ads

ভ্রমণ-কাহিনি।। সুইজারল্যান্ডের দিনগুলো ।। সেলিনা হোসেন ।।




সুইজারল্যান্ডের কো-তে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। কো শহর নয়, গ্রাম। ইংরেজি বানান Caux। সুইজারল্যান্ডের অনেক জায়গায় বানান এমন। আগে থেকে জানা না-থাকলে উচ্চারণ করে বোকা হতে হবে। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে কো-তে পৌঁছি, সঙ্গে আমার মেয়ে ফারিয়া লারা । জেনেভা বিমানবন্দর থেকে ট্রেনে মন্ত্র যেতে দেড় ঘণ্টা সময় লাগল । মন্নু থেকে পাহাড়ি ট্রেনে কো পৌঁছাতে সময় লাগে বিশ মিনিট। ছোটো রেললাইন, এক বগি মিনি ট্রেন পাহাড়ের ওপর উঠতেই থাকে। পথে ছোটো ছোটো স্টেশন পড়ে, বেশ কয়েকটি জায়গা পর্যটনের জন্য বিখ্যাত। নিচে জেনেভা হ্রদের নীল জল পাহাড়ের সঙ্গে মিতালি পাতিয়ে খেলা করে। ট্রেন ওপরে উঠছে তো উঠছেই। কখনো সুড়ঙ্গের অন্ধকার, কখনো গাছের সারি। শুধু সারি নয়, অসংখ্য গাছের সবুজ আভা যেন ঠিকরে পড়ে। ঘন সবুজ দূর থেকে কালো দেখায়। ট্রেন পাহাড়ের কত ওপরে উঠেছিল বলতে পারব না, শুধু নিচের শহর এবং হ্রদ ক্রমাগত ছোটো হয়ে যায়। পাহাড়ের মাথায় দিগন্তজোড়া বরফের শুভ্রতা। ভাষায় এইসব দৃশ্যের বর্ণনা অসাধ্য, ভুলে গেলাম পথের ক্লান্তি ।


