ads

একটি সুখী গাছের গল্প; শেল সিলভারস্টাইন; অনুবাদ : জি এইচ হাবীব


একটি সুখী গাছের গল্প 
শেল সিলভারস্টাইন 
অনুবাদ : জি এইচ হাবীব 

এক যে ছিল আমগাছ। খুব ভালোবাসত সে একটি ছোট্ট ছেলেকে। হররোজ সেই ছেলেটি এসে গাছটার সব ঝরাপাতা কুড়িয়ে তাই দিয়ে মুকুট বানিয়ে বনের রাজা সাজত। কখনো-বা গাছটার কাণ্ড বেয়ে তরতর করে ওপরে উঠে ডাল ধরে দোল খেতো, আর আম খেতো। মাঝে মাঝে তারা লুকোচুরি খেলত। তারপর, এইসব করে ক্লান্ত হয়ে গেলে ছেলেটা পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ত গাছটার ছায়ায়। ছেলেটাও গাছটাকে ভালোবাসত খু-উ-ব। এবং গাছটা এতে সুখী ছিল।

কিন্তু সময় গড়িয়ে যেতে থাকে। ছেলেটাও বড়ো হয়ে উঠতে থাকে।
প্রায়ই দেখা যেত গাছটা দাঁড়িয়ে আছে একলা।
তো একদিন ছেলেটা গাছটার কাছে আসে, আর তখন গাছটা বলে, 'আয়, আয়, আমার গা বেয়ে উঠে ডাল ধরে দোল খা, আম খা, খেল আমার ছায়ায় বসে। আরাম কর। তোর সুখ দেখে আমি সুখ পাই।' কিন্তু ছেলেটা বলে, ‘এখন কি আর আমার গাছে উঠে খেলার বয়স আছে নাকি? আমি এখন নানান সব জিনিস কিনতে চাই, মজা করতে চাই । আমার চাই কিছু টাকা। তুমি কিছু টাকা দিতে পারো আমায়?' গাছটা বলে, 'এই তো মুশকিলে ফেললি। আমার কাছে তো টাকা নেই। আমার আছে কেবল পাতা আর আম। তা, এক কাজ করিস না কেন; আমার আমগুলো পেড়ে নে; ওগুলো বিক্রি করলে অনেক টাকা পাবি । তখন মনের সাধ মিটিয়ে কেনাকাটা করতে পারবি।' 

কাজেই, ছেলেটা তখন গাছে উঠে আমগুলো পেড়ে সেগুলো নিয়ে চলে যায়। খুব খুশি হয় গাছটা । কিন্তু এরপর আবার বেশ কিছুদিন কোনো দেখা মেলে না ছেলেটার । মন খারাপ করে থাকে গাছটা। তারপর একদিন আবার আসে ছেলেটা। খুশিতে সারা শরীর নেচে ওঠে গাছটার। বলে, 'আয় আয়, আমার গা বেয়ে উঠে আয় ওপরে, দোল খা ডাল ধরে, ফূর্তি কর।'

কিন্তু ছেলেটা বলে, ‘গাছে ওঠার চেয়ে ঢের জরুরি কাজ আছে আমার। মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই, একটা বাড়ি চাই আমার; রোদে-বৃষ্টিতে, গ্রীষ্মে-শীতে যাতে কষ্ট না হয় । আমার চাই একটা বউ, ছেলেমেয়ে। ওদেরকে রাখার জন্যে একটা বাড়ি আমার খুব দরকার। তুমি একটা বাড়ি দিতে পারো আমায়?”

গাছ বলে, আমার তো কোনো বাড়ি নেই, তবে হ্যাঁ, আমার ডালপালাগুলো কেটে নিতে পারিস। তাহলে খুব সহজেই ওগুলো দিয়ে একটি বাড়ি বানিয়ে নিতে পারবি তুই। তখন তোর আর সুখের সীমা থাকবে না। কাজেই ছেলেটা তখন গাছটার ডালপালা সব কেটে ফেলে, তারপর সেগুলো নিয়ে চলে যায় বাড়ি বানাবার জন্যে। খুশি হয় গাছটা।

তারপর বেশ কিছু দিন আর কোনো খোঁজ-খবরই থাকে না ছেলেটার। তবে একদিন যখন আবার আসে সে, ' খুশি হয় গাছটা। এত্তো খুশি যে কথাই বলতে পারে না সে কিছুক্ষণ। তারপর ফিসফিসিয়ে বলে, 'আয় আয়, খেলবি আয় ।’

ছেলেটা বলে, ‘খেলার বয়স আর মোটেই নেই আমার। বুড়ো হয়ে গেছি। তাছাড়া মনটাও খুব খারাপ। একটা যদি নৌকো পেতাম তাহলে খুব ভালো হতো। ওটাতে চেপে বহু দূরে চলে যেতে পারতাম এখান থেকে। একটা নৌকো দিতে পারো তুমি আমায়?'

‘আমার কাণ্ডটা কেটে ফেল, তারপর একটা নৌকা বানিয়ে নে ওটা দিয়ে,' গাছটা পরামর্শ দেয়। তখন ওটাতে করে তুই ভেসে বেড়াতে পারবি, খুশি হবি।' 

কাজেই ছেলেটা তখন গাছটার কাণ্ডটা কেটে ফেলে, তারপর ওটা দিয়ে নৌকো বানিয়ে ভেসে পড়ে দূরদেশের  উদ্দেশে। খুশি হয় গাছটা। কিন্তু তার বুকের ভেতর কোথায় যেন খচখচ করতে থাকে।

বহুদিন পর আবার ফিরে আসে ছেলেটা। গাছটা তখন বলে, 'আয়, কিন্তু এবার যে তোকে দেবার মতো আর কিছুই নেই আমার রে— আমার আমগুলো আর নেই ।

কিন্তু ছেলেটা বলে, ‘আম যে খাব এমন শক্তি কি আর আছে আমার দাঁতে?”

