ads

বাংলা দ্বিতীয় পত্র; ভাবসম্প্রসারণ [৫২টি ভাবসম্প্রসারণ]

ভাব-সম্প্রসারণ : 
কবি-সাহিত্যিকদের লেখায় কখনো কোনো একটি বাক্যে বা কবিতার এক বা একাধিক চরণে গভীর কোনো ভাব নিহিত থাকে। সেই ভাবকে বিস্তারিতভাবে লেখা, বিশ্লেষণ করাকে ভাবস¤প্রসারণ বলে। যে ভাবটি কবিতার চরণে বা বাক্যে প্রচ্ছন্নভাবে থাকে, তাকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করতে হয়। সাধারণত সমাজ বা মানবজীবনের মহৎ কোনো আদর্শ বা বৈশিষ্ট্য, নীতি-নৈতিকতা, প্রেরণামূলক কোনো বিষয় যে পাঠে বা বাক্যে বা চরণে থাকে, তার ভাবস¤প্রসারণ করা হয়। ভাবস¤প্রসারণের ক্ষেত্রে রূপকের আড়ালে বা প্রতীকের ভেতর দিয়ে যে বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়, তাকে যুক্তি, উপমা, উদাহরণ ইত্যাদির সাহায্যে বিশ্লেষণ করতে হয়। 
ভাবসম্প্রসারণ করার ক্ষেত্রে যেসব দিক বিশেষভাবে খেয়াল রাখা প্রয়োজন :

১. উদ্ধৃত অংশটুকু মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে।
২. অন্তর্নিহিত ভাবটি বোঝার চেষ্টা করতে হবে।
৩. অন্তর্নিহিত ভাবটি কোনো উপমা-রূপকের আড়ালে নিহিত আছে কি না, তা চিন্তা করতে হবে।
৪. সহজ-সরলভাবে মূল ভাবটিকে ফুটিয়ে তুলতে হবে।
৫. মূল বক্তব্যকে প্রকাশরূপ দেওয়ার জন্য প্রয়োজনে যুক্তি উপস্থাপন করতে হবে।
৬. বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি যেন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
৭. বক্তব্য সাধারণত বিশ থেকে পঁচিশ লাইনের মধ্যে প্রকাশ করতে হবে।

১. পাপকে ঘৃণা কর পাপীকে নয়।

প্রতিটি মানুষই নিষ্পাপ হয়ে পৃথিবীতে আসে। জন্মের সময় কোনো মানব শিশুর গায়ে পাপ-পঙ্কিলতার চিহ্ন থাকে না। অর্থাৎ, মানুষ জন্মসূত্রে পাপী হয় না; বরং পরিবেশ তাকে ক্রমে ক্রমে পাপীতে রূপান্তরিত করে।

বিংশ শতাব্দীর এ সভ্যতার যুগে ক্রমেই বাড়ছে খুন, রাহাজানি, ছিনতাই, ধর্ষণের মতো অনৈতিক এবং অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা। কেউ লোভে পড়ে, কেউ জীবিকার তাগিদে আর কেউ বা সঙ্গদোষে এসব কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। সমাজের কুচক্রীমহল বিভিন্ন স্তরের সাধারণ মানুষকে নানা প্রলোভন দেখিয়ে অন্যায় কর্মকাণ্ডে নিযুক্ত করছে প্রতিনিয়ত। এভাবেই ধীরে ধীরে একজন মানুষ হয়ে উঠছে দাগী আসামি কিংবা অপরাধী। কিন্তু তার জন্মের সময় সে আর দশজনের মতোই নিষ্পাপ ছিল। পৃথিবীর বুকে বেড়ে উঠতে গিয়ে নানা প্রতিক‚ল পরিবেশের সংস্পর্শেই মানুষ পাপাচারে প্রবৃত্ত হয়। স্বেচ্ছায় কেউ পাপী হয় না। বৈরী পরিবেশে, অসৎ সঙ্গ, জীবিকার তাগিদ কিংবা অন্য কোনো কারণেই মানুষ পাপপথ বেছে নিতে বাধ্য হয়। মানুষের ইন্দ্রিয় সংযত না থাকলেই মানুষ পাপ-পুণ্যের ব্যবধান করতে ব্যর্থ হয়ে পড়ে। মানুষ হিসেবে প্রত্যেককেই অন্যের প্রতি সহানুভ‚তিশীল থাকতে হবে। পাপ কর্মকে ঘৃণা করা প্রতিটি মানুষের পরম কর্তব্য ও পবিত্র দায়িত্ব। কিন্তু যে পাপী তাকে সমাজের এককোণে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেওয়া মহৎপ্রাণ মানুষের কাজ নয়। তারাও মানুষ এবং আমাদের বৃহত্তর সমাজেরই অংশ। তাই তাদের প্রতি ঘৃণা পোষণ করা অবিবেচকের কাজ। তাদেরকে ভালোবাসা দিয়ে তাদের স্বভাবের পরিবর্তন ঘটাতে হবে। তবেই সমাজে হবে চির কল্যাণ ও মঙ্গলের জয়যাত্রা।

সমাজে নানা ধরনের মানুষ বাস করে। সবাইকে নিয়েই গঠিত হয় সমাজ। এদের মধ্যে যারা পাপকর্মে প্রবৃত্ত হয় তাদের কর্মকে দৃঢ়ভাবে প্রতিরোধ করতে হবে। তবে মমতা ও ভালোবাসা দিয়ে চেষ্টা করতে হবে পাপীকে সংশোধন করার। পাপকে ঘৃণা করলেও পাপীকে ঘৃণা করা উচিত নয়।

২. অর্থই অনর্থের মূল।

পার্থিব জীবনে মানুষের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি অর্থ। তাই অর্থ মানুষের নিয়ন্ত্রণাধীন, তথা অর্থকে সে পরিচালিত করে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মানুষ যখন অর্থের কাছে জিম্মি হয়ে অর্থের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তখনই জগৎসংসারে অর্থ অনর্থের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

জীবনধারণের জন্য অর্থ অপরিহার্য। পার্থিব জীবনে অর্থ বা বিত্তই মানুষের একান্ত কামনা। মানুষ তার কাক্সিক্ষত অর্থ উপার্জনের জন্য কঠোর পরিশ্রম করে এবং নানা প্রতিকূল অবস্থার মোকাবেলা করে। অর্থ মানুষের আজীবন প্রয়োজন মেটায় বলে অর্থ ছাড়া জীবন অর্থহীন বা মূল্যহীন বলে বিবেচিত হয়। তাই সারা জীবন মানুষ অর্থের পেছনে ছোটে। বর্তমান পৃথিবীতে একমাত্র অর্থের মাপকাঠিতেই প্রতিপত্তি ও সম্মান নির্ধারিত হয়। কী করে তাই অধিক অর্থ উপার্জন করা যায় তার জন্য মানুষের চেষ্টার অন্ত নেই। বিপদে-আপদে, উৎসবে-আনন্দে, জন্ম-মৃত্যুতে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই অর্থের প্রয়োজন। কিন্তু অর্থের অযাচিত ব্যবহার সুখ ও কল্যাণের বদলে অকল্যাণ বয়ে আনে। অর্থের লোভে নীতিবর্জিত হয়ে মানুষ অহরহ নানা দুষ্কর্মে লিপ্ত হয়। অন্যায় পথে অর্জিত অর্থ মানুষকে বিবেকহীন ও দাম্ভিক করে তোলে। অর্থের লালসা মানুষের নৈতিক অধঃপতন ঘটায়। অর্থের লোভেই চরিত্রহীন হয়ে মানুষ সমাজবিরোধী কাজে লিপ্ত হয়। পৃথিবীর সকল দ্ব›দ্ব-সংঘাত ও অশান্তির মূলে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত থাকে অর্থ। অর্থ-সম্পদের স্বার্থেই রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে যুদ্ধের উন্মাদনা জাগে, শ্রমিকে-মালিকে হয় মতবিরোধ, ভাইয়ে-ভাইয়ে শুরু হয় চরম শত্রæতা। অর্থের লোভেই মানুষ মানুষকে খুন করে। তাই বলা যায়, জগতের সব অশান্তি ও অনর্থের মূলে রয়েছে অর্থ।

সুষ্ঠু সমাজজীবন ও স্বাভাবিক জীবন অতিবাহিত করার জন্য অর্থের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। কিন্তু অর্থ যেন অনর্থের মূল না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। তাই অর্থ-সম্পদের ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। অর্থের সুষ্ঠু ব্যবহারই এর মর্যাদা বৃদ্ধি করে।




৩. অর্থসম্পত্তির বিনাশ আছে কিন্তু
জ্ঞানসম্পদ কখনো বিনষ্ট হয় না। 

পৃথিবীতে প্রতিটি বস্তুর ক্ষয় বা বিনাশ অনিবার্য। কিন্তু যে-সম্পদটির বিনাশ নেই বরং বিকাশ আছে তা হলো জ্ঞানসম্পদ। জ্ঞান অবিনাশী বলে একবার তা অর্জন করলে সারা জীবনের সম্পদ হিসেবে সঞ্চিত হয়। তাই জ্ঞানই মানুষের একান্ত নিজস্ব মহামূল্যবান সম্পদ।

মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অর্থের বিকল্প নেই। অর্থের জন্য মানুষ উদয়-অস্ত কঠোর পরিশ্রম করে। অর্থ দ্বারাই আমরা ব্যক্তি ও সমাজজীবনে মানুষের অবস্থানকে নির্ণয় করে থাকি। কিন্তু এ অর্থসম্পদ কেবল মানুষের বাইরের দিকটিকেই প্রকাশ করে। অর্থ-সম্পদ যতই শক্তির অধিকারী হোক না কেন, জ্ঞানসম্পদের কাছে তা তুচ্ছ। সত্যিকারের জ্ঞানী ব্যক্তি বিত্তশালী লোকের চেয়ে অনেক বেশি ধনবান। বস্তুত অর্থ-সম্পদের কোনো স্থায়িত্ব নেই। আজকে রাজা, কালকে ফকির এ রকম দৃষ্টান্ত অনেক রয়েছে। বিত্তবানের ধনভাণ্ডার একসময়ে নিঃশেষ হয়ে আসে। কিন্তু বিদ্বানের জ্ঞানভাণ্ডার ক্রমশ সমৃদ্ধ হতে থাকে। সময়ের ব্যবধানে সে অধিকতর জ্ঞানী হতে থাকে। যিনি জ্ঞানী তিনি আমৃত্যু জ্ঞানরূপ সম্পদে সম্পদশালী। তাঁর জ্ঞানের ক্ষয় নেই। এমনকি মৃত্যুর পরেও তাঁর এই জ্ঞানের প্রাচুর্য পৃথিবীতে বিরাজ করে এবং জ্ঞানপিপাসুদের জ্ঞানতৃষ্ণা নিবারণ করে। এভাবেই জ্ঞানীরা মানুষের মনে অমরত্বের আসন লাভ করেন। তাই অর্থ-সম্পদে নয়, জ্ঞানসম্পদে সমৃদ্ধ ব্যক্তিগণই দেশ ও জাতির প্রকৃত সম্পদ, আর এ জন্যে অর্থসম্পদের মাপকাঠিতে নয়, বরং জ্ঞানসম্পদের মাপকাঠিতেই মানুষের মূল্যায়ন হওয়া উচিত।

জ্ঞান অতুলনীয় সম্পদ। জীবনের মতোই এটি মহামূল্যবান। জ্ঞানার্জন ধনার্জনের চেয়েও মহত্তর। মানুষ তার স্বরূপকে ঐশ্বর্যমণ্ডিত করতে পারে শুধু জ্ঞান আহরণের মধ্য দিয়েই। জাগ্রত করতে পারে নিজের ক্ষমতাকে, সহায় হতে পারে বিশ্বমানবতার।

