ads

প্রবন্ধ ।। পল্লিসাহিত্য ।। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ।। অনুধাবনমূলক প্রশ্ন ।।




১. ‘এগুলো সরস প্রাণের জীবন্ত উৎস’ বলতে লেখক কী বোঝাতে চেয়েছেন?

উত্তর: ‘এগুলো সরস প্রাণের জীবন্ত উৎস’ বলতে লেখক শিশুমনে আনন্দদানের ঘুমপাড়ানি গান ও ছড়াগুলোকে বুঝিয়েছেন। 
আমাদের পল্লি গ্রামগুলো সাহিত্যসম্পদে ভরপুর পল্লির প্রকৃতি ও পল্লির মানুষের সমাজজীবনের নানা আচরণ পল্লিসাহিত্যের উপাদান। পল্লিসাহিত্যের অমূল্য সম্পদের মধ্যে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে প্রবাদবাক্য, ডাক ও খনার বচন। এ ছাড়া আছে মানুষের সেই ঘুমপাড়ানির গান এবং খোকাখুকির ছড়া। এগুলো শিশুমনকে প্রাণবন্ত করে তোলে। তাই লেখক এগুলোকে সরস প্রাণের জীবন্ত উৎস বলেছেন।

২. পল্লিসাহিত্যে হিন্দু-মুসলমান ভেদ নেই কেন? 

উত্তর: পল্লিসাহিত্যের উপাদানগুলো গোষ্ঠী বা ব্যক্তি বিশেষের সৃষ্ট নয়, বরং এগুলো জাতীয় সম্পদ। পল্লিসাহিত্যে হিন্দু-মুসলমান কোনো ভেদ নেই। কারণ হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে ধর্মের পার্থক্য রয়েছে, কিন্তু পল্লিসাহিত্যে ধর্ম প্রাধান্য পায়নি। পল্লিসাহিত্যে প্রাধান্য পেয়েছে মানুষের জীবনযাপনের পদ্ধতি ও ইতিহাস।
পল্লিসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর সর্বজনীনতা, জাতি-ধর্ম বলে কোনো ভেদজ্ঞান পল্লিসাহিত্যে স্বীকৃত নয়। তাই বলা যায়, যেরূপ মাতৃস্তন্যে সন্তান মাত্রেরই অধিকার, সেরূপ এই পল্লিসাহিত্যে পল্লিজননীর হিন্দু-মুসলমান সব সন্তানেরই সমান অধিকার।

৩. প্রাবন্ধিক পল্লিসাহিত্যকে বিশ্বকোষ অপেক্ষা বড় বলেছে কেন?

উত্তর : পল্লি বাংলায় ছড়িয়ে থাকা সাহিত্য উপকরণ সম্পর্কে ধারণা দিতে গিয়ে প্রাবন্ধিক পল্লিসাহিত্যকে বিশ্বকোষ অপেক্ষা বড় বলেছেন। গ্রামবাংলার ছড়া, ঘুমপাড়ানি গান, প্রবাদ, ডাক ও খনার বচন, রূপকথা প্রভৃতি বাংলা সাহিত্যের আদি উপাদান পল্লিতেই বিদ্যমান।
এ ছাড়া পল্লির ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, রাখালি, মারফতি, মুর্শিদি আর জারিগান সাহিত্যের অনন্য উপকরণ। পল্লির প্রত্যেক পরতে পরতে লুকিয়ে আছে নানা সাহিত্য। সমগ্র বাংলাদেশের উপকথাগুলো সংগ্রহ করা হলে বিশ্বকোষের মতো কয়েকটি বালাম অর্থাৎ ভলিউম বা খণ্ডেও তার সংকুলান হতো না বলে লেখক অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

৪. ‘এগুলো নৃতত্ত্বের মূল্যবান উপকরণ বলে পণ্ডিতসমাজে গৃহীত হয়’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে?