গাছটা বলে, ‘আমার ডালপালাগুলোও যে আর নেই রে। ওগুলো ধরে তুই আর ঝুলতে পারবি না।' ছেলেটা বলে, ‘আমি এখন এতই বুড়ো হয়ে গেছি যে গাছের ডাল ধরে ঝুলোঝুলি করার আর শক্তি নেই আমার।' গাছ বলে, ‘কাণ্ডটাও তো নেই, তুই তো ওটা বেয়ে ওপরে উঠতে পারবি না।'

ছেলেটা সে কথা শুনে বলে, 'আমি আসলে এত ক্লান্ত যে গাছ বেয়ে ওঠার জোর নেই আমার গায়ে।' একটা  দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গাছটা বলে, 'আমার খুব খারাপ লাগছে রে । তোকে যদি একটা কিছু অন্তত দিতে পারতাম..... কিন্তু কিছুই যে নেই আমার । আমি স্রেফ বুড়ি গুঁড়ি একটা। আমায় ক্ষমা করে দে তুই।'

ছেলেটা বলে, ‘এখন আমার আর খুব বেশি কিছু নেই চাইবার। বসে জিরোবার মতো স্রেফ একটা নিরিবিলি জায়গা হলেই যথেষ্ট। ভীষণ ক্লান্ত আমি।' যদ্দুর পারা যায় নিজেকে সোজা করে গাছটা বলে, ‘তা, বেশ তো, বুড়ি গুঁড়ি আর কিছু না হোক, বসে জিরোবার মতো একটা ভালো জায়গা তো বটেই। আয়, আয়, বোস, জিরিয়ে নে তোর যত খুশি।' 

ছেলেটা তা-ই করে। 

এইবার সত্যি সত্যি-ই খুশি হয় গাছটা।

লেখক-পরিচিতি: 
শেল সিলভারস্টাইনের পুরোনাম শেলডন অ্যালান সিলভারস্টাইন। তিনি আমেরিকার শিকাগোতে ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, শিশুসাহিত্যিক, গীতিকার, নাট্যকার ও কার্টুনিস্ট। তাঁর রচিত গান বব ডিলান সহ বিশ্বের বিখ্যাত শিল্পীরা পরিবেশন করেছেন। সিলভারস্টাইনের জনপ্রিয় গ্রন্থগুলো হলো— ‘দ্য গিভিং ট্রি’, 'দ্য মিসিং পিস', ‘হোয়্যার দ্য সাইডওয়াক এন্ডস', 'এ জিরাফ অ্যান্ড এ হাফ' প্রভৃতি। তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থ বিশ্বের প্রায় ৩০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। সিলভারস্টাইন ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন । 

অনুবাদক-পরিচিতি: 
জি এইচ হাবীব (গোলাম হোসেন হাবীব) জন্মগ্রহণ করেছেন ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকায়। অধ্যাপনা করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর অনূদিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর', ইয়াস্তেন গার্ডারের ‘সোফির জগৎ’, আমোস টুটুওলার ‘তাড়িখোর' উল্লেখযোগ্য ।

পাঠ-পরিচিতি ও মূলভাব: 
শেল সিলভারস্টাইনের বিখ্যাত রচনা ‘দ্য গিভিং ট্রি' গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ ‘একটি সুখী গাছের গল্প” । ছোটো একটি ছেলের বেড়ে-ওঠা থেকে বৃদ্ধকাল পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে একটি আমগাছের সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে রচিত এই গল্প । বলা যায়, বিভিন্ন প্রয়োজনে ধাপে ধাপে গাছটির কাছ থেকে মানুষের একতরফা সুবিধা নেবারই গল্প এটি। গাছটির সব কিছু নিয়েও মানুষটি সুখী হতে পারল না। শেষপর্যন্ত ফিরে এল কাণ্ড কেটে নেওয়া আমগাছের সেই গুঁড়ির কাছেই। সেখানেই সে খুঁজে পেল প্রশান্তি। প্রকৃতি ধ্বংস করে আধুনিক সভ্যতা গড়ে তুলতে গিয়ে মানুষ যে নিজেকে নিঃস্ব ও অসহায় করে ফেলছে তারই প্রতীক গল্পের মানুষটি। 
সবকিছু বিলিয়ে দিয়ে আমগাছটির যে সুখের অনুভব— মানুষ হিসেবে অপরের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেবার এই মহত্তম শিক্ষাও এ গল্পের বিশেষ দিক।

শব্দার্থ ও টীকা: 
হররোজ - প্রতিদিন ।
কাণ্ড- গাছের গুঁড়ি।
তরতর– দ্রুত, তাড়াতাড়ি।
নিশ্চিন্ত- ভাবনাহীন। 
লুকোচুরি- শিশুদের এক ধরনের খেলা ।
মুশকিল-- বিপদ। সংকট। আরবি শব্দ।
ঠাঁই- স্থান। আশ্রয়।
জিরোবার- বিশ্রাম নেবার ।
যদ্দুর- যত দূর ।


No comments

Thank you, best of luck

Theme images by sbayram. Powered by Blogger.