৪. “স্বদেশের উপকারে নাই যার মন,
কে বলে মানুষ তারে পশু সেই জন।”
অথবা,
স্বদেশের প্রতি যার ভক্তি, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা নেই সে পশুতুল্য।

দেশপ্রেম ইমানের অঙ্গ। দেশের সেবায়, জাতির সেবায় আত্মনিয়োগ করা প্রতিটি নাগরিকের অবশ্য কর্তব্য।

প্রিয় স্বদেশ ঘিরেই মানুষের অন্তরে রচিত হয় নানা স্বপ্ন। দেশের গৌরবে মানুষ আনন্দে উদ্বেলিত হয়। আবার দেশের পরাজয়ে মানুষের অন্তরে নেমে আসে বেদনার ছায়া। একজন সচেতন মানুষ তার জন্মভ‚মিকে ভালো না বেসে পারে না। যদি কেউ ভালো না বাসে সে মানুষ নামের অযোগ্য। তাকে পশু বলাই শ্রেয়। কেননা, পশুর কোনো দেশ নেই, মানুষের আছে। একজন মানুষ যতই ধনবান, রূপবান কিংবা জ্ঞানবান হোক, তার অন্তরে যদি স্বদেশপ্রেম না থাকে, জন্মভ‚মির কল্যাণের জন্য যদি তার মন না থাকে, তাহলে সে নরাধম, সে বর্বর, সে পশু। আমাদের জন্মভ‚মি আমাদেরকে দিয়েছে পরম আশ্রয়। এর সুশীতল ছায়ায় আমরা লালিত হচ্ছি। অজানাকে জানা, অদেখাকে দেখার স্বপ্ন আমরা পূরণ করছি দেশের মাধ্যমেই। আমাদের মাতৃভ‚মি সারা পৃথিবীর সাথে আমাদের আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছে। এর কল্যাণের জন্য, এর গৌরব বৃদ্ধির জন্য আমাদের অবশ্যই চেষ্টা করতে হবে। স্বদেশের ভালো-মন্দ দেখার দায়িত্ব প্রতিটি মানুষের। দেশের গৌরবকে সমুন্নত রাখা একজন নাগরিকের পবিত্রতম কর্তব্য। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধারণ এবং লালন করা একজন নাগরিকের একান্ত কর্তব্য। পতাকার রং বাড়ায় আত্মসম্মান। সুমধুর জাতীয় সংগীত জোগায় সঞ্জীবনী সুধা, স্বদেশের মাটির মতো এমন পবিত্র আর কিছু নেই। এর নদী, জল, শস্য ভরা প্রান্তর, নৈসর্গিক দৃশ্যাবলি মানুষকে টেনে নেয় গভীর থেকে গভীরে।

স্বদেশপ্রীতি যার নেই সে পশুর সমান। দেশের উপকারে যিনি নিবেদিতপ্রাণ, তিনিই প্রকৃতপক্ষে মানুষ। পক্ষান্তরে, দেশ প্রেমহীন আত্মকেন্দ্রিক যার হৃদয়, সে নিঃসন্দেহে পশুর সমান।

৫. কত বড়ো আমি, কহে নকল হীরাটি 
তাই তো সন্দেহ করি নহ ঠিক খাঁটি। 

বস্তুর বাহ্যিক আকৃতিতে অভিভ‚ত না হয়ে তার অভ্যন্তরীণ সত্য উপলব্ধিতেই আছে সার্থকতা। আয়তনের দিক থেকে বিশালত্ব, চাকচিক্যের দিক থেকে ঔজ্জ্বল্য শ্রেষ্ঠত্বের পরিচায়ক নয়। মিথ্যা, ভিত্তিহীন পরিচয়ের অহংকার নিয়ে বেশিদিন চলা যায় না। একদিন না একদিন আসল পরিচয় প্রকাশিত হবেই।

হীরা মহামূল্যবান ধাতু। খাঁটি হীরা আকারে ছোট হয়। পক্ষান্তরে নকল হীরা হয় আকারে বড়। কিন্তু নকল হীরা যতই বড় হোক না কেন, সে আসল হীরার মতো অপরূপ আলোকরশ্মি বিচ্ছুরণের মাধ্যমে মনোহর সৌন্দর্যের সৃষ্টি করতে পারে না। তার আকৃতি বা আত্মপ্রচার কোনোটাই তাকে খাঁটি হীরায় পরিণত করতে পারে না। সে মেকি, মেকিই থেকে যায়। বরং নিজের আকৃতি এবং আলোকরশ্মি বিচ্ছুরণে কৃত্রিমতার কারণে সে ধরা পড়ে যায়। আমাদের সমাজে এমন অনেক মানুষ আছে, যারা সত্যিকার অর্থে নিকৃষ্ট, হীনচিত্ত কিন্তু মিথ্যা অহমিকায় অন্ধ হয়ে তারা বাইরে প্রচার করে যে তারা অনেক বড়। এমনকি প্রচারসর্বস্ব পন্থায় সমাজের কাছ থেকে নাম কেনার চেষ্টা করে। শুধু তাই নয়, অনেক সময় হীনচিত্তের এ মানুষগুলো নকল হীরের মতো আমাদের সমাজের মধ্যমণি হয়ে ওঠে। কিন্তু অন্যকে তুচ্ছজ্ঞান করে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে বেশিদূর অগ্রসর হওয়া যায় না। তাদের আত্মপ্রচারের মধ্য দিয়ে তারা যে প্রকৃত অর্থে অন্তঃসারশূন্য তা ধরা পড়ে যায়। একদিন তাদের সত্যিকার মুখোশ বেরিয়ে পড়ে। তখন মুখ লুকোবার জায়গা থাকে না। বস্তুত নিজের ঢাক নিজে পিটিয়ে কখনও বড় হওয়া যায় না। প্রকৃতই যারা বড় তাঁদের ক্ষমতা জাহিরের প্রয়োজন হয় না। তাঁদের সুকৃতির আলোতেই লোকে তাদের পরিচয় পায়। আকাশে চাঁদ উঠলে তাকে দেখার জন্য আলো জ্বালানোর প্রয়োজন হয়। তেমনিভাবে প্রকৃত মহৎ ব্যক্তিদের স্বভাব ও কর্মের গুণে স্বাভাবিকভাবেই তাদের চিহ্নিত করা যায়। প্রকৃতপক্ষে, নিছক বাহ্য আকৃতি কারোর আসল পরিচয় বহন করে না। হৃদয়ের বিশালতাই মানুষকে বড় করে, দেহের বিশালতা কিংবা অর্থ-সম্পদের প্রাচুর্য বা ক্ষমতার প্রাবল্য তাকে একটুও বড় করে না।

বস্তুত যাদের কর্মের ভাণ্ডার শূন্য; নিষ্ঠা, সাধনা ও শ্রমে যারা বিমুখ, মনের দিক থেকে যারা নিকৃষ্ট, চিন্তায় যারা অনগ্রসর তারাই আত্মপ্রচারসর্বস্ব হয়। প্রকৃত গুণী ব্যক্তিগণ কখনোই অহেতুক আত্মপ্রচারের কৌশল অবলম্বন করেন না। যার গুণ আছে তার সুনাম এমনিতেই প্রকাশ পায়।


৫. দুর্নীতি জাতীয় জীবনে অভিশাপস্বরূপ।

সমাজে বসবাস করতে হলে মানুষ সমাজ ও রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট ও সুশৃঙ্খল কতকগুলো নিয়মনীতি মেনে চলে ও চলতে হয়। কিন্তু মানুষ যখন স্বেচ্ছাচারিতার প্রকাশ ঘটিয়ে অন্যায়ভাবে প্রচলিত নিয়মনীতি ও আইনকানুন লঙ্ঘন করে দুর্নীতির আশ্রয় নেয় জাতীয় জীবনে তখন নেমে আসে ঘোর অন্ধকার।

দুর্নীতি জাতীয় ও অর্থনৈতিক জীবনে এক দুষ্ট রাহু। দুরারোগ্য ব্যাধির মতোই তা সমাজের সকল শ্রেণি ও পেশার লোককে গ্রাস করে। দুর্নীতির প্রভাবে ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনে অধঃপতন নেমে আসে। দুর্নীতির ফলে একদিকে যেমন রাষ্ট্রীয় সকল নিয়মনীতিতে দেখা দেয় চরম বিশৃঙ্খলা তেমনি সমাজজীবনেও অবক্ষয়ের চিত্র প্রকট হয়ে ওঠে। দুর্নীতির ফলে প্রশাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। সমাজে দেখা দেয় খুন-রাহাজানি, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, মারামারিসহ নানা অপকর্ম। একজন দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তি কখনোই সুস্থ স্বাভাবিক চিন্তা করতে পারে না। সে দেশ ও দশের মঙ্গলের কথা না ভেবে স্বার্থচিন্তায় মগ্ন হয়। তখন তার কাছে মানবিক মূল্যবোধ গৌণ হয়ে ওঠে। বিবেক, সততা তার কাছে হয় লাঞ্ছিত, অপমানিত। সে বেছে নেয় অন্যায় ও অসত্যের পথ। এভাবে দেশ ও সমাজ ক্রমেই ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায়। তাই দুর্নীতিকে জাতীয় জীবনে অভিশাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

দুর্নীতির কারণে একটি জাতির মহত্তম অর্জনও বিফলে যেতে পারে। দুর্নীতির গ্রাসে কেবল অতীত ও বর্তমান নয়, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাও অন্ধকারে ঢাকা পড়ে যায়। এই সামাজিক অভিশাপকে সমূলে উৎপাটনের জন্য সবাইকে সোচ্চার হতে হবে।


৭. মিথ্যা শুনিনি ভাই
এই হৃদয়ের চেয়ে বড়ো কোনো মন্দির-কাবা নাই। 

মানুষের হৃদয় সকল উপাসনালয়ের চেয়ে শ্রেষ্ঠ উপাসনালয়। কেননা, পবিত্র হৃদয়েই স্রষ্টার অবস্থান। মানুষের অন্তরগুলো যদি কল্যাণকামিতা আর পবিত্র চিন্তায় ভরে যায় তাহলে কোথাও আর অশান্তি ও অকল্যাণ থাকে না।

মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। বুদ্ধি-বিবেচনা এবং জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় মানুষের সমকক্ষ আর কোনো প্রাণী নেই। মানুষের রয়েছে বিচার ও বিশ্লেষণের শক্তি। ন্যায়-অন্যায়, পাপ-পুণ্য বিচার করে চলা মানুষের ধর্ম। পাপ-পুণ্য, ভালো-মন্দ, ধর্ম-অধর্মের পার্থক্য নির্ধারণে মানুষকে পরিচালিত করে মানুষের মন। মন দ্বারা পরিচালিত হয়ে মানুষ সৎ কাজ করে এবং স্রষ্টার সন্তুষ্টি লাভ করে। স্রষ্টা অন্তর্যামী। তিনি মানুষের হৃদয়ের খবরাখবর রাখেন। তাই তাকে পেতে হলে হৃদয়কে শুদ্ধ করতে হবে। যারা নির্মল হৃদয়ের অধিকারী, তারাই আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করতে পারেন। মিথ্যা, কপটতা এবং হীনম্মন্যতায় যাদের হৃদয় পরিপূর্ণ, তাদের মসজিদে-মন্দিরে গিয়ে লাভ নেই। তারা যতই সেজদা অথবা পূজা-অর্চনা করুক না কেন, কোনো কাজ হবে না। কেউ কেউ নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য মসজিদে-মন্দিরে গিয়ে আরাধনা করে; কিন্তু তার হৃদয় যদি কলুষমুক্ত না হয় তাহলে রাতভর আরাধনা করেও কোনো লাভ হবে না। তাই মন্দির বা কাবা শরিফ নয়, অন্তরই হচ্ছে আসল। অর্থাৎ অন্তর শুদ্ধ না করে কাবা শরিফে গিয়ে লাভ নেই। পরিশুদ্ধ হৃদয়ের অধিকারী যাঁরা তাদেরকে কাবা শরিফ গিয়ে আরো পূর্ণতা লাভ করতে পারেন। তাঁরা সহজেই সৃষ্টিকর্তার নৈকট্য লাভ করেন।

