ads

পেট্রো ডলার কী, তেলের সাথে এই ডলারের সম্পর্ক কী?


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায়নের গুরুত্বপূর্ণ একটি উৎস হচ্ছে পেট্রো ডলার ব্যবস্থা। পেট্রো ডলার শব্দটি প্রকৃতপক্ষে পেট্রোলিয়াম ডলার এর সংক্ষিপ্ত রূপ। তেল, গ্যাস, প্লাস্টিক, রাবার থেকে শুরু করে অসংখ্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের কাঁচামাল হচ্ছে পেট্রোলিয়াম বা খনিজ তেল যা ভূমি থেকে সরাসরি উত্তোলন করা হয়। ১৯৭৩ সালে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন সৌদি আরবকে তাদের সকল পেট্রোলিয়াম পণ্য অর্থাৎ শোধিত তেল, খনিজ তেল ও গ্যাস একমাত্র মার্কিন ডলারে বিক্রি করার প্রস্তাব দেয়। এর বিনিময়ে মার্কিন সেনাবাহিনী সৌদি আরবকে পূর্ণ সামরিক নিরাপত্তা প্রদান করবে এবং শিক্ষা ও প্রযুক্তিগত সহায়তা করবে। চুক্তিতে স্বাক্ষর না করা ছিল এর বিরোধিতার সামিল। সেই সময় প্রথমে সৌদি আরব এবং পরবর্তীতে অন্যান্য তেল সম্বৃদ্ধ উপসাগরীয় দেশ সমূহ চুক্তিটি স্বাক্ষর করে এবং এর মধ্যে দিয়ে পেট্রো ডলারের যাত্রা শুরু হয়।
চুক্তিটি তৎকালীন বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ১৯৭১ সালে রিচার্ড নিক্সন স্বর্ণভিত্তিক মুদ্রা ব্যবস্থা বাতিল ঘোষণা করার ফলে ডলারের বিপরীতে স্বর্ণের মজুদ ব্যবস্থার ইতি ঘটে, অর্থাৎ ডলার কেবল একটি কাগুজে নোট বা ফিয়াট কারেন্সি তে পরিণত হয়। তার আগ পর্যন্ত ডলারের বিপরীতে স্বর্ণ মজুদ থাকতো। এরই প্রেক্ষিতে ডলারের মুল্যমান ও ক্রমাগত চাহিদা বজায় রাখতে স্বর্ণের বিকল্প হিসেবে কালো স্বর্ণ বা খনিজ তেলকে সামনে আনা হয়। তেল সম্বৃদ্ধ দেশসমূহ একমাত্র মার্কিন ডলারে তেল বিক্রয় করায় সকল রাষ্ট্রকেই জ্বালানি সরবরাহ আমদানি করার জন্য ডলার অর্জন করতে হবে। আর যেহেতু সকল রাষ্ট্রকেই জ্বালানি ক্রয় করতে হয় সেহেতু আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের ক্রমাগত চাহিদা বিদ্যমান থাকবে। দ্বিতীয়ত, এই চুক্তির ফলে তেল সম্বৃদ্ধ রাষ্ট্রসমূহ ডলারের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জ্বলানী সরবরাহও নিরাপদ থাকবে।

তেলের দাম ডলারে নির্ধারণ করার অন্যতম প্রধান একটি প্রধান সমস্যা হচ্ছে তেলের মুল্য আমেরিকার মুদ্রা নীতির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। যখন দেশীয় মুদ্রার বিপরীতে ডলার শক্তিশালী হয়ে যায় তখন তেল আমদানিকারক দেশ সমূহকে বেশি মুল্য পরিশোধ করতে হয়, অপর দিকে রপ্তানিকারক দেশসমূহ লাভবান হয়। আর যখন ডলারের মুল্যমান কমে যায় তখন আমদানিকারক দেশগুলো লাভবান হয় এবং রপ্তানিকারক দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই কারণে তেল, গ্যাস এর উপর নির্ভরশীল দেশ সমূহ অর্থনৈতিক ঝুঁকি এড়াতে সব সময় আমেরিকার সাথে তাদের মুদ্রানীতির সামঞ্জস্য রেখে চলে। শুধু মুদ্রানীতি নয়, তেল সম্বৃদ্ধ দেশ সমুহের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড আমেরিকার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।

