ads

রক্তে ভেজা একুশ ; সেলিনা হোসেন

[লেখক পরিচিতি : সেলিনা হোসেন ১৪ই জুন ১৯৪৭ সালে রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা এ.কে. মোশাররফ হোসেন, মাতা মরিয়মেন্নেসা বকুল। ১৯৬২ সালে তিনি রাজশাহীর পি.এন. গার্লস হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ১৯৬৪ সালে রাজশাহী মহিলা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে স্নাতক সম্মান ও স্নাতকোত্তর লাভ করেন। কর্মজীবনে তিনি বাংলা একাডেমীর পরিচালকের পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। সেলিনা হোসেন খ্যাতিমান কথা সাহিত্যিক। অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, নারীমুক্তি তাঁর কথাসাহিত্যের মূলগত আখ্যান। তাঁর রচিত উপন্যাসসমূহের মধ্যে উলে−খযোগ্য : হাঙর নদী গ্রেনেড, মগ্ন চৈতন্যে শিস, যাপিত জীবন, চাঁদবেনে, পোকামাকড়ের ঘরবসতি, গায়ত্রি সন্ধ্যা, দীপান্বিতা ইত্যাদি; গল্পগ্রন্থ : উৎস থেকে নিরন্তর, খোলকরতাল, মুক্তিযুদ্ধের গল্প ইত্যাদি; শিশু-কিশোর উপযোগ্য রচনা : সাগর, বাংলা একাডেমী গল্পে বর্ণমালা, বর্ণমালার গল্প, জ্যোৎস্নার রঙে আঁকা ছবি, চাঁদের বুড়ির পান্তা ইলিশ ইত্যাদি। সাহিত্যক্ষেত্রে অসাধারণ অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার ও ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কারসহ অনেক পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।]



সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের আহ্বানে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকা শহরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা মিছিল করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হয়। বিশাল সভা হবে। মেডিকেল কলেজের ক্যান্টিন জনশূন্য। মালেকের কাছে বলি অহি ও মন্টুও এসেছে বক্তৃতা শুনতে।

স্কুলের ছেলেদের সঙ্গে মিছিল করে প্রদীপ্ত এসেছে। ও দারুণ উত্তেজিত। শহরের এতসব ঘটনা ওকে প্রতিদিন অন্যরকম করছে। বাড়িতে বাবা ওকে নানা কিছু বুঝিয়ে দেয়। আলী আহমদ নিজেও ছাত্রদের নিয়ে সভা করেন। ওদের নানা প্রশ্নের জবাব দেয়। প্রদীপ্ত সেসব কথাও শোনে।

দূর থেকে অহিকে দেখে ও চিৎকার করে ডাকে। অহি ওকে হাত ইশারায় কাছে আসতে বলে। তারপর তিন জনে জায়গা নিয়ে বসে যায়। স্কুলের ছেলেদের চেয়ে অহির সঙ্গ বেশি প্রিয় মনে হয় প্রদীপ্তর। মাঘ মাসের মাঝামাঝি। শীতের রোদ ওদের বেশ আরাম লাগে। পিঠ রোদে দিয়ে বসেছে। ক্যান্টিনে বসে যারা চা খায় তাদের অনেকে বক্তৃতা করছে। কী আবেগ, কী গমগমে কণ্ঠ। অহির হৃদয় ছুঁয়ে যায়। অথচ কয়েক দিন আগে পল্টনে খাজা নাজিমুদ্দীনের শোনা বক্তৃতাটা ওর শরীরে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছিলো। বিরক্ত লাগছিলো ওর। আজ ওর আনন্দ হচ্ছে।

শুনলে কেমন মন ভরে যায়, না প্রদীপ্ত ?

হ্যাঁ।

প্রদীপ্ত প্রবলভাবে মাথা নাড়ে। মণ্টু আস্তে করে বলে, আমরা তো রাস্তার ছেলে, আমাদেরকে কী এসব মানায়?