হৃদয়ের চেয়ে উৎকৃষ্ট আর কোনো কাবা, মন্দির নেই। নির্মল হৃদয়ের অধিকারী যারা তারাই সৃষ্টিকর্তাকে কাছে পেয়ে থাকেন। তাদের হৃদয়ই সত্যিকার আলোয় উদ্ভাসিত। তারাই স্রষ্টার প্রকৃত কল্যাণ লাভে সমর্থ।

৮. প্রাণ থাকলেই প্রাণী হয়, কিন্তু মন না থাকলে মানুষ হয় না।

মনই মানুষকে অন্যান্য প্রাণী থেকে আলাদা করেছে। মনই মানুষকে পশুত্ব থেকে মনুষ্যত্বে গৌরব দান করেছে।

মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। এই শ্রেষ্ঠত্বের কারণ হলো মানুষের একটা সুন্দর, অনুভ‚তিপ্রবণ মন আছে, যা আর কোনো প্রাণীর নেই। পৃথিবীরতে যত প্রকার জীব আছে, তাদের প্রত্যেকেরই প্রাণ রয়েছে। এদিক থেকে বিবেচনা করলে মানুষ আর দশটা প্রাণীর মতোই একটা প্রাণী। তবে মনোজগতের বৈশিষ্ট্যের কারণেই মানুষ অন্যান্য প্রাণী থেকে একেবারেই আলাদা। মন আছে বলেই মানুষের মধ্যে প্রেম আছে, কল্পনা আছে, সৌন্দর্যবোধ আছে, ধর্ম আছে। পৃথিবীর সকল পাপ-পুণ্য, ভালো-মন্দ, ধর্ম-অধর্মের পার্থক্য নির্ধারণে মানুষকে পরিচালিত করে তার মন। এ মন বা হৃদয় দ্বারা পরিচালিত হয়ে মানুষ সৎ কাজ করে এবং শিক্ষা, সাধনা ও অনুশীলনের মাধ্যমে মানবিক গুণাবলি আয়ত্ত করে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে। তখন অন্যান্য প্রাণী থেকে সে আলাদা হয়ে যায় এবং দৈনন্দিন জীবনের দ্ব›দ্ব-সংঘাত, হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা, স্বার্থচিন্তা, কুমন্ত্রণা প্রভৃতির সংস্পর্শ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখে। মনের শক্তির কারণেই মানুষ আজ সভ্যতার চরম শিখরে পৌঁছতে পেরেছে। মানুষ তার মন দিয়ে সাধনা করে জীবনের বিচিত্র বিকাশ ঘটায়, যা অন্য কোনো প্রাণী পারে না। আবার কোনো প্রাণীই নিজেকে জানে না, কিন্তু মানুষ নিজেকে জানে। আর এটা সম্ভব হয় তার মনের মাধ্যমেই। মনই তার রহস্যময় আয়না, মনই তাকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে। তাই সকল প্রাণীর ওপরে মানুষের স্থান। যে মানুষের আকৃতি নিয়ে পশুসুলভ আচরণ করে, যার মধ্যে মানবতাবোধ, সত্যনিষ্ঠা, ঔদার্য, সৎবিবেচনাবোধ, বিবেক-বুদ্ধি ইত্যাদি নেই তাকে সত্যিকারের মানুষ বলা চলে না। তাই মানুষ হতে হলে শুধু প্রাণ থাকলেই চলবে না, প্রাণ ও মনের যুগপৎ বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটাতে হবে।

জীবজন্তুর সারা জীবন কেটে যায় কেবল আত্মরক্ষা, বংশরক্ষা ও খাদ্য সংগ্রহে। বেঁচে থাকার প্রয়োজনে মানুষকেও একই কাজ করতে হয়। তা সত্তে¡ও মানুষ বিশিষ্ট, কারণ সে জ্ঞান, বুদ্ধি, বিদ্যা, হৃদয় ও সুকোমল বৃত্তির অধিকারী বলে।




৯. দণ্ডিতের সাথে
দণ্ডদাতা কাঁদে যবে সমান আঘাতে
সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার।

অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার বিধান চিরাচরিত। সকল শাস্তিই যন্ত্রণাদায়ক। কিন্তু দণ্ডদাতা বিচারক যদি মানবিক দিক থেকে সবকিছু বিবেচনা করেন এবং সমব্যথী হন তবেই সে বিচার হয় সর্বশ্রেষ্ঠ বিচার।

ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠাই বিচারকের একমাত্র ধর্ম। নিরপেক্ষভাবে অপরাধ নির্ণয় করে অপরাধীকে শাস্তিদান করাই বিচারকের কাজ। এই কাজ অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু অপরাধীকে দণ্ডদানের ব্যাপারে বিচারককে সংবেদনশীল হতে হবে, হতে হবে অনুভ‚তিপ্রবণ। তা না হয়ে তিনি যদি অপরাধীকে নির্মমভাবে দণ্ডদান করেন, দণ্ডিতের বেদনায় তাঁর হৃদয়ে যদি করুণার উদ্রেক না হয়, তবে তাঁর দণ্ডদান হয়ে ওঠে প্রবলের অত্যাচার এবং তিনি হয়ে পড়েন বিচারক পদের অযোগ্য। যে দণ্ডিত, যাকে তিনি দণ্ড দান করলেন, সে অবশ্যই কোনো হতভাগ্য পিতামাতার সন্তান। সন্তানের ব্যথা-বেদনায় তারাও ব্যথিত হবেন। তাছাড়া যেকোনো শাস্তিই কষ্টদায়ক। অপরাধীকে সেই কষ্ট ভোগ করতে হয়। বিচারক যদি তার এবং তার স্বজনদের ব্যথা-বেদনার কথা চিন্তা করে ব্যথিত না হন, তাহলে তাঁর শাস্তিদান হবে নিষ্ঠুরতার নামান্তর। কাজেই, দণ্ডিতের প্রতি বিচারককে সমব্যথী হতে হবে। সমব্যথী বিচারকের বিচারই সর্বশ্রেষ্ঠ বিচার এবং তিনি যে শাস্তিদান করেন, তাই সর্বোচ্চ শাস্তি।

দণ্ডদাতার মন অপরাধীর জন্য যদি সংবেদনশীল হয়ে ওঠে, তবে তা অপরাধীর হৃদয় এবং বিবেককেও স্পর্শ করবে। সেই সঙ্গে অপরাধী নিজের কৃত অপরাধের জন্য অনুতপ্ত হবে এবং জাগ্রত হবে তার পরিশুদ্ধ বিবেক।

১০. প্রয়োজনে যে মরিতে প্রস্তুত, বাঁচিবার অধিকার তাহারই।

মানবকল্যাণের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে যারা প্রয়োজনে হাসিমুখে প্রাণ উৎসর্গ করে, অমরত্ব একমাত্র তাদেরই প্রাপ্য। ভীরুতা নয়, আত্মপ্রত্যয়ই জীবনের যথার্থ ধর্ম।

মৃত্যু অনিবার্য, এর ভয়াল হাত থেকে কারো নিষ্কৃতি নেই। প্রতিনিয়ত মৃত্যুর লীলাখেলা দেখেও মানুষ জীবনের মায়া ত্যাগ করে না। জীবনের প্রয়োজনেই সে বেঁচে থাকে। আবার জীবনের প্রয়োজনেই মৃত্যুকে হাসিমুখে বরণ করে নেয়। মরণজয়ী দুঃসাহসী মানুষেরাই মৃত্যুকে বুক পেতে নিয়ে গড়ে তুলেছে মানবসভ্যতার মহিমান্বিত ঐশ্বর্য। মৃত্যুকে বরণ করে মৃতুকে জয় করেছেন তাঁরা। মৃত্যুভয়ে শঙ্কিত হয়ে জীবনযাপনের মধ্যে কোনো সার্থকতা নেই। ভয়ের মধ্যে থাকলে জীবনের সুখ ও আনন্দ থেকে বঞ্চিত হতে হয়। সেজন্যে ভয়ার্ত জীবন সফল জীবন বলে বিবেচিত হতে পারে না। জীবনকে সত্যিকারভাবে সফল ও উপভোগ্য করতে হলে মৃত্যুভয় পরিহার করতে হবে। কর্মময় মানবজীবনের প্রতিটি কাজেই কম-বেশি ঝুঁকি আছে। যে কাজ যত দুরূহ, যত বিপজ্জনক সে কাজের মৃত্যুর ঝুঁকি তত বেশি। এমন ক্ষেত্রে দৃঢ়চিত্ত সাহসীরাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কর্ম সম্পাদন করতে পিছপা হয় না। এ কারণেই পৌরুষদীপ্ত লোকেরাই ব্যক্তি, সমাজ ও জাতীয় জীবনে সফলতা বয়ে আনে। বস্তুত মৃত্যু জীবনের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। তবে মৃত্যুর শ্রেণিভেদ আছে। মৃত্যু কখনো কাপুরুষোচিত, কখনো স্বাভাবিক, কখনো বীরোচিত। বীরোচিত মৃত্যুই মানুষকে অমরত্ব দান করে। মহৎ উদ্দেশ্যে মরণের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যে মানুষ ভীত হয় না, তার জীবনই যথার্থ সার্থকতার দাবিদার। বেঁচে থাকার অধিকারী হতে হলে মরণকে তুচ্ছ বলে বিবেচনা করতে হবে।

জীবনের প্রতি মায়া দেখালে মৃত্যুভয় এসে জীবনকে মর্যাদাহীন করে তোলে। জীবনের প্রয়োজনে মৃত্যুকে হাসিমুখে বরণ করে নেওয়ার মধ্যেই জীবনের প্রকৃত সার্থকতা নিহিত।

১১. প্রয়োজনই উদ্ভাবনের জনক। 

সমস্ত সৃষ্টির মূল প্রেরণা হচ্ছে চাহিদা বা প্রয়োজন। প্রয়োজন না থাকলে মানুষের ভাবনাও থাকে না; তখন বিনা প্রয়োজনে কোনো কিছু করার আগ্রহও থাকে না। তাই কোনো কিছু উদ্ভাবনের প্রারম্ভে যে বিষয়টি বিবেচ্য তা হচ্ছে প্রয়োজন।

অণু থেকে অট্টালিকা পর্যন্ত, বিশ্বসভ্যতার প্রতিটি সৃষ্টির মূলে রয়েছে প্রয়োজন। জন্ম থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত; পৃথিবীর সব কাজেÑ খাদ্য, বস্ত্র, অন্ন, বাসস্থান, চিকিৎসা- যা কিছু দৃশ্যমান সবই প্রয়োজনের তাগিদে সৃষ্টি। পৃথিবীর সূচনা থেকেই মানুষ তার প্রয়োজন মেটানো বা অভাব পূরণের নিমিত্তেই বিচিত্র জিনিস উদ্ভাবন শুরু করেছে। তবে মানুষের এ উদ্ভাবন নাটকীয়ভাবে হয়নি। সৃষ্টির আদিলগ্নে মানুষ যখন অসহায় তখনই তার বোধ হয় ‘প্রয়োজন’-এর। উদ্ভাবন শুরু হয় নতুন নতুন জিনিসের। আদিম গুহাবাসী মানুষ শিকারের প্রয়োজনে তীর ধনুক আবিষ্কার করে, কাঁচা মাংস পুড়িয়ে খাওয়ার জন্য আগুন জ্বালাতে শেখে। এমনিভাবে প্রয়োজন ও আবিষ্কারের ধারাবাহিক স্তর পেরিয়ে মানুষ পদার্পণ করেছে আধুনিক সভ্যতায়। অন্ধকার থেকে আলোয় যাওয়ার প্রয়োজন উপলব্ধি করে মানুষ বিদ্যুৎ উদ্ভাবন করেছে। সুষ্ঠু যাতায়াত ব্যবস্থার প্রয়োজনে বিভিন্ন ধরনের যানবাহনে ও রাস্তাঘাট নির্মাণ করেছে। শিক্ষার প্রয়োজন উপলব্ধি করে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠান করেছে। চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল, ওষুধ ও বিভিন্ন রোগ নির্ণয়ের জন্য এক্স-রে, আল্ট্রাসনোগ্রাফি ইত্যাদি আবিষ্কৃত হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিকল্পে টেলিফোন, টেলিগ্রাফ, ফ্যাক্স, ইন্টারনেট, ই-মেইল, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন এবং চাষাবাদের জন্য উন্নত ধরনের আধুনিক কৃষিসরঞ্জাম আবিষ্কার করা হয়েছে। সর্বোপরি বিশ্বের সর্বত্র যে বিশাল কর্মকাণ্ডে মানুষ নিয়োজিত রয়েছে তা কেবল প্রয়োজন সাধনেই নিবেদিত।

