসা তহবিলের সুবিধে হলো এই যে এ তহবিলের অর্থ কখনও শেষ হবে না, একই সঙ্গে তহবিলের টাকায় সামাজিক উপকার পাওয়া অব্যাহত থাকবে। ফাউন্ডেশনের সামর্থ্য সমপ্রসারণের জন্য এই তহবিলের অর্থ কাজে লাগানো যাবে। বিশ্বব্যাংক এবং আঞ্চলিক উন্নয়ন ব্যাংকগুলোসহ আন্তর্জাতিক ও দ্বিপক্ষীয় দাতারা আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক বা প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে গৃহীত সামাজিক ব্যবসা উদ্যোগগুলোকে সহায়তা দেয়ার জন্য সামাজিক ব্যবসা তহবিল গঠন করতে পারে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংক এবং আঞ্চলিক উন্নয়ন ব্যাংকগুলো সামাজিক ব্যবসাকে সহায়তা করার জন্য নিজ নিজ অঙ্গ প্রতিষ্ঠান বা সাবসিডিয়ারী গঠন করতে পারে, যেমন: স্যোশাল বিজনেস ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক, ইত্যাদি। সামাজিক ব্যবসাকে সহায়তা ও এ ব্যবসাকে উত্সাহিত করার জন্য বিভিন্ন দেশের সরকার এবং স্থানীয় সরকার সামাজিক ব্যবসা উন্নয়ন তহবিল গঠন করতে পারে। সনাতন ব্যবসা এবং সামাজিক ব্যবসা- এ দুই বিকল্প পথের মধ্যে কোনটাকে ব্যক্তিবিশেষ, কোম্পানি ও বিনিয়োগকারীরা বেছে নেবে? বলা বাহুল্য, শুরুতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মুনাফামুখী ব্যবসা এবং সামাজিক ব্যবসা-দুটোতেই অংশ নেবার আগ্রহ থাকবে। তাদেরকে কোনো একটাকে ছেড়ে শুধু একটাকে বেছে নিতে হবে এমন বাধ্যবাধকতায় পড়তে হবে না। তবে মুনাফামুখী ব্যবসা আর সামাজিক ব্যবসার মধ্যে ব্যক্তিবিশেষের লক্ষ্যের বিচার-বিবেচনায় বিভিন্ন অনুপাতে বিনিয়োগ হতে পারে। যেমনঃ কোনো ব্যক্তিবিশেষের কিছু মূলধন থাকলে সে তার একটা অংশ ব্যক্তিগত মুনাফাকারী ব্যবসায় ও অবশিষ্টাংশ সামাজিক ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে পারে। ব্যক্তিগত মুনাফাকারী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক বোর্ড তাদের বছরের মুনাফার অংশবিশেষ আরেকটি মুনাফামুখী কোম্পানি কেনায় বিনিয়োগ করতে পারে যার উদ্দেশ্য হবে নতুন বাজারে তাদের ব্যবসা সমপ্রসারণ, আর বাকি অংশ একটা সামাজিক ব্যবসা শুরু করার জন্য কিংবা কোনো একটা চলমান সামাজিক ব্যবসার উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে পারে। ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিষদ তাদের অর্থের একটি অংশ এক বা একাধিক সামাজিক ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে যেসব সামাজিক ব্যবসার লক্ষ্য আর ফাউন্ডেশনে যারা দান করে তাদের লক্ষ্য অভিন্ন। কিংবা ফাউন্ডেশন সামাজিক ব্যবসা তহবিলে বিনিয়োগ করতে পারে। এমনকি, সারাজীবনের জন্য পেশা হিসেবে বেছে নেবার ব্যাপার হলে সামাজিক ব্যবসা এমন সব সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে যেগুলো আমাদের কাছে উপভোগ্য হবে। একই ব্যক্তি তার জীবনের একটা অংশ ব্যক্তিগত মুনাফাকারী ব্যবসায় কাজ করার জন্য ব্যয় করতে পারে; আরেক অংশ ব্যয় করতে পারে সনাতন দাতব্য, ফাউন্ডেশন বা এনজিওকর্মে অথবা সামাজিক ব্যবসায়। এই তিন রকমের কাজ ভিন্ন ভিন্ন সময়ে যেমন করতে পারে, তেমনি একই সঙ্গেও করতে পারে। এ বিষয়ে সিদ্ধান্তের ব্যাপারটা নির্ভর করবে ঐ ব্যক্তির পেশা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত বিশেষ আগ্রহ, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও নিজের সামাজিক ভাবনার ওপর, যা সময়ের সাথে সাথে বিবর্তিত হতে পারে। তাই সামাজিক ব্যবসা কে বা কারা করবে, কখন করবে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হবার কোনো কারণই নেই। বিনিয়োগের ক্ষেত্র বেছে নেবার বেলায়, যেমন জীবনের জন্য সিদ্ধান্ত নেবার বেলায়ও, মানুষ সিদ্ধান্ত নেবে যা তাকে সর্বোচ্চ সিষ্ট দেয়। আমরা মানুষেরা বহুমাত্রিক জীব। আর তাই আমাদের ব্যবসার কাঠামোকেও সমান বৈচিত্র্যময় হতে হবে। নতুন ধরনের ব্যবসা হিসেবে সামাজিক ব্যবসাকে পরিচিত ও উত্সাহিত করা হলে অচিরেই সংখ্যায় ও সম্ভাবনায় এটি প্রচলিত ব্যবসার সমকক্ষ হয়ে উঠবে।
(সমাপ্ত)
লেখক: নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক
No comments
Thank you, best of luck