উত্তর: নৃতত্ত্ববিজ্ঞানের কাছে ‘পল্লিসাহিত্য’ অতি মূল্যবান উপকরণ। নৃতত্ত্ববিজ্ঞানের মূল কাজ মানুষের উৎপত্তি ও বিকাশ নিয়ে বিশ্লেষণ করা। আমাদের পল্লিসাহিত্যের মাঝে লুকিয়ে আছে আমাদের নৃতাত্ত্বিক বিকাশের ইতিহাস। এই পল্লিসাহিত্য বিশ্লেষণ ও অন্য দেশের পল্লিসাহিত্যের সাথে তুলনামূলক আলোচনার মধ্য দিয়ে নৃতাত্ত্বিক পণ্ডিতরা পেয়ে যান নানা তথ্য-উপাত্ত। তাই পল্লিসাহিত্য নৃতত্ত্ব পণ্ডিতদের নিকট অতি মূল্যবান উপকরণ।

৫. ‘পল্লি গ্রামে শহরের মতো গায়ক, বাদক, নর্তক না থাকলেও তার অভাব নেই’—বুঝিয়ে লেখো।

উত্তর: পল্লি গ্রামে শহরের মতো গায়ক, বাদক, নর্তক না থাকলেও রয়েছে পল্লিপ্রকৃতির বিচিত্র উপকরণ। পল্লি গ্রামে শহরের মতো গায়ক, বাদক, নর্তক নেই। কিন্তু পল্লিপ্রকৃতির চারপাশজুড়ে রয়েছে কোকিল, পাপিয়া, দোয়েলের শ্রুতিমধুর ধ্বনি, নদীর কুলকুল শব্দ, পাতার মর্মর ধ্বনি, যা শহরের সব আনন্দ উপকরণের অভাব পূরণ করে দেয়। তা ছাড়া পল্লির মাঠে-ঘাটে, আলো-বাতাসে, পল্লির প্রতিটি আনাচকানাচে ছড়িয়ে রয়েছে পল্লির মূল্যবান সাহিত্যসম্পদ। এ জন্য প্রাবন্ধিক বলেছেন পল্লি গ্রামে শহরের মতো গায়ক, বাদক, নর্তক না থাকলেও তার অভাব নেই।

৬. পল্লিসাহিত্যকে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন কেন? ব্যাখ্যা করো।

উত্তর : পল্লিসাহিত্যের সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতির শিকড় জড়িয়ে আছে। তাই পল্লিসাহিত্যকে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। 
‘পল্লিসাহিত্য’ আমাদের ঐতিহ্য। আমরা বাঙালি সেই পরিচয়ের শিকড় প্রোথিত আছে পল্লিসাহিত্যে। আমাদের সুখ-দুঃখ, প্রেম-আনন্দ, আবেগ-অনুভূতি সম্পর্কিত এই পল্লিসাহিত্যকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য এগুলো সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।



৭. ‘নচেৎ এ সকল কেবলি ভুয়া, কেবলি ফক্কিকার।’ বলতে লেখক কী বুঝিয়েছেন।

উত্তর : নচেৎ এ সকল কেবলি ভুয়া, কেবলি ফক্কিকার বলতে বোঝানো হয়েছে পল্লিসাহিত্যের দিকে পল্লিজননীর সন্তানরা মনোযোগ না দিলে পল্লিসাহিত্য সভার আয়োজন ভুয়া ও ফাঁকিবাজি বলে গণ্য হবে। 
পল্লিসাহিত্য সভার আয়োজন করলে সেখানে পল্লিজননীর সন্তানদের অবশ্যই মনোযোগ থাকতে হবে। পল্লিসাহিত্য সভায় পল্লিজননীর সন্তানদের মনোযোগই যদি না থাকে, তবে তো ফাঁকিবাজি হবে।

৮.‘নচেৎ এ সকল কেবলি ভুয়া, কেবলি ফক্কিকার’—লেখক এ কথা কেন বলেছেন?