প্রয়োজনের শেষ নেই, তাই মানুষের উদ্ভাবনেরও শেষ নেই। প্রয়োজনের তাগিদেই যুগ যুগ ধরে মানুষ এগিয়ে চলছে অসীমের সন্ধানে।


১২. পরের অনিষ্ট চিন্তা করে সেই জন
নিজের অনিষ্ট বীজ করে সে বপন।


মানুষে মানুষে কল্যাণ কামনার মধ্য দিয়েই পৃথিবীতে স্বর্গের সুখ নেমে আসে। কিন্তু অপরের অনিষ্ট চিন্তা সমাজে নিয়ে আসে বিপর্যয়। অন্যকে বিপদগ্রস্ত করতে গিয়ে অধিকাংশ সময় মানুষ নিজেই বিপদগ্রস্ত হয়।

মানুষ পৃথিবীতে একে অপরের সাথে মিলে মিশে থাকবে এটাই একান্তভাবে প্রত্যাশিত। পরস্পরের মধ্যে বন্ধুত্বের সেতুবন্ধন গড়ে ওঠে একে অপরের মধ্যে সদ্ভাব ও স¤প্রীতির মাধ্যমে। এর ফলে একজন আরেকজনের দুঃখে কাতর হয়। তাকে উদ্ধার করার জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। এভাবেই চলতে থাকে সামাজিক কাজকর্ম। কিন্তু সমাজের সকল মানুষের মনমানসিকতা তো একরকম নয়। ভালো মানুষের আড়ালে কিছু দুষ্ট লোকেরও বাস থাকে। পরের অনিষ্ট করাই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। পরের ভালো তাদের দুচোখের কাঁটা। কীভাবে অন্যের ক্ষতি করা যাবে সেই চিন্তায় তারা সর্বদা ব্যস্ত থাকে। তাদের সবসময় যোগাযোগ থাকে তাদের সমজাতীয় লোকের সাথে। এরা ক‚টবুদ্ধির হোতা হিসেবে সমাজে পরিচিত। কিন্তু তারা একথা বুঝতে পারে না যে তারা পরের অনিষ্ট করতে গিয়ে নিজেরই বেশি ক্ষতি করে। তারা কখনোই সমাজের ঊর্ধ্বে নয়। সমাজের কারো যদি তারা ক্ষতি করে তাহলে কিছুটা হলেও তার প্রভাব সমাজের ওপর পড়ে। আর সমাজের ওপর প্রভাব পড়া মানে তার ওপর প্রভাব পড়া। কিন্তু স্থূলবুদ্ধির কারণে তারা অনেক সময় এই ব্যাপারটি বুঝতে পারে না। অনেক সময় অন্যের সামান্য ক্ষতি করার জন্য নিজের দ্বিগুণ ক্ষতি স্বীকার করতে দ্বিধাবোধ করে না। পরিণতিতে তারা তাদের নিজের ধ্বংস নিজেই ডেকে আনে। উদাহরণস্বরূপÑ ঘসেটি বেগম ও মীরজাফর, নবাব সিরাজদ্দৌলাকে ধ্বংস করতে গিয়ে তারা ইতিহাসে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে পরিচিত। ইতিহাসের পাতা ওল্টালে এ রকম অজস্র উদাহরণ চোখে পড়বে। তাই পরের অনিষ্ট চিন্তা না করে পরের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করাই জীবনের সার্থকতা।

যারা পরের অনিষ্টের কথা চিন্তা করে তারা শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারে না। নিজের ফাঁদে নিজেই আটকে পড়ে ধুঁকে ধুঁকে মরে। চক্রান্ত ষড়যন্ত্রকারীরা সাময়িকভাবে সফল হলেও প্রকৃত বিচারে তারা ইতিহাসে ঘৃণিত মানুষ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে।


১৩. ভোগে নয়, ত্যাগেই সুখ।
অথবা, ভোগে সুখ নাই, কর্ম সম্পাদনেই প্রকৃত সুখ।

মনুষ্যত্বই মানুষের আসল পরিচয়। আর ত্যাগের মহিমাই পারে মানুষের এ মনুষ্যত্বের উৎকর্ষ ও বিকাশ ঘটাতে। ত্যাগের মাধ্যমে সম্পদ চলে যায়, কিন্তু তার বদলে পাওয়া যায় অমিয় সুখ। তাই ত্যাগই মানুষের একমাত্র আদর্শ হওয়া উচিত।

জগৎসংসারে ভোগ ও ত্যাগ দুটি বিপরীতমুখী দিক। ভোগ ও ত্যাগের দরজা সবার জন্যই উন্মুক্ত। ভোগে আনন্দ থাকলেও তৃপ্তি নেই। কিন্তু ত্যাগের মাধ্যমে আনন্দ ও তৃপ্তি দুটোই লাভ করা যায়। তাই ভোগ নয়, ত্যাগই জীবনের মূল সাধনা হওয়া বাঞ্ছনীয়। মনুষ্যত্বের কল্যাণেই মানুষ অন্যান্য প্রাণী থেকে আলাদা ও শ্রেষ্ঠ। শুধু মানুষ হিসেবে জন্ম নিলেই মনুষ্যত্ব লাভ করা যায় না। মানুষকে তার স্বীয় চেষ্টায় এ মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটাতে হয়। ভোগের মাধ্যমে এর বিকাশ ঘটে না। ভোগ মানুষকে জড়িয়ে ফেলে পঙ্কিলতা, গøানি ও কালিমার সঙ্গে। মনুষ্যত্বহীন মানুষদের অর্জিত সম্পদ নিজের স্বার্থ ছাড়া সমাজের অন্য কোনো কাজে আসে না। পরের দুঃখে তাদের মন কাঁদে না। তারা স্বার্থান্ধ ও সংকীর্ণচিত্ত বলে সমাজে পরিচিত। অন্যদিকে ত্যাগের পরের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করার দিকে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে। মনুষ্যত্বের গুণে মানুষ নিজের স্বার্থের কথা ভুলে গিয়ে পরার্থে, দীনদুঃখীদের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে আনন্দ পায়। সুখের জন্য অনেকেই বিলাস-ব্যসনে মত্ত হয়ে ওঠে এবং ভোগ-বিলাসের নানা উপকরণের আয়োজন করে। কিন্তু কোনোভাবেই ভোগাকীর্ণ জীবন সুখের সন্ধান দেয় না। কেননা তা হলে বিত্ত ও ক্ষমতাবানরাই পৃথিবীতে সবচেয়ে সুখী বলে গণ্য হতেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, এঁরাও জীবনে প্রকৃত সুখী হতে পারেন না। একমাত্র মহৎ কর্মের মধ্য দিয়েই অন্তরের সুখ পাওয়া যায়। দেশব্রতী, মানবব্রতী কর্মেই মানুষ লাভ করে জীবনের সার্থকতা।

বস্তুত পরের জন্য স্বার্থ ত্যাগ করার মধ্যেই মানুষের মানবিক গুণাবলির শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ পায়। যথার্থ সুখ ভোগ-বিলাসে পাওয়া যায় না, পাওয়া যায় নিরন্তর কাজের মধ্যে। আর দেশব্রতী ও মানবব্রতী ভ‚মিকার মধ্যে।


১৫. যে একা সেই সামান্য, যার ঐক্য নাই সে তুচ্ছ।

অন্যের সহযোগিতা ছাড়া মানবজীবন অচল। পৃথিবীতে যে ব্যক্তি নিঃসঙ্গ ও একা, সে নিঃসন্দেহে অসহায়। ঐক্যবদ্ধ জীবনপ্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন বলে সে শক্তিতে সামান্য এবং সামাজিকভাবে তুচ্ছ।

একজন মানুষ বা অন্য যেকোনো প্রাণী যখন একা তখন তার শক্তি থাকে সীমিত। কিন্তু যখন একতাবদ্ধ হয়ে দশজন একসঙ্গে কোনো কাজে হাত দেয় তখন সে হয় অনেক সবল ও শক্তিশালী। তখন কোনো কঠিন কাজ আর কঠিন বলে মনে হয় না। পৃথিবীর আদিপর্বে মানুষ ছিল ভীষণ অসহায়। কারণ তখন সে ছিল একা। সভ্যতার ঊষালগ্নে মানুষ উপলব্ধি করল যে, ঐক্যবদ্ধ জীবন ছাড়া এ পৃথিবীর সমস্ত প্রতিক‚লতা মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। তাই মানুষ গড়ে তোলে সমাজবদ্ধ জীবন, হয়ে ওঠে সামাজিক বলে বলীয়ান। এর পর থেকে মানুষ আর পেছনে ফিরে তাকায়নি। একতার শক্তিকে উপেক্ষা করে যে একা থাকতে চায় সে আসলে অসহায়। শক্তি বা সামর্থ্যরে ক্ষুদ্রতার কারণে একক মানুষ সকলের নিকট উপেক্ষিত। কিন্তু যারা ঐক্যবদ্ধ তাদের শক্তি অসীম। ঐক্যই প্রকৃত শক্তি। বিন্দু বিন্দু বৃষ্টির সমন্বয়ে সৃষ্টি হয় বিশাল জলরাশি। এইভাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শক্তির সমন্বয়ে সৃষ্টি হয় অসীম শক্তি। অনেক ব্যক্তিসত্তা যখন একতাবদ্ধ হয়ে সমষ্টির সৃষ্টি করে, তখন তাদের সমবেত শক্তি জাতীয় জীবনে বিরাট অবদান রাখতে সক্ষম হয়। একতার শক্তি অসম্ভবকে সম্ভবে পরিণত করে। সমগ্র জাতির মধ্যে একতা ছিল বলেই আমরা মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হয়েছি। একক কোনো শক্তি বলে তা সম্ভব ছিল না। আমাদের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখি, যখনই আমাদের জাতীয় জীবনে ঐক্যের অভাব হয়েছে তখনই নানা বিপদ ও দুর্ভাগ্য নেমে এসেছে। শুধু জাতীয় জীবনে নয়, আমাদের সামাজিক ও পারিবারিক জীবনেও একতার প্রয়োজন। একতাবদ্ধ হয়ে আমরা যেকোনো কাজ যত সহজে ও নির্বিঘেœ করতে পারি একাকী তা করা সম্ভব নয়।

মানুষ এককভাবে সামান্য আর তুচ্ছ। ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উন্নতিতে চাই মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস।

১৬.  এ জগতে হায় সে-ই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি 
রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।

ধনসম্পদ টাকা-পয়সা বাড়ানোর আকাক্সক্ষা মানুষের দুর্নিবার। তাই আকাক্সক্ষা মানুষকে লোভী করে তোলে। শত অর্জনের পরও তারা তৃপ্ত হয় না। তখন তারা গরিবের সামান্যতম সম্পদটুকু গ্রাস করে নিতে পিছপা হয় না।