একশো বার মানায়। প্রদীপ্ত জোরের সঙ্গে বলে।

সভা শেষে এক বিশাল মিছিল বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে করতে শহর প্রদক্ষিণ করে। মিছিলে ওরা হাত ধরে রাখে, পাছে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এক ফাঁকে অহি বলে, জানিস যখন ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ বলি তখন দম একটুও ফুরায় না। মনে হয় একনাগাড়ে হাজার বার বলতে পারি।

প্রদীপ্ত বলে, ঠিক বলেছেন অহি ভাই।

হাঁটতে হাঁটতে আমার পা ব্যথা হয়ে গেলো। চল কেটে পড়ি।

ধুত, আয় তো।

অহি মন্টুর হাত ধরে টান দেয়।

তিনজনে জনস্রোতে মিশে যায়। প্রদীপ্তর মনে হয় ওরা আর বালক নেই। ওর বাবা তো জানেন না যে প্রদীপ্ত স্কুলের ছেলেদের সঙ্গে মিছিলে চলে এসেছে। আজ বাবাকে গিয়ে ও বলবে, মিছিলে এসে ও বড় হয়ে গেছে। খুব বেশি বড় না হলেও অহির সামান তো হয়েছেই, ঐটুকু হতে পেরেই ওর আনন্দ হচ্ছে। ওরা বড়দের সঙ্গে সমান তালে হাঁটতে পারছে। প্রদীপ্তর মনে হয় ওর চারদিকে খোলা। যেদিকে খুশি সেদিকেই এগুতে পারে। এখন ওর শুধু ঠিক করা যে ও কোনদিকে যাবে।

বিকেলে কর্মপরিষদের উদ্যোগে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বক্তারা মুসলিম লীগ সরকারের বিশ্বাসঘাতকতার তীব্র নিন্দা করে এবং বাংলা ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালাবার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। এই সভাতেই ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবিতে প্রদেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের আহ্বান দেওয়া হয়।

আর কতদিন পরে অহি ?

আজ তো চার তারিখ। আরো ষোল দিন পরে।

এখনো অনেক দেরি।

দেখতে দেখতে দিন ফুরিয়ে যাবে। দেখছিস শহরের মানুষ কেমন মেতে উঠেছে। ডাঙুলি খেলার দিনগুলো বুঝি অনেক বেশি ভালো ছিলো। ওর অন্য বন্ধুরা ওর খোঁজে এসেছিলো, কিন্তু অহি ওকে যেতে দেয়নি। ওর অন্য বন্ধুরা ওর খোঁজে এসেছিলো, কিন্তু অহি ওকে যেতে দেয়নি। অহি এখন ওকে বেশি ভালোবাসে। সারাদিন ওরা তেমন সময় পায় না। অহির আগ্রহ বেশি, তাই মন্টু নিজে বেশি কাজ করে ওকে যাবার সুযোগ করে দেয়। অহি যেন ওর মায়ের পেটের ভাই। কেমন প্রাণের টান অনুভব করে।

একুশ তারিখের ধর্মঘট সফল করার জন্য ছাত্রদের যেমন, সাধারণ মানুষেরও তেমনি উৎসাহের অন্ত নেই। পূর্ণ উদ্যমে চলছে প্রস্তুতি। এগার ও তের ফেব্রুয়ারি পতাকা দিবস পালিত হয়। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবি সম্বলিত ব্যাজ বিক্রি করে একুশ তারিখ রাষ্ট্রভাষা দিবস পালনের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা হয়।

দেয়ালের লিখনে, পোস্টারে ছেয়ে গেছে শহর। মানুষের আলোচনার বিষয় একুশে। জল্পনা-কল্পনার অন্ত নেই। এদিকে ঐ একই তারিখে গণপরিষদে বসবে পূর্ববঙ্গ সরকারের বাজেট অধিবেশন। বিশ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে সরকার ক্রমাগত একমাসের জন্য ঢাকা জেলার সর্বত্র ধর্মঘট, সভা, শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করলো। তীব্র প্রতিক্রিয়া। থমথমে হয়ে যায় পুরো শহর। ক্ষোভে, আক্রোশে পরিপূর্ণ বুকের কন্দর নিয়ে জেগে রইলো মানুষ। অহি ভাবলো, আমার মতো রাস্তার ছেলের মৃত্যুর বদলে কি বাংলা ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠিত হবে ? আধো ঘুম আধো জাগরণে কেটে যায় সারারাত।

