ads

আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না || আন্দালিব রাশদী ||


আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না
আমার এবং আমাদের অনেকের ছেলের কাছে নামটা ‘বেঙ্গলি ডে’, আর এটা সম্ভবত ফেব্রুয়ারি মাসেই। ভবানীপ্রসাদ মজুমদার তেমন বড় কবিদের কেউ নন, কবিতাটিও তেমন সমৃদ্ধ কোনো রচনা নয়। তবু কবিতার কথাগুলো মোটেও উপেক্ষণীয় নয় :

“ছেলে আমার খুব সিরিয়াস কথায়-কথায় হাসে না
জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসে না
ইংলিশে ও ‘রাইমস’ বলে
‘ডিবেট’ করে পড়াও চলে
আমার ছেলে খুব ‘পজেটিভ’ অলীক স্বপ্নে ভাসে না
জানেন দাদা, আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসেন না।”
এ কবি বাংলাদেশের নন, বাংলা ভাষার, পশ্চিমবঙ্গের, যেখানে বাংলার যথেষ্ট চর্চা হতো। এখন ওখানকার অফিস, আদালত এবং ব্যবসা-বাণিজ্য শাসন করে ভিন্ন দুটো ভাষা : ইংলিশ ও হিন্দি। বিশ^ায়নের ভাষা ইংরেজি এর অপ্রতিহত সম্প্রসারণ ঠেকানো মুশকিল, দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে কেবল মহাকরণে নয়, বাঙালির হেঁশেলেও হিন্দি ভাষার দাপুটে উপস্থিতি। বাংলা গুরুত্বের দিক থেকে এমনকি বাংলাভাষী পশ্চিমবঙ্গেও তিন নম্বর। আমার ছেলে কোন ভাষার কেমন কদর, বেশ বুঝে:
“ইংলিশ ওর গুলে খাওয়া, ওটাই ‘ফার্স্ট’ ল্যাঙ্গুয়েজ
হিন্দি সেকেন্ড, সত্যি বলছি, হিন্দিতে ওর দারুণ তেজ।
কী লাভ পড়ুন বাংলা পড়ে?
বিমান ছেড়ে ঠেলায় চড়ে?
বেঙ্গলি থার্ড ‘ল্যাঙ্গুয়েজ’ তাই, তেমন ভালোবাসে না
জানেন দাদা, আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না।”
এই ছেলের কাছে ‘ইংলিশ ভেরি ফ্যান্টাস্টিক’ আর ‘হিন্দি সুইট সায়েন্টিফিক।’ বাংলার কোনো চার্ম নেই, গ্ল্যামার নেই, ইংলিশ আর হিন্দির পাশে ‘বেঙ্গলি’-কে ঠিক মানায় না। এটি নতুন কোনো উপসর্গ নয়।
প্রমথনাথ বিশী মহাশয় নিজের কাহিনী শুনিয়েছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংলিশে স্নাতক ডিগ্রি নেওয়ার পর বাংলায় এমএ পাস করেন। যখন চাকরির জন্য সাক্ষাৎকার দিতে গেলেন, শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে বললেন, বাংলায় এমএ। নিয়োগ পরীক্ষকদের প্রধান ঘটনাচক্রে প্রমথনাথ বিশী পরিবারের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন এবং তিনি জানতেন এই পরীক্ষার্থী ইংলিশে পড়াশোনা করছিলেন। তিনি নিশ্চিত হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করলেন, তা বাপু তুমি না ইংলিশ পড়তে? তিনি বললেন, স্নাতক পর্যন্ত। তারপর বাংলা এমএ। এবার পরীক্ষক প্রধান অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বললেন, দেখো আশু মুখুয্যের কান্ড! বাংলায় আবার এমএ। আশু মুখুয্যে হচ্ছেন তখনকার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়।
এবার তিনি প্রথমনাথ বিশিকে পরামর্শ দিলেন, প্রথমটুকুই যথেষ্ট, পরেরটুকু বলতে যেয়ো না। প্রমথনাথ বিশির বিশ^বিদ্যালয়ে পাঠের কাল আর একালের ব্যবধান প্রায় শত বছর। বলা বাহুল্য, বাংলার অবস্থানের তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি:
“কীসের গরব, কীসের আশা
আর চলে না বাংলা ভাষা।
কবে যেন হয় ‘বেঙ্গলি ডে’ ফেব্রুয়ারি মাসে না?
জানেন দাদা, আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না।”