ধনসম্পদ উপার্জনের অদ্ভুত রকমের তৃষ্ণা মানুষকে ক্রমাগত তাড়িত করে। যে যত পায় সে তত চায়। এই চাওয়া এবং পাওয়ার কখনো শেষ নেই। রাশি রাশি সম্পদ জমিয়ে সম্পদের পাহাড় তৈরি করে মানুষ। তারপরও সে তৃপ্ত হয় না। সম্পদ বাড়ানোর নেশায় সে দুর্দমনীয় হয়ে উঠে। ভালো-মন্দ, কল্যাণ-অকল্যাণ, সত্য-মিথ্যা ইত্যাদি জলাঞ্জলি দিয়ে বিত্ত ও বৈভবের মোহে সে দুরন্ত গতিতে ছুটে চলে। নির্বিচারে সম্পদ সংগ্রহের ফলে সে গরিবের সামান্য সম্পদের প্রতি হাত বাড়ায়। গরিবের শেষ সম্বলটুকু কেড়ে নিয়ে সে তার প্রাচুর্যকে আরও বাড়িয়ে তুলতে হয়। অন্য দিকে অনাহারক্লিষ্ট গরিব মানুষেরা তাদের সামান্য সম্বল নিয়ে নিরিবিলি জীবনযাপন করে। ক্ষুধা, দারিদ্র্য তাদের নিত্যদিনের সহচর। ধনীর ঐশ্বর্যের প্রতি তাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ থাকে না। রাজা-মহারাজাদের বিলাসবহুল জীবনের খবরাখবর তারা কখনো রাখে না। কোনো রকমে খেয়ে-পরে বাঁচার মধ্যেই তারা শান্তি খুঁজে নিতে চায়। কিন্তু, এইটুকু সুখ আর এইটুকু শান্তিতেও বাধা সৃষ্টি করে উঁচু তলার ধনিক স¤প্রদায়। তাদের অপরিসীম ধনতৃষ্ণা একসময় গ্রাস করে গরিবের শেষ সম্বল ভিটে বাড়ি। ছলে-বলে-কৌশলে অথবা শক্তি খাটিয়ে, ভুখা-নাঙা মানুষের শেষ সম্বলটুকু ছিনিয়ে এনে এরা ভয়ংকর লোভের আগুনে নিজেদেরকে আত্মাহুতি দেয়। এভাবেই দরিদ্র মানুষেরা পরিণত হয় পথের ভিক্ষুকে।

শোষিত-বঞ্চিত দুঃখী মানুষের ক্রন্দনধ্বনি আর দীর্ঘ নিশ্বাসে ভারী হয়ে উঠছে পৃথিবীর বাতাস। এজন্য প্রয়োজন সম্পদের সুষম বণ্টন ও ন্যায্য হিসাব। সামন্তবাদী আর পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার ফলে দরিদ্র মানুষের ওপর নেমে এসেছে যে অমানিশার কালো অন্ধকার, তার অবসান হওয়া উচিত।


১৭. সুশিক্ষিত লোক মাত্রই স্বশিক্ষিত।
অথবা, জ্ঞানশক্তি অর্জনই শিক্ষার উদ্দেশ্য।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলেই সুশিক্ষিত হওয়া যায় না। শিক্ষার পূর্ণতার দিকে অগ্রসর হতে হলে মানুষকে নিজস্ব প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে এবং সুশিক্ষিত হওয়ার জন্য স্বশিক্ষা বা নিজে নিজে শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। কেননা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো জ্ঞানশক্তিতে বলীয়ান হওয়া।

শিক্ষা সম্পূর্ণভাবেই অর্জনসাপেক্ষ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অর্জিত শিক্ষার একটা সীমাবদ্ধতা আছে। নির্দিষ্ট ডিগ্রি প্রদানের মধ্যেই তার দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়। তাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মধ্য দিয়ে জ্ঞানের পূর্ণতা আসে না। জ্ঞানকে আত্মস্থ করার জন্য আত্মপ্রয়াসের কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষার পরিধি বা সীমা বলতে কিছু নেই। তাই নিরন্তর জ্ঞান-অনুশীলন ছাড়া কেউ সুশিক্ষিত হতে পারে না। আমাদের সমাজে এমন অনেকেই রয়েছেন যাঁদের উচ্চতর ডিগ্রি আছে, কিন্তু দেশ ও জাতির কল্যাণে তাঁরা কিছুই করতে পারেন না। তাঁদের প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চতর ডিগ্রি থাকলেও তাঁরা স্বশিক্ষায় সুশিক্ষিত না হওয়ায় তাঁদের মধ্যে কখনোই মুক্তচিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে না। আবার অনেক স্বশিক্ষিত ব্যক্তি প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি ছাড়াও দেশ ও জাতি তথা বিশ্বমানবের কল্যাণের জন্য অনেক কিছু করে গেছেন। দৃষ্টান্তস্বরূপÑ সক্রেটিস, অ্যারিস্টটল, প্লেটো, নিউটন, গ্যালিলিও, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। তাঁরা স্বশিক্ষায় সুশিক্ষিত ছিলেন বলেই মরেও অমর হয়ে আছেন। সুশিক্ষিত লোকের মন মুক্তবুদ্ধির আলোকে উদ্ভাসিত হয়। তিনি বিজ্ঞানমনস্ক যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী হন। পরিশীলিত রুচিবোধে তিনি হন উদার ও বিনম্র। সব মিলিয়ে সুশিক্ষিত মানুষ নিঃসন্দেহে হন আলোকিত মানুষ। তাই একটি দেশ ও জাতির সার্বিক উন্নতিকল্পে স্বশিক্ষিত ও সুশিক্ষিত লোকের কোনো বিকল্প নেই।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং বাস্তব জীবন থেকে অর্জিত শিক্ষার মধ্যে ব্যাপক ফারাক আছে। এ দুয়ের মাঝে সমন্বয় ঘটলে পূর্ণাঙ্গভাবে শিক্ষিত হওয়া যায়। সুশিক্ষার জন্য নিজের উদ্যোগের প্রয়োজন হয়। একমাত্র স্বশিক্ষার মাধ্যমেই সুশিক্ষিত হয়ে ওঠা সম্ভব।


১৮. স্পষ্টভাষী শত্রু নির্বাক মিত্র অপেক্ষা ভালো।


স্পষ্টভাষী লোকদের স্বভাবের কারণে তাদের পরিচয় কারও কাছে গোপন থাকে না। অন্যদিকে নির্বাক ব্যক্তির মনে কী চলছে তা জানার উপায় নেই। এ কারণে স্পষ্টভাষী ব্যক্তি শত্রæ হলেও নির্বাক বন্ধুর তুলনায় নিরাপদ বলে বিবেচিত।

যে ব্যক্তি সত্য প্রকাশের সাহস রাখে না, সে মিত্র হলেও তাকে প্রকৃত বন্ধু হিসেবে ভাবা বা গ্রহণ করা যায় না। পক্ষান্তরে, যে ব্যক্তি সত্য কথা বলতে দ্বিধাবোধ করে না, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ও প্রতিবাদী, সে শত্রæ হলেও নির্বাক বন্ধু অপেক্ষা উত্তম। একজন সৎবন্ধু প্রত্যেকের জীবনেই কাম্য। প্রকৃত বন্ধু সুখে-দুঃখে, আনন্দ-বেদনায়, বিপদে-আপদে সুহৃদের ভ‚মিকা রাখে। কিন্তু অনেক সময় বন্ধুত্বের কারণে এবং বন্ধুত্ব নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় অনেকে বন্ধুর ত্রæটি-বিচ্যুতি নির্দেশ করে না। নীরব দর্শকের ভ‚মিকা পালন করে। ফলে মানুষ নিজেকে সংশোধন করার সুযোগ পায় না। মানুষের জীবনে স্পষ্টবাদিতা একটি মহৎ গুণ। স্পষ্টভাষী লোক শত্রæ হলেও নির্বাক বন্ধু অপেক্ষা সহস্র গুণ শ্রেয়। কারণ, যেখানে বন্ধু বন্ধুর দোষের কথা বন্ধু হওয়ায় গোপন করে, সেখানে স্পষ্টভাষী শত্রæ দোষ তুলে ধরে। তখন সে দোষ সংশোধনের বা সাবধানতা অবলম্বনের সুযোগ পায়। শত্রæর এই আচরণ প্রকৃত প্রস্তাবে মানুষের উপকারই করে। স্পষ্টভাষী শত্রæর সমালোচনা থেকে মানুষ উপকৃত হয় বলে শত্রæকে অমর্যাদা করা যথার্থ নয়। সে শত্রæ হলেও পরোক্ষভাবে উপকার করে বন্ধুর মতোই দায়িত্ব পালন করে থাকে।

স্পষ্টবাদী ব্যক্তি সবসময়ই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ও প্রতিবাদী। তাই এমন ব্যক্তি শত্রæ হলেও নির্বাক বন্ধু অপেক্ষা অনেক ভালো। সে শত্রæ হলেও স্পষ্টবাদিতার গুণে মহৎ বন্ধু।

১৯. পথ পথিকের সৃষ্টি করে না, পথিকই পথের সৃষ্টি করে।

জগতে যারা স্মরণীয় ও বরণীয় তাঁরা নিজেরাই নিজেদের পথ রচনা করেছেন। আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে অন্ধকারকে বিদূরিত করে এগিয়ে গেছে চিরকল্যাণ ও মুক্তির পথে। সত্যসন্ধানী মানুষেরা কখনো থেমে থাকে না। পথহীন পথে হেঁটে হেঁটেই তাঁরা আবিষ্কার করে নেয় আলোকিত নতুন পথ।

পার্থিব কামনা-বাসনায় পরিপূর্ণ আমাদের এ মানবজীবন। প্রাপ্তির প্রত্যাশায় জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এখানে চলছে কর্মোদ্যোগ। সাধনা এবং কর্মকুশলতাকে কাজে লাগিয়ে মানুষ তাই এগিয়ে যায় সামনের দিকে। জীবনের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য সে নিজেই খুঁজে নেয় নিজের পথ। জীবনের আঁকাবাঁকা পথে হাঁটতে হাঁটতে সে একসময় যখন পথের প্রান্তে এসে দাঁড়ায়, যখন সে দেখে তার সামনে আর কোনো পথ নেই, কেবল ঘুটঘুটে অন্ধকার; তখনো সে থেমে থাকে না। আলোর মশাল জ্বালিয়ে সৃষ্টি করে নতুন পথ। সমাজের কল্যাণের জন্য মানুষের মুক্তির জন্য যেসব মহাপুরুষ এ পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছেনÑ তাঁরা সেই তীর্থ পথের পথিক। হযরত মুহাম্মদ (স.), ঈসা (আ.), সক্রেটিস, অ্যারিস্টটল, কনফুসিয়াস এমনি বহু মহামানবের নাম এ প্রসঙ্গে বলা যায়। যাঁরা আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে পথহারা মানুষের জন্য তৈরি করে গেছেন নতুন পথ। তাঁদের আদর্শ, তিমিরবিনাশী অমর বাণী বিভ্রান্ত মানুষকে দেখিয়েছে সত্য ও সুন্দরের পথ। তাঁরা যে জীবনাদর্শ আমাদের সামনে রেখে গেছেন, তা আমাদের পরম পাথেয়। তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমরাও যদি আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হই তাহলে তাদের সম্মুখ থেকে সকল অন্ধকার কেটে যাবে। সমস্ত জঞ্জাল, সমস্ত অন্ধকার ভেদ করে উদিত হবে জীবনের সোনালি সূর্য।

আলোকপিয়াসী মানুষ কখনো গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেয় না। ভ্রান্তপথ কখনো তাকে মোহগ্রস্ত করতে পারে না। সে তারা জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দিয়ে সত্য ও কল্যাণের পথ প্রাপ্ত হয়। অন্যদেরও সেই কল্যাণের পথে আহŸান জানায়। কারণ, সে সচেতনÑ সে বিশ্বাস করে পথিকই পথের স্রষ্টা।