শান্ত অঞ্চল এই গ্রামটি । ইলেকট্রিক ট্রেন কিছুক্ষণ পরপর আসা-যাওয়া করে। ট্রেন আসে মঞ্জু থেকে এবং গন্তব্য রোশে দুনায়ে পর্বতের পাদদেশ পর্যন্ত। মোটরের পথও আছে মঞ্জু থেকে। সে পথ আরো সুন্দর। লুসান থেকে জেনেভা হ্রদের পাশ দিয়ে সোজা পূর্ব দিকে এগোতে থাকলে লাভোঁর দ্রাক্ষালতার মনোরম খেত পেরিয়ে ভিভে শহর পৌঁছাতে হবে। আর একটু এগোলে ক্লারেন্স সাগর। তারপর! তারপর এক অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য । এ সৌন্দর্যের বিস্তার হ্রদ থেকে বরফপাহাড়ের শীর্ষে। এর মাঝে গ্লিস তার সবুজ সমভূমি নিয়ে হ্রদের ওপরে ব্যালকনির মতো ছড়িয়ে আছে। আর একটু এগোলেই পড়বে কো-র বাঁক ।
একজন পর্যটক বলেছিলেন, মন্নু হলো পৃথিবীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অসাধারণ জায়গাগুলোর মধ্যে একটি। এর মধ্যে কো-র সৌন্দর্য অবর্ণনীয় এবং কোনোদিনই ভুলবার নয়। হ্রদের সমতল থেকে দু-হাজার ফুট ওপরে কো, যার সৌন্দর্য অতুলনীয়। প্রকৃতি অকৃপণভাবে তার রোদ এবং জল দিয়ে, আকাশ তার রঙের বিন্যাস দিয়ে এ জায়গা তিলে তিলে তৈরি করেছে।
একশ বছরেরও কম সময় আগে এই এলাকায় ছোটো ছোটো শ্যালে ছাড়া তেমন কিছু ছিল না। সেই সময়কার একজন পর্যটক লিখেছিলেন, বসন্তে নার্সিসাস ফুল ফোটার সময়ে কেউ হয়ত দু-চারজন ব্যক্তির সাক্ষাৎ‍ পেত, হেমন্তের শেষে দেখা যেত দু-চারজন শিকারীকে এবং গ্রীষ্মে বরফ-পাহাড়ে ওঠার জন্য লোকেরা ভিড় জমাত। এর আগে এলাকাটি ছিল মঞ্জুর অধিবাসীদের গো-চারণভূমি। গত শতক পর্যন্ত এই এলাকা মূলত ঘাসের খোলা প্রান্তর, খামার এবং পানীয় উৎপাদনের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পাঁচশো প্রতিনিধি এসেছেন সম্মেলনে অংশগ্রহণ করতে। নির্দিষ্ট দিনে এক জমজমাট অনুষ্ঠানের উদ্‌বোধন হয়। লারা খুশিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে, 'কত দেশ, কত মানুষ! আমার মনে হচ্ছে অর্ধেক পৃথিবী দেখা হলো আমার !
আমিও আনন্দে মাথা নেড়ে বলি, 'হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ।'
যেখানে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছে সেই বাড়ির নাম আউন্টেন হাউস। এর চারদিকে শুধু পাহাড় আর বন ।
কো-তে রয়েছে সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গ 'রোসে দুনায়ে’, ইংরেজিতে বলা হয় 'মাউন্টেন অব স্লো'। মাউন্টেন হাউসের ছয়তলায় আমাদেরকে রুম দেওয়া হয়েছিল। জানালায় দাঁড়িয়ে আমি অপরূপ প্রকৃতি দেখে চোখ জুড়াতাম । লারাকে দেওয়া হয়েছিল একতলার ঘরে। ওর বয়েসি আরও চারজন মেয়ে ছিল একসঙ্গে। ওদের মধ্যে একজন ছিল নরওয়ের। মেয়েটি কলকাতার মাদার তেরেসার সঙ্গে কাজ করেছিল। সেই গল্প করত ওরা। লারা আমাকে বলে, 'তুমি প্রকৃতি দেখ, আর আমি চার দেশের মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করি। কার বেশি পাওয়া হলো আমাদের এই ভ্রমণে?' আমি বলি, 'তোমার বেশি পাওয়া হয়েছে। মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব শিক্ষার একটি দিক। ওদের কাছ থেকে অনেক কিছু তুমি জানতে পারছ । ’
লারা হাসতে হাসতে বলে, 'এই ভ্রমণে এসে আমি অপরূপ সুন্দর একটি দেশ দেখতে যেমন পাচ্ছি, তেমনি আবার জানার পৃথিবীও পেয়েছি।' ওর কথা আমাকে মুগ্ধ করে। সম্মেলনের অবসরে একদিন আমরা গ্রুয়ে শহরের পনির কারখানা দেখতে যাই।
গ্রুয়ে পনির কারখানার জন্য পৃথিবী জুড়ে বিখ্যাত। প্রতিদিন শত শত ট্যুরিস্ট এই সুস্বাদু পনির তৈরি পদ্ধতি দেখতে এখানে আসে। গ্রুয়ের এই কারখানায় শুধু সেসব গরুর দুধে পনির তৈরি হয় যেসব গরুকে শুধু তাজা ঘাস খাওয়ানো হয়। পরীক্ষা না করে এরা দুধ গ্রহণ করে না । প্রতিদিন সকালে প্রতিবেশী গোয়ালারা পাঁচ হাজার লিটার ও বিকালে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আট হাজার পাঁচশো লিটার খাঁটি দুধ পৌছে দেয় এই কারখানায়। কারখানাটা ছোটো একটা দোতলা বাড়ির মতো । একতলায় ক্রমাগত পনির তৈরি হয় আর দোতলায় ট্যুরিস্টদের ভিড়ে একাকার। চারপাশ কাচ দিয়ে ঘেরা। সেখান দিয়ে নিচে তাকালেই দেখতে পাওয়া যায় পনির তৈরি হচ্ছে আর পাশের একটি ছোট্ট ঘরে সারি সারি পনির স্তূপ করে রাখা হয়েছে।
পনির বানানো দেখে যখন বেরুলাম দেখি সামনের দোকানে এই তৈরি পনিরের ছোট্ট ছোট্ট টুকরো কাঠির আগায় গেঁথে রাখা হয়েছে। একটি কাঠি কিনে মুখে পুরলেই হয়। ফিয়োনা বলল, লারা তুমি এক টুকরো খেয়ে দেখ। ও খেয়ে মাথা নাড়ল, চমৎকার।' কিন্তু পনির আমরা কেউ কিনিনি। জেফরি লারাকে কতগুলো চকলেট কিনে দিল। এরপর আমরা গেলাম প্রাচীন আমলের সেই দুর্গের কাছে। দুর্গ পর্যন্ত পৌঁছার আগে গাড়ি এক জায়গায় পার্ক করতে হয়। এখান থেকে অনেকটা পথ হেঁটে যেতে হবে। রাস্তার দুপাশে অসংখ্য দোকান— দোকানে অজস্র জিনিস—দাম আকাশ-ছোঁয়া। কিছুই কিনতে পারিনি। নেড়েচেড়ে রেখে দিলাম। তবে দেখে শুনে মনে হলো সুইজারল্যান্ডের হেন জিনিস নেই যা এসব দোকানে নেই ।
বাড়িঘর দেখে মনে হচ্ছিল এলাকাটি পুরোনো। প্রতিটি বাড়িতে অজস্র ফুল। কোনো কোনো বাড়ির সামনের দেয়াল এবং গেট গোলাপ কিংবা অন্য কোনো লতানো গাছ দিয়ে পুরোটা আচ্ছাদিত। প্রতিটি বাড়ির জানালায় লম্বা টবে ফুল । মনে হলো ফুল এদের জীবনযাপনের অবিচ্ছেদ্য অংশ— এদের সংস্কৃতি ফুল ছাড়া বর্ণহীন । লারা বলছিল, ‘এদের বাড়িগুলো আমাদেরই মতো। আমাদের বাড়িগুলোতে টিনের চাল, আর এদের বাড়িগুলোতে টালির ছাদ।' বললাম, 'না, তেমন কোনো পার্থক্য নেই। পার্থক্য একটি, সেটি হলো রুচির। এদের বাড়িগুলো দেখে মনে হয় নতুন, ফুলের বাহার বাড়ির সৌন্দর্য তীব্র করে দিয়েছে।
জেনেভা থেকে যতই বের হয়েছি, শহরের সৌন্দর্য তত বেড়েছে। না, শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে নয়, ছবির মতো ফুটে আছে বাড়িঘর। এই এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছি এটা একটা পাহাড়ের ওপরের সমতল, নিচে তাকালে দেখা যায় মসৃণ ঘাস, লাল টালির ছাদওয়ালা বাড়ি এবং পাহাড়ের মাথায় বরফের শুভ্রতা, তার ওপর নীল আকাশ । কোথাও কোনো বাহুল্য নেই । সবটাই গোছানো, ছিমছাম । ফিরতে ফিরতে নয়টা বেজে গেল কিন্তু তখনো চারদিকে ঝকঝকে আলো। মাউন্টেন হাউসের সামনে অনেকে দাঁড়িয়ে গল্প করছে।