এটা কেবল ওই ছেলেটির বা ওই মেয়েটির নয়, আমাদের প্রায় সবার ছেলেমেয়ে এবং নাতনি-নাতিদের বেলায়ও সত্য। তাদের ‘বাংলাটা ঠিক আসে না’। তাদের বাংলাটা ভালো করে আসার কোনো কারণ নেই। মায়ের ভাষা, মিষ্টি ভাষা, রসগোল্লা-চমচমের ভাষাএসব মধুমাখা কথার সামান্য গুরুত্বও নেই তাদের কাছে। গুরুত্ব পেত যদি বাংলার অর্থনৈতিক গুরুত্ব বাড়ত। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের সময় বাংলা ভাষার যে গুরুত্ব ছিল, প্রায় সাত দশকে এর সঙ্গে সামান্য গুরুত্বও যোগ হয়নি, বিয়োগ হয়েছে অনেক। তখন কমবেশি বাংলা জানতে হতো, এখন বাংলা না জানলেও সমস্যা নেই:
“বিদেশে কী বাংলা চলে? কেউ বোঝে না বাংলা কথা
বাংলা নিয়ে বড়াই করার চেয়েও ভালো নীরবতা
আজ ইংলিশ বিশ্বভাষা
বাংলা ফিনিশ, নিঃস্ব আশা
বাংলা নিয়ে আজকাল কেউ সুখের স্বর্গে ভাসে না
জানেন দাদা, আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না।”
ভবানীপ্রসাদের কবিতাটি ভাষাশহীদদের সমাধির সামনে, শহীদ মিনারের সামনে আবৃত্তি করে প্রকৃত সত্যটি তাদের জানিয়ে দেওয়াই উত্তম। তাদের নামে আমাদের শহীদ দিবস বড় হতে হতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হয়েছে, কিন্তু আমাদের মাতৃভাষার চাহিদা এতটুকুও বাড়েনি। আমরা বাড়াতে পারিনি। বাহান্নর ভাষাসৈনিক এখনো যারা বেঁচে আছেন, বয়স তাদের কমবেশি নব্বই। ক’বছর আগে ভাষাসৈনিকদের একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে নির্ধারিত বক্তাদের একজন হওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। যথেষ্ট বিনয়ের সঙ্গে সম্ভাষণ করে তাদের বলেছিলাম, আপনারা আপনাদের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করে যে ভাষাটা আমাদের হাতে তুলে দিলেন আমরা সেটা লালন করতে পারলাম না এবং এই ভাষায় সামান্য মূল্য সংযোজনও করতে পারলাম না। ভাষা যদি অর্থকরী না হয়, ভাষা যদি মূল্য সংযোজিত না হয়, তাহলে সে ভাষা শেষ পর্যন্ত টেকে না।
এটুকু বলার পরই একজন বর্ষীয়ান ভাষাসৈনিক খুব রেগে গেলেন এবং বললেন, ভাষা কি আলু না পটোল যে এতে মূল্য সংযোজন করতে হবে? আপনি খুব বাজে একটা কথা বলেছেন।
খুবই খাঁটি কথা, ভাষা আলুও নায়, পটোলও নয়; কিন্তু আর্থিক গুরুত্ব না থাকায় অনেক বিখ্যাত ভাষা পটল তুলেছে।
ভাষাসৈনিক ডাক্তার মির্জা মাজহারুল ইসলাম (১১ অক্টোবর, ২০২০ প্রয়াত) রসিক মানুষ তিনি ‘মূল্য সংযোজন’ শুনে পাশ থেকে আমাকে বললেন, “আস্তে বলেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড টের পেলে বাংলায় কথা বলার ওপর ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) বাসিয়ে দেবে।”
কিন্তু ভাষাসৈনিকও ভুল করেননি, যে আবেগ নিয়ে তারা সে সময় বুলেটের মুখোমুখি হয়েছেন, তার সঙ্গে বাস্তবিকই ‘অর্থকরী কিংবা মূল্য সংযোজন’এসবের কোনো সম্পর্ক ছিল না। তারা প্রতিকূল অবস্থায় বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন এবং করেছেন।
আমার মতো ভ্যাট-বছর পেরোনো প্রায় সবাই ‘অর্থকরী’ শব্দটি শিখেছেন পাট নিয়ে রচনা শেখা কিংবা মুখস্থ করার সময়। পাটকে কেন সোনালি আঁশ বলা হয়, তার ব্যাখ্যায় পাটকে টাকাপয়সার চোখ দিয়ে দেখতে হয়েছে। ভাষাকে কেন দেখতে হবে? ভাষা তো মা, মাকে কি টাকা দিয়ে মূল্যায়ন করা যায়? অভ্রান্ত যুক্তি। ভাষা আলু-পটোল নয়, পাটও নয়।
১৯৭৮ সালে সাহিত্যের নোবেল পুরস্কার পেলেন পোলিশ-আমেরিকান কথাসাহিত্যিক আইজাক বাশেবিস সিঙ্গার। তার মাতৃভাষা ইডিশ। ইউরোপের সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বেশ প্রাণবান ভাষা হিসেবে হাজার বছর রাজত্ব করেছে ইডিশ। কিন্তু ইডিশ ভাষার চাকরির বাজার, বাণিজ্যের বাজার ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসে। ইডিশ মা-বাবার সন্তানদের একটি বড় অংশ জার্মান, রুশ, পোলিশ এবং স্প্যানিশ ভাষাকে নিজেদের করে নিয়েছে; বেশির ভাগই গ্রহণ করেছে ইংরেজি। আইজাক বাশেবিস সিঙ্গার আফসোস করেছেন যে, তার লেখা বইটি যতক্ষণ না ইংরেজিতে অনূদিত হচ্ছে, তার দৌহিত্রের পক্ষে এ বইয়ে কী আছে, তা জানা সম্ভব হচ্ছে না। সিঙ্গার যখন নোবেল পুরস্কার পেলেন, তখন বললেন, সারা পৃথিবীতে হাতেগোনা কয়েকটি ইডিশ টাইপরাইটারের মধ্যে একটি তার নিজের, অন্যটি তার প্রকাশকের। টাইপরাইটারের যুগ শেষ হয়ে এসেছে। ঐশী জাদুতে যদি ইডিশের পুনর্জন্ম না ঘটে ইডিশ ভাষার কোনো নতুন লেখকের নাম আমাদের জানার আর সুযোগ হবে না।