২০. যেখানে দেখিবে ছাই
উড়াইয়া দেখ তাই
পাইলেও পাইতে পার অমূল্য রতন।

এই মহাবিশ্বের কোনো বস্তুই তুচ্ছ নয়। অতি সাধারণ জিনিসের অন্তরালেও মূল্যবান কিছু লুকিয়ে থাকতে পারে।

ছাই অতি নগণ্য একটি বর্জ্য পদার্থ। সকলে তাকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখে। কিন্তু এই মূল্যহীন ছাইয়ের নিচে অমূল্য রতন পাওয়া বিচিত্র কিছু নয়। এর মাঝেও লুকিয়ে থাকতে পারে জ্বলজ্বলে হীরক খণ্ড, যা মহামূল্যবান। তাই রহস্যে ভরা এই পৃথিবীর কোনো কিছুকেই তুচ্ছ জ্ঞান করা ঠিক নয়। কোনো কিছুর উপরিভাগের দৈন্য কিংবা অসৌন্দর্যতা দেখে তা সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্তে আসা অনুচিত। কারণ অনেক সময়, অতি সাধারণ জিনিসের ভেতরেই অসাধারণ কিছু লুকিয়ে থাকতে পারে। এ জগৎ সংসারে অতি সাধারণ জিনিসকে আমরা অনেক সময় অবহেলা করি। ছোটকে ছোট ভেবে দূরে সরিয়ে রাখি। আবার অনেক সময় সোনার হরিণ ধরার মতো মহামূল্যবান জিনিসের পেছনে আমরা ধাবিত হই। ফলে সাধারণ জিনিসগুলো বহুকাল থেকে যায় অজ্ঞাত, অবহেলিত। অথচ অনুসন্ধান করলে এ সাধারণ জিনিসগুলার ভেতরেই অসাধারণ মহামূল্যবান জিনিসের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। যেমনÑ ঝিনুকের ভেতর পাওয়া যায় মুক্তার মতো রতœপাথর। মানুষের বাহ্যিক অবয়ব, পোশাক-পরিচ্ছদ অতি সাধারণ হলেও অনেক সময় এসবের ভেতরে বসবাস করে অতি অসাধারণ মানুষ। মিথ্যা জৌলুসের মোহে অন্ধ মানুষ এ অসাধারণ মানুষগুলোকে অনুসন্ধান করে না। অথচ মানুষের উচিত কারো বাহ্যিক আড়ম্বরে বিভ্রান্ত না হয়ে তার সত্যিকার স্বরূপ উদ্ঘাটন করা।

ছোটকে তুচ্ছ বলে অবহেলা করলে অনেক মূল্যবান সম্পদ হারানোর সম্ভাবনা থেকে যায়। তাই কোনো ব্যক্তি বা বস্তুকে মূল্যহীন ভাবা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ভেতরটা অনুসন্ধানের মাধ্যমেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা উচিত।

২১.  “শৈবাল দিঘীরে বলে উচ্চ করি শির
লিখে রেখে এক ফোঁটা দিলেম শিশির।”

সংকীর্ণ মনের অধিকারীরা উপকারীর উপকার স্বীকার করে না। যারা অকৃতজ্ঞ তারা যদি অপরের সামান্য উপকার করে তাহলে গর্বভরে সে কথা প্রচার করে বেড়ায়। কিন্তু মহৎ ও উদার মনের মানুষেরা আত্মপ্রচারে উৎসাহ পান না।

শৈবালের জন্ম এবং পরিবৃদ্ধি হয় দিঘির অথৈ জলে। নিজের অস্তিত্বের জন্য দিঘির প্রতি শৈবালের কৃতজ্ঞতাবোধ থাকা উচিত। কিন্তু শৈবাল এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। কুয়াশা ঢাকা শীতের সকালে শৈবালের গায়ে জমা হয় বিন্দু বিন্দু শিশির। প্রাকৃতিক নিয়মে সেই শিশির গড়িয়ে পড়ে দিঘির জলে। ক্ষুদ্র শৈবাল এটাকেই দিঘির প্রতি তার বড় দান হিসেবে চিহ্নিত করতে চায়। বিচিত্র এ পৃথিবীতে পরনির্ভরশীল শৈবালের মতো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মানুষের অভাব নেই। তারা আশ্রয়দাতার প্রতি সকৃতজ্ঞ নয় বরং নিজেকে জাহির করার জন্য সামান্য অবদানের কথাই জনসমক্ষে তুলে ধরতে সচেষ্ট থাকে। অথচ সেই জলভরা দিঘি অন্যের উপকার হেতু নিজেকে অকাতরে বিলিয়ে দেয়। শৈবালের মতো সে দানের হিসাব লিখে রাখতে বলে না। এখানেই ক্ষুদ্র ও মহৎ প্রাণের পার্থক্য দেখা যায়। দিঘির মতোই কোনো কিছুর প্রত্যাশা না করে পৃথিবীর মহৎ মানুষেরা পরোপকারে ব্রতী হন। অন্যের মঙ্গল সাধনাকেই তারা নিজেদের কর্তব্য বলে মনে করেন। এর বিনিময়ে তাঁরা কিছুই চান না। তাঁরা ত্যাগের মহিমা দ্বারা নিজেকে উজাড় করে দেন অপরের সুখ-শান্তির জন্য।

পরোপকারের হিসাব মনে রাখা দানশীল মহৎপ্রাণ ব্যক্তিদের ধর্ম নয়। অন্যের কল্যাণ সাধন করেই তাঁরা কৃতার্থ হন। আত্মপ্রচারের ফলে ক্ষুদ্র দানের মহিমাও ¤øান হয়ে যায়। তাই প্রত্যেকেরই উচিত, উপকারীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং নিজের উপকারের জন্য বড়াই না করা।

২২.  রাত যত গভীর হয়, প্রভাত তত নিকটে আসে
অথবা, একের শেষান্তে অপরের আবির্ভাব।

মানুষের জীবনে সুখ-দুঃখ পর্যায়ক্রমে আসে। সুখ বা দুঃখ কোনোটাই কারো জীবনে চিরস্থায়ী হয় না। চরম দুঃখ কষ্টের মাঝে যদি কেউ মনে করে তার জীবনের সুখ শান্তি খুবই নিকটবর্তী তবেই সে দুঃখ কষ্টকে জয় করতে পারে।

বিশ্ব-সংসারে সবকিছুই নিয়মের অধীন। এ ধরণীতে দিন-রাত হয় প্রকৃতির নিয়মে। স্রষ্টার এ এক অলঙ্ঘনীয় বিধান। রাতের ক্রমযাত্রা প্রভাতের নবোদিত সূর্যের দিকে। তবে এ প্রভাত সহজেই আসে না। একে আসতে হয় রাতের আঁধারকে ভেদ করে। রাত যখনই সময়ের অচলায়তন অতিক্রম করে সামনের দিকে এগিয়ে যায়, তখনই প্রভাতের অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। প্রভাত একান্তই রাতের গতিশীলতার ওপর নির্ভরশীল। অনুরূপভাবে মানবজীবনের বৈচিত্র্যময় জীবনধারার এটাই জীবনের আবর্তন। আজ যারা সুখে দিনাতিপাত করছে, তাদের সে সুখ একদিনে আসেনি। হাজারো চড়াই-উতরাই এর মাধ্যমে এসেছে। রাত এখানে দুঃখ-কষ্টের প্রতীক। প্রভাত সুখ-শান্তির প্রতীক। এই সুখ-শান্তি সহজেই পাওয়া যায় না। এজন্য মানুষকে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে হয়, পাড়ি দিতে হয় কষ্টের সমুদ্র। দুঃখ-কষ্টের প্রবহমান স্রোতই মানুষকে সুখ-সমৃদ্ধির দিকে ঠেলে দেয়। তাই বলা যায়, দুঃখ-কষ্ট যতই তীব্রতর হয়, সুখ-শান্তি ততই সহজে পাওয়া যায়।

দিবা-রাত্রির মতো মানুষের জীবনেও সুখ-দুঃখ চক্রাকারে আবর্তিত হচ্ছে এবং প্রাণপণ চেষ্টা করলে মানুষ সুখের নাগাল একদিন না একদিন অবশ্যই পাবে। যথার্থ প্রচেষ্টা থাকলে মানুষ সুখের আলোক দর্শন করবেই করবে। জীবনে মানুষ যে অবস্থারই মুখোমুখি হোক হতাশা যেন তার ওপর ভর না করে।

২৩.  “আলো বলে, অন্ধকার, তুই বড় কালো 
অন্ধকার বলে, ভাই তাই তুমি আলো।”

আলো ও অন্ধকার পরস্পর বিপরীতধর্মী হলেও একে অপরের পরিপূরক। একটির অস্তিত্ব ও মূল্য নির্ভর করে অন্যটির ওপর। আমাদের জীবনে আলো এবং অন্ধকারের মতো সুখ-দুঃখের বিচিত্র সমাবেশ ঘটে। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটির অস্তিত্ব কল্পনা করা নিরর্থক।

আমাদের এ সুন্দর পৃথিবী পরস্পরবিরোধী উপাদানসমূহের দ্বা›িদ্বক প্রক্রিয়া দ্বারা সতত সচল। জন্ম-মৃত্যু, সৃষ্টি-ধ্বংস, আলো-অন্ধকার, সুখ-দুঃখ এসবই পরস্পর বিপরীতধর্মী। কিন্তু এরা একে অপরের পরিপূরক। জন্মের পর মৃত্যু অবধারিত বলেই জীবন এত মূল্যবান। ধ্বংসের ভয় আছে বলেই মানুষ সৃষ্টিকে সংরক্ষণ করতে ভালোবাসে। পৃথিবীতে সুখের অস্তিত্ব আছে তাই মানুষ দুঃখকে হাসিমুখে বরণ করে। আর দুঃখের অস্তিত্ব আছে তাই সুখে বসবাস করার জন্য মানুষ আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। পৃথিবীতে আলো ও অন্ধকার কেউ কারও অস্তিত্বকে স্বীকার করতে পারে না। অন্ধকার ছাড়া আলো মূল্যহীন। আর আলো ছাড়া পৃথিবীও অচল। কেননা, আলো না থাকলে ঘোর অমানিশায় ডুবে যাবে এই স্বপ্নীল পৃথিবী। আলো ঝলমল উজ্জ্বল দিন ফুরিয়ে পৃথিবীতে নামে রাতের অন্ধকার। রাত এলেই আমরা অনুধাবন করি উজ্জ্বল সূর্যের গুরুত্ব। রাত ফুরালে ভোরের সূর্য যখন উঁকি দেয় পুবের আকাশে, তখন আমাদের মন নতুন আশায় ভরে ওঠে। আলো অন্ধকারকে যতই অবজ্ঞা করুক, অন্ধকার ছাড়া আলোর গৌরব এতটা উজ্জ্বলভাবে আমাদের কাছে কোনোদিন ধরা পড়ত না। মন্দ আছে বলেই তো ভালোর গুণ বিচার করা আমাদের পক্ষে সম্ভব।

প্রকৃতপক্ষে নিরবচ্ছিন্ন সমস্ত কিছুর অস্তিত্বই মূল্যহীন। দুই বিপরীতধর্মী বৈশিষ্ট্যের একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটির অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। পরস্পরবিরোধী বৈশিষ্ট্যের কারণেই জীবন ও প্রকৃতি হয়েছে কৌত‚হলোদ্দীপক ও আকর্ষণীয়।

২৪.  আত্মশক্তি অর্জনই শিক্ষার উদ্দেশ্য।

শিক্ষা মানুষের মানসিক শক্তি তৈরি করে। ভালো ও সৎকর্মের যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা অধিকারী হয় দৃঢ় মনোবলের। এ আত্মশক্তি বা দৃঢ় মনোবল অর্জনই শিক্ষার উদ্দেশ্য।