উত্তর : পল্লিসাহিত্য সভার সার্থকতার জন্য পল্লিজননীর সন্তানদের মনোযোগ লাগবে, নচেৎ এ সকল কেবলি ভুয়া, কেবলি ফক্কিকার। অর্থাৎ বলা হয়েছে, পল্লিজননীর সন্তানরা যদি মনোযোগ না দেয়, তবে পল্লিসাহিত্য সভা কেবলি ভুয়া এবং ফক্কিকার বলে গণ্য হবে।

৯. আধুনিক শিক্ষার কর্মনাশা স্রোত বলতে কী বোঝানো হয়েছে?

উত্তর: আধুনিক শিক্ষার কর্মনাশা স্রোত বলতে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার শিকড়চ্যুত পরিস্থিতির দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। 
আধুনিক শিক্ষা ও জীবন অনেক বেশি পাশ্চাত্যমুখী। আধুনিক মানুষ যেমন ক্রমাগত শিকড়চ্যুত হয়ে পড়েছে, তেমনি আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় বড় গলদ রয়ে গেছে। আমাদের লোকজ জীবন, সংস্কৃতি অনেকটাই এই শিক্ষাব্যবস্থায় অনুপস্থিত। ফলে পল্লিসাহিত্য বর্তমান প্রজন্মের কাছে অনেকটাই অধরা। তাই লেখক আধুনিক শিক্ষার কর্মনাশা স্রোত হিসেবে শিক্ষাব্যবস্থায় ত্রুটির দিকটি উপস্থাপন করেছেন।

১০. ‘এবার ফিরাও মোরে’ কবিসম্রাটের এ বক্তব্যের মর্মার্থ লেখো।

উত্তর: ‘এবার ফিরাও মোরে’ কবিসম্রাটের এ বক্তব্যের মর্মার্থ মূলত পল্লিসাহিত্যের কাছে ফিরে যাওয়ার আকুলতা। 
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাগরিক সাহিত্য নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। পল্লিসাহিত্যের মাহাত্ম্য তিনি উপলব্ধি যে করেননি তা নয়। কিন্তু পল্লির জীবন ও পরিবেশ চিত্রণে তাঁর কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল, যা তিনি নিজেই উপলব্ধি করেছিলেন। পল্লিসাহিত্যের প্রতি তাঁর এক ধরনের আকর্ষণ ছিল। কিন্তু পল্লির মাঝি, জেলে, কামার, কুমোরদের নিয়ে সাহিত্য রচনার জন্য যে অভিজ্ঞতা থাকা দরকার, শ্রেণিগত কারণে তা তাঁর ছিল না। ফলে যদিও তিনি বলেছেন, ‘এবার ফিরাও মোরে।’ কিন্তু পল্লিসাহিত্যের কাছে তিনি প্রকৃতপক্ষে ফিরতে পারেননি।

১১. পল্লির কোন সাহিত্যকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সরস প্রাণের জীবন্ত উৎস বলেছেন? কেন?

উত্তর : পল্লির মায়ের ঘুমপাড়ানি গান এবং খোকাখুকির ছড়া গানকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সরস প্রাণের জীবন্ত উৎস বলেছেন। ‘পল্লিসাহিত্য’ প্রবন্ধের মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বাংলাদেশের বিশাল পল্লিসাহিত্যের নানা দিকের কথা উল্লেখ করেছেন। পল্লির এসব সাহিত্যের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ছড়া গান ও ঘুমপাড়ানি গান। প্রাবন্ধিক বর্তমানে এসব সাহিত্যের অভাব বোধ করে এগুলোর গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। গুরুত্বের বিবেচনা করতে গিয়েই তিনি এসব সাহিত্যকে সরল প্রাণের জীবন্ত উৎস বলেছেন।