একদিন বিকালে মারিয়া পোটিয়াস আমাদেরকে মন্নু শহরে নিয়ে গেল । আমরা ট্রেনে গেলাম। স্টেশন থেকে হেঁটে আমরা জেনেভা হ্রদের ধারে গেলাম। ছোটোখাটো সুন্দর শহর, একদম লেকের ওপর। চারদিকে ফুলের শোভা । এমন জায়গা নেই যেখানে ফুলের টব নেই, লেকের পাড়ে নারী-পুরুষ শিশুদের ভিড়। আমরা লেকের পাড়ে অনেকক্ষণ হাঁটলাম, আইসক্রিম খেলাম। লেকের নীল জল, রাজহাঁস সাঁতার কাটছে, দূরে নৌকা, ওপরে পাহাড় ৷ কী যে ভালো লাগছিল হাঁটতে। মারিয়া আমাকে কয়েকটি দোকানে নিয়ে গেল। কিছুই কিনতে পারলাম না। একটা জিনিস বুঝতে পারলাম যে, এরা গরুর গলায় যে ঘণ্টা বাঁধে, সে ঘণ্টাগুলো বিভিন্ন আকারে এবং রঙে প্রতিটি দোকানে সাজানো। দেখতে সুন্দর। আমি খুব ছোটো একটা ঘণ্টা কিনলাম পাঁচ ফ্রা দিয়ে, শুধু সুইজারল্যান্ডের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে, মারিয়া দুচারটা প্রয়োজনীয় জিনিস কিনল। তারপর ট্রেনের সময় হয়ে এলে আমরা ছুটলাম। মারিয়া টিকেট কিনল। ট্রেনে বসে অনেক গল্প হলো ওর সঙ্গে। জানতে চাইলাম ও কী কাজ করে। পরিষ্কার ভাষায় বলল, গৃহস্থালিতে সাহায্য করার জন্য সে বিভিন্ন পরিবারে কাজ করে।