মানুষের মধ্যে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করা শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য। এর বলেই মানুষ নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠে। কিন্তু যাদের মধ্যে এ আত্মশক্তি নেই তারা কখনও স্বনির্ভরশীল হতে পারে না। যাদের সারা জীবন পরনির্ভর থেকে অন্ধকার পরিবেশে জীবন কাটাতে হয়, তারা কখনও আলোর মুখ দেখতে পারে না। সবকিছুতেই যেন তাদের সংশয় কাজ করে। প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ না করায় তারা হয় অন্তঃসারশূন্য। শিক্ষার আলোক পেয়েছে যারা তাদের দৃষ্টি বহুদূরে প্রসারিত। তারা জীবনের সঠিক পথ দেখতে পায়। জীবনের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য তাদের অন্য লোকের দ্বারস্থ হতে হয় না। তারা আত্মনির্ভরশীল হয়ে এগিয়ে চলে নিজের গতিতে। নিজের শক্তিকেই তারা সবচেয়ে বড় হাতিয়ার মনে করে। আর এ সবকিছুই সম্ভব প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছে আত্মশক্তি অর্জনের মাধ্যমে। কিন্তু এ আত্মশক্তি মানুষের মধ্যে সুপ্ত অবস্থায় বিরাজ করে। একে যথাসময়ে যথার্থরূপে আবিষ্কার করে নিতে হয়। যারা উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত; তারাই এ আত্মশক্তিকে সুপ্ত অবস্থা থেকে জাগ্রত অবস্থায় আনতে সমর্থ হয়।

শিক্ষা মানুষের জন্য জাদুর কাঠির মতো। এর স্পর্শে মানুষ মনুষ্যত্বলোকের স্বাদ পায়। নিজেকে ও আশপাশের পরিবেশকে চিনতে পেরে সে আত্মনির্ভর হয়ে ওঠে।

২৫. অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে
তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে। 

অন্যায়কারী এবং অন্যায় সহ্যকারী উভয়ই সমভাবে ঘৃণ্য। যারা আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে বিশৃঙ্খল ও অরাজক পরিস্থিতি সমাজে তৈরি করে তারা সমাজের চোখে অপরাধী। আবার যারা এই অন্যায়কে মুখ বুজে সহ্য করে তারাও অপরাধী।

মানুষ সামাজিক জীব। বিধাতা মানুষকে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে আচরণবিধি ঠিক করে দিয়েছেন। এগুলোকে আমরা ধর্মীয় বিধি-নিষেধ বলি। আবার ব্যক্তি ও সমাজজীবনের বৃহত্তর কল্যাণে ও সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য মানুষ গড়ে তুলেছে অনেক মান্য অনুশাসন ও অনুসরণীয় নিয়ম-নীতি। কিন্তু সমাজজীবনে এমন কিছু লোক থাকে যারা এসব অনুশাসন ও নিয়মনীতি মান্য ও অনুসরণ করে না; তারা অন্যকে উৎপীড়ন করে, অন্যের অধিকারে অন্যায় হস্তক্ষেপ করে, উচ্ছৃঙ্খল আচরণে সমাজকে অস্থিতিশীল করে। সামাজিক শৃঙ্খলাকে উপেক্ষা করে সামাজিক স্বার্থবিরোধী অন্যায় ও অবৈধ কর্মতৎপরতায় লিপ্ত হয়। এরা সমাজের চোখে অন্যায়কারী ও আইনের চোখে অপরাধী বলে বিবেচিত হয়। এই অপরাধ বা অন্যায়ের বিরুদ্ধাচরণ যে করে না বরং তা মেনে নেয়, সূ² বিচারে সেও অপরাধী। কেননা অন্যায়ের বিচার বা প্রতিবিধান না হলে তার মাত্রা বেড়ে যায়। ফলে মানুষের পক্ষে সমাজে বসবাস করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এই অবস্থার জন্য অন্যায় সহ্যকারীর দায়িত্বকে অস্বীকার করার উপায় নেই। অবশ্য অপরাধীকে ক্ষমা করার মহৎ গুণের কথাই এ প্রসঙ্গে উঠতে পারে, কিন্তু মনে রাখতে হবে ক্ষমারও নির্দিষ্ট মাত্রা ও সীমা থাকা দরকার। অন্যায় করে যদি কেউ অনবরত ক্ষমা পেতে থাকে, তাহলে দিন দিন তার অপরাধপ্রবণতা প্রবল হয়ে উঠবে। তার স্বেচ্ছাচারিতার মাত্রা ক্রমেই বেড়ে যাবে। দিন দিন বাড়বে তার শক্তি ও সাহস। শাসনযন্ত্রেও সে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হবে এবং শেষ পর্যন্ত দুর্বিনীত অন্যায়কারী সবার কাছ থেকে সমীহ পেতে ব্যস্ত হয়ে উঠবে। ফলে সমাজে বিশৃঙ্খল অবস্থা ও অস্থিরতা বিরাজ করবে।

অন্যায়কারী ও অন্যায়কে প্রশ্রয়দানকারী উভয়েই সমান অপরাধী। ক্ষমার দুর্বলতাকে সম্বল করে কেউ যেন অন্যায় কাজে প্রবৃত্ত হতে না পারে সে ব্যাপারে আমাদের সচেতন থাকতে হবে। অন্যায়কারী এবং অন্যায় সহ্যকারী উভয়কেই আমরা ঘৃণার চোখে দেখব।

২৬. সেই ধন্য নরকুলে লোকে যারে নাহি ভুলে 
মনের মন্দিরে নিত্য সেবে সর্বজন। 

পৃথিবীতে মানুষ স্মরণীয় ও বরণীয় হয় তার মহৎ কর্মের মধ্য দিয়ে। মানুষের কল্যাণ সাধনায় যারা জীবন উৎসর্গ করেন তারা মানুষের সর্বাধিক প্রিয় হয়ে ওঠেন। তারা হয়ে ওঠেন আত্মার আত্মীয়। তাই তাদের কেউ ভুলতে পারে না। তারা পৃথিবীতে অমর হন।

আমাদের সমাজে মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেয় তার স্বীয় কীর্তিময় অবদান। কিন্তু অর্থবিত্ত দ্বারা সেই স্থান অর্জন সম্ভব নয়। তারাই মহাপুরুষ যাদের জীবন পবিত্র ও মহৎ কর্মে চির প্রাণবন্ত ও উচ্ছল। কোনো কোনো মানুষ শতাধিক বছর জীবিত থেকেও তাদের মতো ইতিহাসে পাতায় নাম লেখাতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে, কর্ম মানুষকে মহৎ করে তোলে। এসব মহাপুরুষের জীবন ও সাধনাই স্মরণ মননের যোগ্য। কারণ তা বৃহত্তর মানবসমাজকে মুক্তি, মৈত্রী ও শান্তির পথ দেখাতে সাহায্য করে। অন্য দিকে, এসব প্রতিভাবানরা তাঁদের কর্মের মহিমায় বিশ্বজগৎকে সুশোভিত করেন। সুমহান কর্মের মাধ্যমে আনন্দ, সুখ ও সমৃদ্ধির বহু অজানা দিগন্ত উন্মোচিত করেন, দেখান মুক্তির পথ। মানুষমাত্রই মরণশীল। ক্ষণভঙ্গুর এ জীবনে সত্যের সন্ধানে হযরত মুহম্মদ (সা.), ঈসা (আ.), মুসা (আ.), চৈতন্যদেব প্রমুখ জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তারা কোনো নির্দিষ্ট স্থান ও কালের মানুষ ছিলেন না, ছিলেন সর্বযুগের ও সর্বকালের। তারা জগতে মহাপুরুষরূপে অগণিত মানুষের প্রীতি ও ভালোবাসা লাভ করেছেন। তাদের জন্যই যুদ্ধ-বিগ্রহসঙ্কুল এ পৃথিবী বসবাসের উপযোগী হয়েছে। তাঁদের মানবকল্যাণ কর্ম ও চিন্তা দ্বারা বিপথগামীরাও সুপথে পরিচালিত হয়। আর সভ্যতার ইতিহাসে তাঁরাই সৌভাগ্যবান পুরুষ হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকেন। এসব বীর্যবান পুরুষ শারীরিকভাবে মৃত্যুবরণ করলেও ইতিহাসের পাতায় অবিনশ্বর ও চির অ¤øান হয়ে আছেন। পরবর্তী বংশধরেরা সেই সব মহাপুরুষের নাম স্মরণ করে, মহৎ জীবনের স্বর্ণতোরণে উপস্থিত হয়।

কাজেই জীবনে মহৎ কিছু করতে হলে, যারা স্মরণীয় তাদের পথ অনুসরণ করে চলা উচিত। সকলের জন্য মনের মধ্যে মমত্ববোধ এবং প্রেমভাব জাগিয়ে তোলাই জীবনকে ধন্য করার উপায়।


২৭.  বিশ্রাম কাজের অঙ্গ এক সাথে গাঁথা 
নয়নের অংশ যেন নয়নের পাতা।

পৃথিবীতে উন্নয়ন ও অগ্রগতি সাধিত হচ্ছে মানুষের পরিশ্রম বা কাজের মধ্য দিয়ে। কিন্তু এই কঠিন পরিশ্রম মানুষ একটানা করতে পারে না। কাজ বা পরিশ্রমের পাশাপাশি বিশ্রাম গ্রহণ প্রয়োজন। একটি আরেকটির পরিপূরক।

কাজ এবং বিশ্রাম অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কাজ বা পরিশ্রমই সৌভাগ্যের প্রসূতি। পরিশ্রমের ফলেই জীবনে সুখ ও সমৃদ্ধি আসে। আর পরিশ্রমের শেষে বিশ্রাম ফিরিয়ে আনে উদ্যম ও শক্তি। বিশ্রাম সমস্ত ক্লান্তি ও অবসাদকে নাশ করে এবং দেহ ও মনকে কাজের জন্য নতুনভাবে সতেজ করে। পরিশ্রমের পর শ্রান্ত ও ক্লান্ত দেহে উদ্যম ফিরিয়ে আনার জন্য যেমন বিশ্রামের প্রয়োজন, তেমনি বিশ্রামের পরে দেহের কর্মস্পৃহাকে সচল ও সজীব রাখার জন্য নিয়মিত শ্রমেরও প্রয়োজন। দেহের জন্য একটানা পরিশ্রম যেমন ক্ষতিকর, তেমনি একটানা বিশ্রামও সুখকর নয়। একটানা বিশ্রাম জীবনকে অলস, অচল ও কর্মবিমুখ করে তোলে। পক্ষান্তরে, একটানা পরিশ্রমের ফলে দেহ-মনে ভর করে অবসাদ, এর ফলে লুপ্ত হয় দেহের কর্মক্ষমতা। চোখের পাতা যেমন চোখের জন্য অপরিহার্য অঙ্গ, তেমনি বিশ্রামও পরিশ্রমের জন্য অপরিহার্য। শুধু পরিশ্রমী ব্যক্তিই বিশ্রামের আনন্দ অনুভব করতে পারে। এ আনন্দ তার কাছে স্বর্গের সুধার মতো। যারা পরিশ্রম করে না তারা বিশ্রামের আনন্দও অনুভব করতে পারে না। সুতরাং বিশ্রাম ছাড়া কাজ এবং কাজ ছাড়া বিশ্রামের কোনো সার্থকতা নেই।

বিশ্রামকে তাই কাজের অঙ্গ বলা হয়েছে। একটি ছাড়া অন্যটি অর্থহীন; কেননা শুধু কাজ কিংবা শুধু বিশ্রাম কোনোটাই জীবনের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে না। তাই কাজের পাশাপাশি বিশ্রাম ও বিশ্রামের পাশাপাশি কাজ অপরিহার্য। এই অভ্যাসের মধ্য দিয়েই মানুষের জীবন সার্থকতার দিকে এগিয়ে যায়।