১২. ‘আজ দুঃখে দৈন্যে প্রাণে সুখ নেই।’ কেন? বুঝিয়ে লেখো।

উত্তর : গ্রামীণ জীবনের দুর্দশা ও অবক্ষয়ে আজ সেখানে দুঃখে-দৈন্যে প্রাণে সুখ নেই। শহরের যান্ত্রিকতায় মানুষ অভ্যস্ত হয়ে গ্রাম ভুলে গেছে। গ্রামে আগের মতো সুখ নেই, শান্তি নেই। যেভাবে শহরের মানুষের উন্নতি হচ্ছে সেভাবে পল্লি গ্রামের উন্নতি না হওয়ায় সেখানে অভাব-অনটন ও দুঃখ-দুর্দশা লেগেই আছে। তাই আজ গ্রামীণ জীবনে মানুষের প্রাণে সুখ নেই বলে এখন আর মায়ের সন্তানদের ঘুমপাড়ানি গান শোনায় না।

১৩. পল্লির প্রত্যেক পরতে পরতে সাহিত্য ছড়িয়ে আছে—বুঝিয়ে লেখো।

উত্তর : পল্লির প্রত্যেক পরতে পরতে সাহিত্য ছড়িয়ে আছে বলতে পল্লির আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সাহিত্যকে বোঝানো হয়েছে। আমাদের দেশের গ্রামগুলো পল্লিসাহিত্যের প্রধান উৎস। পল্লির মাঠ-ঘাট, আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পল্লিসাহিত্য। আমরা যেমন বাতাসের মাঝে বাস করে ভুলে যাই বাতাসের কথা, ঠিক তেমনি পল্লিসাহিত্যের অফুরন্ত ভাণ্ডারের মধ্যে থেকে ভুলে যাই যে আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পল্লিসাহিত্য।

১৪. ‘পল্লির প্রত্যেক পরতে পরতে সাহিত্য ছড়িয়ে আছে’—বলতে কী বোঝানো হয়েছে?

উত্তর : পল্লির প্রত্যেকটি আনাচে-কানাচে যে সাহিত্যের উপাদান ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এ কথাই বোঝানো হয়েছে আলোচ্য উক্তিটি দ্বারা। পল্লিসাহিত্যের উৎস আমাদের গ্রামগুলোতে। এখানে গ্রামীণ মানুষের মুখে মুখে নানা রকম সাহিত্যের সৃষ্টি হয়। যেমন—ছড়া, প্রবাদ, রূপকথা, উপকথা, গীতিকা ইত্যাদি। সাহিত্যের এই বিরাট অংশ পল্লিজননীর বুকের কোণে লুকিয়ে আছে। পল্লির প্রত্যেকটি জায়গায় যে এই পল্লিসাহিত্য ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এ কথা বোঝানোর জন্যই প্রাবন্ধিক প্রশ্নোক্ত উক্তিটি রচনা করেন।

১৫. প্রাবন্ধিক কোনগুলোকে এবং কেন ‘সরস প্রাণের জীবন্ত উৎস’ বলেছেন।

উত্তর : প্রাবন্ধিক পল্লিসাহিত্যের ছড়া এবং ঘুমপাড়ানি গানগুলোকে ‘সরস প্রাণের জীবন্ত উৎস’ বলেছেন। যার প্রাণ আছে সেই জীবন্ত। আর জীবন্ত জিনিস হলো পরিবর্তনীয়। তেমনিভাবে ঘুমপাড়ানি গান এবং ছড়া মানুষের মুখে মুখে রচিত হয় এবং বিভিন্ন সময়ে ও বিভিন্ন স্থানে মানুষের মুখে মুখে তার অনেকটা পরিবর্তনও হয়। এ জন্য এগুলো সাহিত্যের জীবন্ত উৎস। তা ছাড়া ঘুমপাড়ানি গান এবং ছড়ায় রয়েছে অন্তর্নিহিত সজীবতা এবং স্বতঃস্ফূর্ত প্রেরণা। এ জন্যই ঘুমপাড়ানি গান এবং ছড়াকে প্রাবন্ধিক ‘সরস প্রাণের জীবন্ত উৎস’ বলে অভিহিত করেছেন।



1 comment:

Thank you, best of luck

Theme images by sbayram. Powered by Blogger.