উদাহরণ স্বরূপ বলা যাক কাতার আমেরিকার কাছে তেল বিক্রয়ে অসম্মতি জানাল। আমেরিকা তার বিনিময়ে কাতারের ডলার ভিত্তিক লেনদেনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করল। ফলশ্রুতিতে কাতার পৃথিবীর কোনো দেশের কাছে তেল, গ্যাস বিক্রি করতে পারবে না। এই কারণে তেল সম্বৃদ্ধ দেশসমূহকে সর্বদা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতে হয়। যুক্তরাষ্ট্র যেকোনো তেল নির্ভর দেশের অর্থনীতি এক মুহূর্তে পঙ্গু করে দিতে পারে। এর উজ্জ্বল একটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে ইরান। বাস্তবিক অর্থে এই দেশসমূহ কেবল অর্থনৈতিক সুসম্পর্ক নয় বরং রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও সুসম্পর্ক রক্ষা করে চলে। এক কথায় পেট্রো ডলার ব্যবস্থা মার্কিন ডলারকে সমগ্র বিশ্বে শক্তিশালী করে তুলেছে এবং তেল সম্বৃদ্ধ দেশসমূহকে আমেরিকার উপর নির্ভরশীল করে তুলেছে।
পেট্রোডলার বলয় ভাঙ্গার প্রচেষ্টা দীর্ঘ এবং রক্তাক্ত। ইরাকের সাদ্দাম হোসেন তেল রপ্তানিতে স্বর্ণভিত্তিক মুদ্রাব্যবস্থা চালু করতে চেয়েছিল। ২০০৩ সালে মার্কিন মিত্র বাহিনী ইরাক আক্রমণ করে এবং সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করে। তেল সম্বৃদ্ধ দেশ লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফিও স্বর্ণভিত্তিক মুদ্রাব্যবস্থা চালু করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে ২০১১ সালে তাকে ক্ষমতাচ্যুত ও হত্যা করা হয়। ইরাক এবং লিবিয়া উভয়ই বর্তমানে ডলারে তেল রপ্তানি করছে। ২০১৩ সালের সেপ্তেম্বর থেকে চীন আমেরিকাকে টপকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ তেল আমদানিকারক রাষ্ট্রে পরিণত হয়। এর পর থেকেই পেট্রো ইউয়ান উদ্ভোদনের সাড়া আসতে থাকে। এরই প্রেক্ষিতে চীন ২০১৮ সালে স্বর্ণভিত্তিক পেট্রোইউয়ান চালুর ঘোষণা দেয়। সেই বছরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের সাথে বানিজ্য যুদ্ধ শুরু করে। এই সকল ঘটনা সমূহকে একেবারে বিচ্ছিন্ন বলা যায় না। 
স্বর্ণের পাশাপাশি কাগুজে মুদ্রা ব্যাবহার করে পেট্রো ডলার ব্যবস্থা থেকে বের হবার প্রচেষ্টাও বিদ্যমান আছে। রাশিয়া ইতোমধ্যে ইওরোপ এর সাথে ইওরোতে এবং চীনের সাথে ইউয়ানে গ্যাস রপ্তানি করছে। রাশিয়ার সমান্তরালে চীনও একই প্রচেষ্টা অব্যহত রাখছে। ইতোমধ্যেই চীন ইরানের সাথে বাণিজ্যে রিয়াল ও ইউয়ান ব্যাবহারে সম্মত হয়েছে। 
ক্রিপ্টোকারেন্সি বা ডিজিটাল মুদ্রা ব্যবহার করে বের হয়ে আসার চেষ্টা করছে ভেনেজুয়েলা। তারা মুদ্রার বিপরীতে তেলের মজুদ সঞ্ছয় করে নতুন ক্রিপ্টো মুদ্রা উদ্ভাবন করেছে যার নাম পেট্রো। চীন ক্রিপ্টো মুদ্রা ব্যবস্থাকে আরও বড়ো পর্যায়ে নিয়ে আন্তর্জাতিক বানিজ্য, এমনকি অভ্যন্তরীণ লেনেদেনে ব্যাবহারের পাইলট প্রকল্প সম্পন্ন করেছে। তাছাড়া সম্প্রতি চীন সরকার ক্রিপ্টো মুদ্রার বিপরীতে স্বর্ণের মজুদ রাখার ব্যাপারেও ইঙ্গিত দিয়েছে।



এত প্রচেষ্টার পরেও এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক তেল বাণিজ্যের প্রায় সম্পূর্ণটাই ডলারে হচ্ছে। পেট্রো ডলার ব্যবস্থা থেকে বের হবার একটি সমস্যা হচ্ছে ডলার অপেক্ষা উত্তম কাগুজে মুদ্রার অভাব। ক্রিপ্টো মুদ্রা বা স্বর্ণ হতে পারে উত্তম বিকল্প মাধ্যম। কিন্তু অনেক সম্ভাবনা থাকা স্বত্বেও তেল বাণিজ্যে এদের ব্যাবহার অপ্রতুল। তার কারণ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের শক্ত অবস্থান এবং সচেতনতার অভাব। তবে প্রয়োজন হচ্ছে পরিবর্তনের প্রসূতি। বর্তমানে ইরান, ভেনেজুয়েলা, রাশিয়া ও চীনের উপর ডলার ভিত্তিক বিভিন্ন মাত্রার নিষেধাজ্ঞা জারি করায় এই দেশগুলো বিকল্প মুদ্রার প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে সতর্ক হয়ে উঠেছে। বিশেষত তেল সম্বৃদ্ধ ইরান এবং ভেনেজুয়েলার জন্যে পেট্রো ডলার থেকে বের হয়ে আসা সময়ের দাবি। রাশিয়া ও চীন প্রশাসনও এই প্রয়োজন গভীর ভাবে অনুধাবন করছে। খুব ধীরে ধীরে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে কবে ডলারের একক আধিপত্যের অবসান ঘটবে এবং তার পরে স্বাধীন মুদ্রা ব্যবস্থার প্রচলনের মধ্যে দিয়ে বিশ্ব বাণিজ্য সবার জন্য সমান ভাবে উন্মুক্ত হবে কিনা তা ভাবনার বিষয়।



সংগৃহীত



No comments

Thank you, best of luck

Theme images by sbayram. Powered by Blogger.