খুব ভোরবেলা জনশূন্য রাস্তায় এক দাঁড়িয়ে থাকে অহি। মন্টুকে ডেকেছিলো। কিন্তু এত ভোরে ও ঘুম থেকে উঠতে রাজি হলো না। ভোরের বাতাসে ও বড় করে হাই তোলে। শীত লাগছে না। ও ফাঁকা রাস্তায় খানিকক্ষণ দৌড়াদৌড়ি করে। শরীর গরম হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে ঠিক করে ফেলে যে আজ আর ক্যান্টিনে ফিরবে না। ও হাঁটতে হাঁটতে ইউনিভার্সিটির চত্বরে আসে। বেলা বেশ হয়েছে। ছেলেরা ইতস্তত জটলা করছে। বিভিন্ন স্কুল-কলেজ থেকে ছেলেমেয়েরা আসছে। স্কুলের ছেলেদের দেখলেই অহি প্রদীপ্তকে খুঁজতে থাকে। যত বেলা বাড়ছে, প্রতিবাদের, বিক্ষোভের শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠছে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। একটু পর সভা শুরু হলো। ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে কি না এই নিয়ে বিতর্ক চলছে। অহির অস্থির লাগছে। ওর বুলু দাসের কথা খুব মনে হয়। আজ তো বুলু দাসের কাজ নেই। এখনো কি ঘুমুচ্ছে ? সোহাগির সঙ্গে বিয়েটা কি হয়েই গেলো ?

পরক্ষণে তুমুল শ্লোগানে ভেঙে পড়ে এলাকা। দশজন দশজন করে মিছিল করে ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে। শুরু হয় গ্রেফতার বরণের পালা। দশজন করে বের হয় আর রাস্তায় অপেক্ষমাণ পুলিশ সবাইকে গ্রেফতার করে ট্রাকে তোলে। অহি একপাশে দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য দেখে। তখন প্রদীপ্ত দৌড়ে এসে ওর হাত ধরে, অহি ভাই ?

আমি তো তোকেই খুঁজছি প্রদীপ্ত।

আমি তো অনেকক্ষণ আগে এসেছি। তোমাকেই খুঁজছিলাম।

আমরা এখন কী করব অহি ভাই।

এদের সঙ্গে থাকবো। অন্য কোথাও যাবো না। দেখছিস না কেমন গ্রেফতার বরণ চলছে।

অহির বুক কাঁপে থরথর করে। দেখতে দেখতে অসংখ্য ছাত্রকে গ্রেফতার করে ট্রাক চলে যায় লালবাগ থানায়। এত গ্রেফতারের পরও ছাত্রদের দমন করতে না পেরে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়ে। ওদের চোখ জ্বালা করে। ওরা দৌড়ে পুকুরের পাশে চলে আসে। আঁজলা ভরে পানি তুলে চোখে ঝাঁপ দেয় পুকুরে। অহি আর প্রদীপ্ত কারো কারো জন্য রুমাল ভিজিয়ে নিয়ে আসে। চোখ মুছিয়ে দেয়। নিজেদের যন্ত্রণা তেমন নয়। ভুলে যায় সেটুকু। এই যন্ত্রণা এবং উত্তেজনায় ছাত্ররা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।

বেলা বাড়ে। সূর্য মাথার ওপর খাড়া। শীতের দুপুর বলে ঝাঁঝালো রোদ নয়। দুটো পর্যন্ত চলে গ্রেফতারবরণের পালা। এর মাঝে ছাত্র এবং সাধারণ মানুষ এসে জড়ো হতে থাকে মেডিকেল কলেজ

হোস্টেল, মেডিকেল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ গেটে। ওরা নিজেরা বুঝতে পারে না কিভাবে এখানে এলো। ওরা এখন মেডিকেলের হোস্টেলের সামনে দাঁড়িয়ে। মন্টু ওদের দেখতে পেয়ে ছুটে আসে।

অহি ? কোথায় ছিলি এতক্ষণ ? মাগো তোর কী যে সাহস। আমি তে ভয়েই বাঁচি না।

অহি ওর কাঁধে হাত রাখে।

ভয় কি মন্টু ? আয়।

না, আমি যাবে না। আমি এদিকেই থাকি।

মন্টু ভেতরের দিকে চলে যায়।

অহি দেখলো এখন আর ছাত্ররা এক নয়। স্রোতের মতো মানুষ এসে মিলিত হয়েছে। শত শত মানুষ। দলবদ্ধ হয়ে শ্লোগান দিয়ে রাস্তায় বেরোলেই তাড়া করে পুলিশ। বেলা সোয়া তিনটার দিকে এম.এল.এ ও মন্ত্রীরা মেডিকেল কলেজের সামনে দিয়ে পরিষদ ভবনে আসতে থাকে। পরিষদ ভবনের কোণে চৌরাস্তায় মেশিনগান পাতা হয়েছে। তৈরী হয়েছে কাঁটাতারের ব্যারিকেড।