১৯৫২ সালে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার মাধ্যমে একটিই ছিল বাংলা। ছোট আকারের মাদ্রাসাশিক্ষাও ছিল। পরবর্তী দশকগুলোয় মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি ধীরে ধীরে মহীরুহের আকার ধারণ করেছে, সবচেয়ে বেশি সম্প্রসারিত হয়েছে মাদ্রাসাশিক্ষা। পৃথিবীর সব ভাষাই বিকশিত ও সমৃদ্ধ হয়েছে মধ্যবিত্তের চর্চায় ও অংশগ্রহণে। আমাদের মধ্যবিত্তের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তাদের সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমে ধাবিত করেছেন এবং এমনকি নিম্নবিত্তের প্রচেষ্টা তার সন্তান ইংরেজি শিখুক। এটাই হওয়ার কথা, কারণ এ পর্যন্ত একটি চাকরির বিজ্ঞাপনও আমার চোখে পড়েনি, যেখানে বাংলা জানা চাকরিপ্রার্থীকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ইংরেজি তো বটেই, আরবি এবং এমনকি হিন্দি জানা প্রার্থীর চাকরিতে অগ্রাধিকারের বিজ্ঞাপন ঢাকার কাগজে দুর্লভ নয়। গত ২৫০ বছরে সবচেয়ে বেশি মূল্য সংযোজিত হয়েছে ইংরেজি ভাষায়। উপমহাদেশীয় ভাষায় সবচেয়ে বেশি অর্থকরী হয়ে উঠেছে হিন্দি।
রাষ্ট্রীয় সমর্থন কি ভাষাকে শক্তিশালী করে? অর্থকরী করে তোলে? এর উত্তর হ্যাঁ এবং না উভয়ই। হিন্দি রাষ্ট্রের সমর্থন পেয়ে এতটাই আগ্রাসী হয়ে উঠেছে যে, ভারতের অ-হিন্দিভাষী প্রায় রাজ্যেই পুরনো প্রজন্মের সবাই হিন্দিবিরোধী আন্দোলনমুখী হয়ে উঠেছেন। ষাটের দশক থেকে এমন অনেক আন্দোলন হয়েছে এবং প্রায় সব কটি আন্দোলনই ব্যর্থ হয়েছে, কারণ হিন্দি চাকরি ও বাণিজ্য সহায়ক ভাষা হিসেবে তরুণ প্রজন্মের কাছে আদৃত হয়ে উঠেছে।
যদি উর্দুর কথা ধরা যায় রাষ্ট্রীয় সমর্থনের বাড়াবাড়ি ভাষাটির ক্ষতি করেছে। উর্দুর বিরুদ্ধে ১৯৪৮-এর সিন্ধুতে আন্দোলন হয়েছে এবং মুখ্যমন্ত্রী আইয়ুব পুরো সে আন্দোলনে সমর্থন গদি হারিয়েছেন। বাংলাদেশে একই সময়ে উর্দু চাপিয়ে দেওয়া রদ করে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনটি পরে স্বাধীনতা আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। যারা উর্দু ভাষার বর্তমান অবস্থা জানেন, তারা স্বীকার করবেন এটি ক্রমান্বয়ে বিপন্ন ভাষার দিকেই যাত্রা করেছে। গত এক দশকে উর্দুর মূল ভূমি ভারতে অন্তত একশ ‘উর্দু ওনলি’ স্কুল হয় বন্ধ হয়ে গেছে, নতুবা হিন্দি স্কুলে পরিণত হয়েছে।
এখানে প্রশ্নটি ভাষার, সাহিত্যমর্যাদার কিংবা মিষ্টত্বের নয়। প্রশ্নটি ভাষার অর্থমূল্যের। বাংলা ভাষা মূল্য সংযোজন করতে পারছে না বলেই মধ্যবিত্তের সন্তান এমনকি নিম্ন-মধ্যবিত্তের সন্তানকেও ইংরেজিমুখী হতে হচ্ছে।
বাংলাকে জাতিসংঘের ভাষা বানিয়ে লাভ নেই, একসময় বাঙালির সন্তানের বাংলা বুঝতে দোভাষীর দরকার হবে। স্বাধীনতার অর্ধশত বর্ষেই ‘আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না’, বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতার শতবর্ষ উদযাপন করবে, তখন যে কী হবে!

সূত্র: দেশ রূপান্তর


No comments

Thank you, best of luck

Theme images by sbayram. Powered by Blogger.