শুনে চমকে উঠি । যে বিবরণ দিল তাতে আমাদের দেশের আয়ার কাজ। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। ও আমার প্রতিক্রিয়ার কথা ভাবতে পারে না। আমি জানি ওদের দেশে কাজটাই মুখ্য। ওরা নিজেদেরকে সেভাবেই দেখে। মারিয়া ওর অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করে যাচ্ছে। যে পরিবারে শুধু বুড়ো-বুড়ি দুজন থাকে সে ধরনের পরিবারেই বেশি কাজ করতে হয়। বুড়ো-বুড়িরা লোক পেলে কেবল কথা বলতে চায়, অকারণে আটকে রাখে, ইত্যাদি নানা কথা । মারিয়ার তিন মেয়ে। সেজন্য ওরা স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে বাড়ি থেকে বের হতে পারে না । দুজনে পালা করে বের হয়। এবারে মারিয়া বেরিয়েছে ইংল্যান্ড হয়ে সুইজারল্যান্ডে। প্রতি সামারে ওরা কোথাও-না-কোথাও যাবার চেষ্টা করে। বলে, নিউজিল্যান্ড তো দ্বীপ, চারদিকে সাগর। সেজন্য আমাদের প্রতিবেশী দেশ নেই । আমাদের বেরুতে হলে লম্বা পথে বেরুতে হয়। তোমাদের তো একদিকে সাগর, তাই না? ঝলমলে মুখে কথা বলে যায় মারিয়া। এমন যদি হতো আমাদের দেশে! সারা বছর মানুষের বাসায় কাজ করেও আমরা ঘুরে বেড়াতে পারতাম পুরো পৃথিবী! মুহূর্তে আশপাশের সব সৌন্দর্য ম্লান হয়ে যায়। কিছুই ভালো লাগে না। মারিয়া বলল, কী হয়েছে তোমার ? বললাম দেশের কথা মনে পড়ছে। আমাদের অনেক মেয়ে মানুষের বাসায় কাজ করে। কিন্তু পুরো পৃথিবী ঘোরার সুযোগ ওদের নেই।

যেদিন সম্মেলন শেষ হলো সেদিন বিকেলে সম্মেলনের সেক্রেটারি বলল, ‘আগামীকাল সকালে আমাদের এক বন্ধু জেনেভা যাবে । আমি বলেছি আপনাকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিতে। আর ট্রেনে যেতে হবে না।' শুনে খুশি হয়ে গেলাম । একটা ঝামেলা থেকে তো বাঁচলাম। ট্রেনে গেলে মন্নুতে গিয়ে আবার জেনেভাগামী ট্রেনে উঠতে হতো। তাছাড়া সড়কপথে যাবার অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হব না। খুব ভোরে উঠে গোছগাছ করে নিলাম । একতলা থেকে লারার ফোন এল, 'তুমি রেডি!' বললাম, 'হ্যাঁ।' ‘আর কটা দিন থেকে গেলে হয় না ?' 'কেন?'
‘এত সুন্দর জায়গা! আর কি আসা হবে?'
“হয়ত হবে না। কিন্তু যত সুন্দরই হোক থাকার কথা ভেব না। এ কিন্তু তোমার মাটি নয় । তোমার দেশ তোমার মাটি।'
“তা সত্যি।'
লারা ফোন রেখে দিল ।
গাড়ির চারপাশে অনেকে ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল। গাড়িতে যাবার সুযোগ পেয়েছি দেখে সুশোভা আর বিজয়লক্ষ্মী একসঙ্গে বলল, “ইউ আর লাকি।' একদল বাচ্চা ঘিরে ধরেছে লারাকে। বুঝলাম, বন্ধুত্ব ওদের মধ্যেই দ্রুত হয়। কো যে ভালোবাসা এবং বন্ধুত্বের কথা বলে তা সবসময়ে আগামী প্রজন্মের দিকে হাত বাড়িয়ে রাখে। যে ভালোবাসা দেশের সীমানা অতিক্রম করে পৌঁছে যাবে সব দেশের মানুষের হৃদয়ে। যে ছেলেমেয়েরা লারার সঙ্গে কথা বলছে তারা প্রত্যেকেই ভিন্ন দেশের নাগরিক। তারা কত গভীরভাবে ওদেরকে মনে রাখার কথা বলেছে, ঠিকানা দিচ্ছে, চিঠি দেবার কথা বলেছে, আশা প্রকাশ করেছে যে হয়ত আবার কখনো দেখা হবে— কত আবেগ, প্রবল অনুভূতি। ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি, ওদের হাসি দেখি। আর চোখের সামনে মুছে যায় দেশের সীমানা। মনে হয় ওদের কোনো আলাদা দেশ নেই । ওরা সবাই এক। এজন্যেই কি লারার মন খারাপ হয়? ছেড়ে যাবার আগে আরো দুটো দিন বেশি থাকতে চায়? আমরা বড়োরা অনেক বেশি বৈষয়িক। দেশে ফেরার তাড়া অনুভব করি। ঘর-সংসার, কাজ ফেলে এসেছি তো! আমাদের বন্ধুত্ব হৃদয়ের নয়— কাজের এবং স্বার্থের। সব দেশের লারাদের বন্ধুত্ব হৃদয়ের। কো-র আকাঙ্ক্ষা — ভবিষ্যৎ ওরা এভাবেই গড়বে।