উত্তাল হয়ে ওঠে জনতার শ্লোগান। কেউই আর কোনো বাধা মানতে চায় না। মিছিল এগিয়ে আসতে চাইলেই বেপরোয়া হয়ে ওঠে পুলিশ। কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়ে তাড়া করতে করতে ঢুকে পড়ে মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে। শুরু হয় খণ্ড যুদ্ধ। মানুষ ইটপাটকেল ছুঁড়তে থাকে। ক্যাদানে গ্যাস ও লাঠিচার্জে দমাতে না পেরে পুলিশ গুলি চালায়। পড়ে যায় রফিকউদ্দীন। বুলেটে উড়ে যাওয়া খুলি থেকে ধোঁয়া বেরোয়; গলিত মগজ বেরিয়ে পড়ে। আহত হয় বরকত। ওকে ধরাধরি করে হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যায় ছেলেরা। সহ্য করতে না পেরে চিৎকার করে ছেলেরা কাঁদে। মেডিকেল কলেজের ছেলেরা এ্যাম্বুলেন্সে করে আহতদের তুলে নিয়ে যায়।

তখন ফুলার রোডে নিহত অহিকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদে প্রদীপ্ত আর মন্টু। রক্ত লেগে যায় মন্টুর শরীরেও। অহির বুক ফুঁড়ে গুলি বেরিয়ে গেছে। এই প্রথম মন্টু একজনের জন্য বুক উজাড় করে কাঁদছে। বাবা যখন মারা গেছেন ও তা বোঝেনি। মায়ের অন্য লোকের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে সেজন্যও কাঁদেনি। রাস্তায় যতদিন ঘুরেছে তখন কারো জন্য কাঁদার মতো অবস্থাই হয়নি। আজ অহি ওর বুক উজাড় করে দিয়েছে। প্রদীপ্ত বিমূঢ় হয়ে গেছে। ও কখানো মৃত্যু দেখেনি। বিস্ফারিত চোখে শুধু অহিকেই দেখে। নিথর হয়ে গেছে অহি। ওর শরীরটা তখনো গরম। ও বুঝতে পারে কান্না কী ? ছোটোবেলা থেকে কখনো ওকে এমন করে কাঁদতে হয়নি। ওদের কাঁদার রেশ কমে আসার আগেই বুটের লাথিতে ছিটকে পড়ে ওরা। দেখে দুজন পুলিশ অহির লাশটা ট্রাকে উঠিয়ে চলে যাচ্ছে। কিন্তু প্রদীপ্ত দেখতে পায় না মফিজুলকে। গুলি মফিজুলের পেট ফুঁড়ে বেরিয়ে গেছে। রাস্তার ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে আছে ও। বুটের লাথি খেয়ে উল্টে পড়ে যাওয়া প্রদীপ্তকে হাত ধরে টেনে ওঠায় মন্টু। প্রদীপ্তর মাথা ঘুরছে। আশেপাশে কোনোকিছু দেখার মতো অবস্থা ওর নেই। ততক্ষণে আর একটি পুলিশ ভ্যান এসে উঠিয়ে নিয়ে যায় মফিজুলের লাশ। ও রেখে যায় রাস্তার ওপর জমাট রক্ত। পুলিশের গাড়ি দেখে মন্টু ভয় পেয়ে প্রদীপ্তকে টেনে গাছের আড়ালে চলে যায়। ও ক্ষীণ কণ্ঠে বলে, মন্টু পানি? মন্টু চারদিকে তাকায়, কোথায় পানি ? অবসন্ন কণ্ঠে বলে, যুদ্ধ থামুক। তারপর পানি দেবো।

পরদিন নয়, তেইশ তারিখের ‘আজাদ’ পত্রিকায় বেরুলো একটি সংবাদ।

‘বৃহস্পতিবারের ঘটনা সম্পর্কে শহরে প্রবল গুজব যে চার জনেরও বেশি লোক নিহত হয়। কিন্তু ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই তাহাদের মৃতদেহ সরাইয়া ফেলা হয়। একটি কিশোর বয়স্ক বালক সম্বন্ধে অনুরূপ গুজব শুনিয়া বিশেষ অনুসন্ধানের পরে জানান যায় যে, বালকটি মেডিকেল কলেজ ও পরিষদের মধ্যে ফুলার রোডে গুলিতে নিহত হয় এবং তাহার লাশ তৎক্ষণাৎ অপসারিত হয়।’