লেখক-পরিচিতি: 

সেলিনা হোসেনের জন্ম ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে রাজশাহীতে। তিনি বাংলাদেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ ঔপন্যাসিক ও ছোটোগল্পকার। ইতিহাস, দেশভাগ, মুক্তিযুদ্ধ ও প্রগতিশীল সমাজচিন্তা তাঁর রচনার প্রধান বিষয়। সেলিনা হোসেনের গল্পগ্রন্থগুলো হচ্ছে 'উৎস থেকে নিরন্তর', 'খোল করতাল', 'মতিজানের মেয়েরা' ইত্যাদি। ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি', 'হাঙ্গর নদী গ্রেনেড', 'গায়ত্রীসন্ধ্যা ইত্যাদি তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস। সাহিত্যে অবদানের জন্য সেলিনা হোসেন দেশ-বিদেশের নানা পুরস্কার লাভ করেছেন। তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ একুশে ও স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হয়েছেন।

পাঠ-পরিচিতি ও মূলভাব: 
সুইজারল্যান্ডের অপরূপ সৌন্দর্যঘেরা কো-শহরে একটি সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়েছিলেন লেখক। তাঁর সঙ্গে তাঁর ছোট্ট মেয়ে ফারিয়া লারা। লারাকে থাকতে দেওয়া হয় ভিন্ন দেশ থেকে আগত সমবয়েসি চারজনের সঙ্গে। ফারিয়া সহজেই তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। পাহাড়ি ট্রেনে জেনেভা থেকে কো-তে পৌঁছে, সম্মেলনের ফাঁকে ফাঁকে সাগর, পাহাড়, হ্রদ-ঘেরা সবুজ কো, গ্রুয়ে ও মঞ্জুর প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে লেখক ও লেখক-কন্যা লারা মুগ্ধ। মুগ্ধ বিভিন্ন দেশের মানুষের সাবলীল আচরণে, বন্ধুত্বে। আবার লেখকের মন খারাপও হলো ধনী ও সুন্দর দেশের সঙ্গে নিজের দেশের তুলনা করে। অবশেষে বিদায়বেলা এল। লারার মন খারাপ হলো, তবু নিজের

দেশের মায়াটাও বড়ো কথা । এ ভ্রমণকাহিনিতে সুইজারল্যান্ডের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জনজীবন ছাড়াও জগতের সকল মানুষের মধ্যে যে গভীর আত্মীয়তার বন্ধন রয়েছে তা প্রতিফলিত হয়েছে।

শব্দার্থ ও টীকা 

বগি- রেলগাড়ির এক একটি আলাদা অংশ ।
মিনি-  ছোটো। ইংরেজি mini.
পর্যটন — ভ্রমণ ।
হ্রদ- — চারদিকে স্থলবেষ্টিত জলাশয় । 
শ্যালে — অগভীর জলাভূমি ।
মিতালি - বন্ধুত্ব।
সুড়ঙ্গ - মাটি, পাহাড় বা নদীর নিচ দিয়ে তৈরি পথ ।
দিগন্তজোড়া — দিকের শেষসীমা জুড়ে।
শুভ্রতা- সাদা রঙের।
ইলেকট্রিক ট্রেন - বিদ্যুৎ দ্বারা চালিত রেলগাড়ি ।
পাদদেশ - নিম্নভাগ ।
গো-চারণভূমি-- যে ভূমিতে গরু চরে।
প্রতিনিধি – মুখপাত্র, কারো পরিবর্তে কাজ করার জন্যে নিযুক্ত ব্যক্তি ।
সম্মেলন- সমাবেশ।
দ্রাক্ষালতা- আঙুরের লতা।
ব্যালকনি - ঝুলন্ত বারান্দা। ইংরেজি balcony.
শীর্ষ - চূড়া।
মাউন্টেন অব স্নো - বরফের পাহাড়। ইংরেজি mountain of snow.
পনির  - একধরনের ছানা। দুধ ও লবণ দিয়ে বানানো হয়। – 
ট্যুরিস্ট- ভ্রমণকারী। ইংরেজি tourist.
গৃহস্থালি - ঘরের কাজ ।
সামার — গ্রীষ্মকাল। ইংরেজি summer.
অবিচ্ছেদ্য - আলাদা করা যায় না এমন।


No comments

Thank you, best of luck

Theme images by sbayram. Powered by Blogger.