খবরের কাগজে খবরটা পড়ে গুম হয়ে থাকে আলী আহমদ। এমনিতেই দুদিন ধরে তার জ্বর। একুশ

তারিখের ঘটনায় টিয়ার গ্যাস এবং লাঠিচার্জে আহত হয়েছে। পায়ে এবং পিঠে আঘাত পেয়েছে। হাঁটতে কষ্ট হয়। মফিজুল তার কাছাকাছি ছিলো, পরে ভিড়ে কোথায় ছিটকে চলে যায় টের করতে পারেনি। এখন পর্যন্ত মফিজুলের কোনো খবর নেই। আলী আহমদ নতুন করে কিছু ভাবতে পারে না। কাগজে খবরটা পড়ে চেঁচিয়ে ওঠে প্রদীপ্ত, বাবা এ যে আমাদের অহি, অহিউল্লাহ।

চুপ, আস্তে। শুনতে পারে।

রান্নাঘরে বসে অহির মা গুনগুনিয়ে কাঁদছেন। বারবার বলছে, আমার অহির একটা খবর এনে দেন ভাইসাব।

আলী আহমদ কথা বলে না।

ও দীপু তুমি না বললে অহি তোমার সঙ্গে ছিলো ?

প্রদীপ্ত চুপ করে থাকে।

ওরে আমার অহিরে।

কান্নার সুর ওঠে অহির মায়ের কণ্ঠে। বাড়িতে শোকের ছায়া। অহি নেই এই কথাটা এখন পর্যন্ত অহির মাকে বলছে না কেউ। বলে কী হবে ? লাশ কোথায় ? লাশের খবর তো ওরা জানে না। মর্গে অহির বিকৃত চেহারাটা প্রথমে চিনতেই পারেনি বুলু দাস। চেনা লাগছে ? কে এ ? বুলু দাসের শরীর কাঁপে থরথর করে। হ্যাঁ অহি-ই তো ? একদম অহি। কোনো ভুল নেই। বুলু ডুকরে কেঁদে ওঠে। তারপর ওর পায়ের পাতায় হাত রাখে। চেপে বসে যায় তাত। গন্ধ আসছে তীব্র। কোনোকিছুই বোধে নেই ওর। বুলু স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বাইরে থেকে হেড জমাদার চিৎকার করে কী যেন বলছে, বুলুর কানে তা ঢোকে না। ও উবু হয়ে অহির মুখের ওপর ঝুঁকে থাকে। ইচ্ছে হয় বুকে জড়িয়ে ধরতে। প্রচণ্ড ব্যাকুলতায় বুলু দাসের কান্না থেমে যায়। হঠাৎ ওর মনে হয় অহির নিঃশ্বাস বইছে, বুকের পাঁজর ওঠানামা করছে। বুলুদা হাঁটুতে মুখ গোঁজে। ওর সামনে মর্গের ছোটো ঘরটা দিগন্ত-সমান হয়ে যায়।

বুলুদা, আমি অহি ?

বুলুর ঠোঁট কাঁপে। অহিকে বুকে তুলে নেয়।

তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো বুলুদা ?

মায়ের কাছে। ঘরে। একটি ঘর নয়। একজন মা নয়। অনেক মা।

আমার মা কেমন আছে বুলুদা ?

তোর আর এখন কোনো মা নেই। তুই এখন সব মায়ের ছেলে।

বুলু দাসের চোখে জল নেই। ও বুক ভরে শ্বাস টানতেই অনুভব করে অহির শরীর থেকে তীব্র জুঁই ফুলের গন্ধ আসছে। সেই গন্ধে ছুটে আসছে হাজার হাজার মানুষ। মুহূর্তে অহির শরীর লক্ষ লক্ষ মানুষের হাতে হাতে কোথায় চলে যায় বুলু দাস হদিস করতে পারে না। ও বিমূঢ় হয়ে থাকে। এত লোক অহিকে ভালোবাসে? এত ভালোবাসা অহির জন্য? গর্বে-অহংকারে বুলুর বুক ভরে যায়। ওর কেবলই মনে হয় অহি মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে গেছে। অহি মরেনি।






No comments

Thank you, best of luck

Theme images by sbayram. Powered by Blogger.