২৮. সংসার সাগরে দুঃখ তরঙ্গের খেলা 
আশা তার একমাত্র ভেলা। 

জীবন সংগ্রামে মানুষ আশায় বুক বাঁধে। আশায় ভর করেই মানুষ সম্মুখে এগিয়ে যায়। অথবা আশাই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। আশা বা প্রত্যাশাই তার স্বপ্ন। আশাই তার কর্মের প্রেরণা জোগায়। আশার ভেলায় চড়েই সে জীবনসমুদ্রে পাড়ি জমায়।

মানুষের জীবনে চলার পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়। এখানে দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত নিত্য নতুন দুঃখ-দুর্দশার সাথে চিরন্তন সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হয়। মনীষীরা সংসারটাকে সীমাহীন সমুদ্রের সাথে তুলনা করেছেন, আর সেই সমুদ্রে নিরন্তর আছড়ে পড়ে দুঃখের তরঙ্গমালা। বাস্তবকে মেনে নিলে দুঃখের অমানিশা কেটে একদিন সুখের সোনালি সকাল জীবনে আসবেই। এ আশাতেই মানুষ স্বপ্ন দেখে। দুঃখের দিনে আশাই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের মতো এই পৃথিবীর সীমাহীন দুঃখের সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার জন্য ভেলা যেমন একমাত্র ভরসা তেমনি আশাই হচ্ছে জীবন সংসারের অবলম্বন। মানুষ সুখের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে। কিন্তু সুখ পাখির নাগাল পাওয়াও যে বড় কষ্ট। সোনার হরিণের মতো সুখ শুধু পালিয়ে বেড়ায়; কিন্তু মানুষ হাল ছাড়ে নাÑ আপ্রাণ চেষ্টা করে তাকে ধরতে। সহস্র দুঃখ-বেদনা আর প্রতিক‚লতার মধ্যেই মানুষ রুখে দাঁড়ায়, সংগ্রামে ব্রতী হয়। কিন্তু তার এই প্রচেষ্টা অনেক সময় ব্যর্থ হয়, সুখ থাকে নাগালের বাইরে। তবু মানুষ স্বপ্ন দেখে আশার ভেলায় ভর করে। কেউ বলে আশা সে তো মরীচিকা, মাইকেল মধুসূদন হাহাকার করে বলেনÑ ‘আশার ছলনে ভুলি, কী ফুল লভিনু হায়, তাই ভাবি মনেÑ’ কিন্তু আশার অমৃত রসেই উজ্জীবিত হয় মানুষ। আশা না থাকলে মানুষের পক্ষে সংসারধর্ম পালন করা সম্ভবপর হতো না। কেউ কোনো কাজ করত না, মানবজীবনের অস্তিত্ব হয়ে পড়ত বিপন্ন। আশা আছে বলেই মানুষের জীবন গতিশীল। আশাই মানুষকে টিকিয়ে রাখে সোনালি ভবিষ্যতের জন্য। মানুষ যখন চাওয়া পাওয়া হতাশার দ্ব›েদ্ব দোদুল্যমান ঠিক তখনই আশা মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যায় সম্মুখ পানে।

আশা নামের এক অনির্বাণ শিখার আলোকে মানুষ অন্ধকারে খুঁজে নেয় পথ। সংসার সমুদ্রে মানুষ অক্লান্ত প্রচেষ্টার দ্বারা মানুষ সুখ, সমৃদ্ধি ও কল্যাণ লাভ করে। হতাশাগ্রস্ত মানুষের জীবনে সফলতা নেই। সকলকেই তাই হতে হবে আশাবাদী প্রাণবন্ত মানুষ।

২৯. “উত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সাথে
তিনিই মধ্যম যিনি চলেন তফাতে।”

উত্তম ব্যক্তির মাঝে তাঁর চরিত্র মাধুর্য যেমন থাকে তেমনই থাকে তার মনের প্রশস্ততা। তাই সে কলঙ্ক, দুর্নাম ও অপবাদের ভয় করে না। কিন্তু মধ্যম শ্রেণির লোক অধমের সাথে ব্যবধান রেখে চলে পিছে মানুষ তাকে অধম জ্ঞান করে।

চরিত্র, প্রবৃত্তি এবং প্রবণতা অনুযায়ী মানুষকে উত্তম, মধ্যম এবং অধম-এ তিন শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। যারা উত্তম চরিত্রের অধিকারী তারা সৎ, সাহসী এবং আদর্শবান। তারা বরাবরই দৃঢ় ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তাই তারা নিশ্চিন্তে অধম, পতিত এবং অসৎ ব্যক্তিদের সাথে মিশতে পারেন। এতে করে তিনি ছোট হয়ে যান না বা চরিত্র কলুষিত হবে এমন কোনো ভয়ও তার থাকে না। কারণ তিনি মিথ্যা অপবাদের ভয় করেন না। সে আলোকের কাছে যদি অন্ধকার থাকে তাহলে আলোকের কোনো ক্ষতি হয় না। বরং অন্ধকারই দূরীভ‚ত হয়। চরিত্রবান উত্তম ব্যক্তিদের আমরা পরশপাথরের সাথে তুলনা করতে পারি। পরশপাথরের সান্নিধ্যে এসে সাধারণ পাথরও সোনা হয়ে যায়। তেমনি চরিত্রহীন অধম ব্যক্তি যদি উত্তম ব্যক্তির সংস্পর্শে আসে তাহলে তার জীবনের রূপরেখা পাল্টে যেতে পারে। সকল ধরনের অন্যায় ও অসত্য পরিহার করে সেও শুদ্ধ জীবনযাপন শুরু করতে পারে। কিন্তু সমাজে যারা মধ্যম শ্রেণির মানুষ, তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ততটা উন্নত নয়। ফলে অসৎ মানুষের সঙ্গে যখন তারা মিশতে যায় তখন সব সময় তারা কলঙ্কের ভয়ে ভীত থাকে। তাই তারা অধম ব্যক্তির সংশ্রব সযতেœ এড়িয়ে চলে। এর ফলে তাদের পক্ষে কোনো মহৎ কাজ করা সম্ভব হয় না। আমাদের এই সমাজে ভালো এবং মন্দ উভয় প্রকার মানুষের বাস। মধ্যম ব্যক্তিরা শুধু ভালো মানুষের সাথে চলতে চায়। মন্দকে ভালো করার কঠিন চেষ্টায় তাঁরা কখনো আত্মনিয়োগ করেন না। তাঁরা কলঙ্ক থেকে শত হাত দূরে থাকতে চান এবং মন্দ লোক সম্পর্কে এক ধরনের ছুঁতমার্গে ভোগেন। ফলে তার থেকে সমাজ কিছুই পায় না। কিন্তু উন্নত চরিত্রের অধিকারী যাঁরা তাঁরা কখনো স্বার্থপরের মতো জীবনযাপন করেন না। কল্যাণের জন্য তাঁরা নিজেদের উৎসর্গ করেন। মিথ্যাকে, জরাকে, অসত্যকে যারা আঁকড়ে পড়ে আছে, তাঁদেরকেই তাঁরা শোনান সত্যের বাণী। জগতের সব মহামানবের অধমের মাঝেই জন্ম নিয়েছেন। তাঁদের সংস্পর্শে অধম পরিণত হয়েছে উত্তমে।

আত্মকেন্দ্রিক এবং আপসকামী শ্রেণির মানুষ সমাজে মধ্যম হিসেবে বিবেচিত। গা বাঁচিয়ে চলতেই তাঁরা ভালোবাসেন। কিন্তু উত্তম ব্যক্তিরা সত্যসন্ধানী। তাঁরাই অধমকে আলোর পথ দেখান। তাই অধমের সাথেই মিলেমিশে চলতে তাঁরা কুণ্ঠাবোধ করেন না।


৩০. শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড।  
অথবা, 
শিক্ষাই জাতির উন্নতির পূর্বশর্ত।

শিক্ষা এমন এক পরশ পাথর যার ছোঁয়ায় একটি জাতি পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। মেরুদণ্ডহীন মানুষ যেমন কল্পনা করা যায় না, তেমনি শিক্ষাহীন কোনো জাতিকেও গণনা করা হয় না।

সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশের ক্ষেত্রে শিক্ষার বিকল্প নেই। শিক্ষার মাধ্যমে জাতি কুসংস্কার, জড়তা ও হীনতা থেকে মুক্ত হয়ে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। এক্ষেত্রে আদর্শ শিক্ষাই জাতিকে দিকনির্দেশনা দিতে পারে। বর্তমান শিক্ষা-দীক্ষায় অগ্রগামী জাতিগুলোই বিশ্বকে পরিচালিত করছে। শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনা ছাড়া কোনো জাতি বড় হতে পারে না। শিক্ষাহীন জাতি মেরুদণ্ডহীন প্রাণীর মতো। মেরুদণ্ডহীন মানুষ জীবন্মৃতের মতো সংসারে জীবনযাপন করে, তার দ্বারা যেমন সমাজ ও দেশের কোনো উন্নতি আশা করা যায় না, তেমনি শিক্ষাহীন জাতিও পদে পদে পঙ্গু হয়ে পড়ে। তাই শিক্ষা একটি জাতির জীবনে মেরুদণ্ড। মেরুদণ্ডহীন মানুষ যেমন এ জগতে অপ্রয়োজনীয়, তেমনি শিক্ষাহীন জাতিও পৃথিবীতে পতিত। নিজেকে চেনার জন্য যেমন শিক্ষা প্রয়োজন, তেমনি জাতীয় অগ্রগতি শিক্ষা ছাড়া অসম্ভব। শিক্ষা মানুষের মানবিক গুণাবলিকে বিকশিত করে এবং তার মাঝে সুকুমার প্রবৃত্তির স্ফ‚রণ ঘটায়। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ যে জ্ঞান অর্জন করে তা দিয়ে সে জীবনকে ঠিকমতো গড়ে নিতে পারে। উপযুক্ত শিক্ষাগ্রহণ না করলে মানুষ অন্ধকারেই নিমজ্জিত থাকে। প্রাকৃতিক নিয়মে মানুষ জন্মগ্রহণ করলেও মূলত শিক্ষার মাধ্যমেই সে নিজেকে আবিষ্কার করে। যারা নিজেকে নিজে আবিষ্কার করতে পারে না, তারা পেছনে পড়ে থাকে। এ পিছিয়ে পড়া ব্যক্তিরাই জাতিকে এগিয়ে যেতে বাধা সৃষ্টি করে। অশিক্ষিত মানুষ মানেই হচ্ছে অসচেতন এবং অসম্পূর্ণ মানুষ। এ পর্যায়ে পশু ও তার মাঝে বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। তাই শিক্ষাকে জাতীয় জীবনের মেরুদণ্ড বলা হয়ে থাকে, কারণ শিক্ষার প্রভাবেই মানুষ কুসংস্কার, জড়তা ও হীনতা মুক্ত হয়ে জাতিকে শক্তিশালী করতে পারে।

শিক্ষায় অগ্রসরতার মানদণ্ডে একটি জাতি চিহ্নিত হতে পারে। শিক্ষার মাধ্যমেই কোনো জাতি নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছতে পারে। একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে পৃথিবীর বুকে পরিচিতি লাভ করতে হলে শিক্ষার বিকল্প নেই।

৩১. কীর্তিমানের মৃত্যু নেই।

মহাকাল সব কিছুকে ধ্বংস করে দেয়। তারপরও কোনো কোনো কর্ম, ত্যাগ, সৃষ্টি কখনো বিলীন হয় না। তেমনি কোনো কোনো মহৎ কার্যাবলির মাধ্যমে মানুষ মানব জগতে চির অমর হয়ে থাকেন।

মানবজীবন বিলয়ের অধীন; কিন্তু ধ্বংসের অধীন হয়েও কল্যাণময় কার্যাবলির মাধ্যমে অবিনশ্বর হওয়া যায়। অমরত্ব লাভের একমাত্র পথ নিজস্ব কার্যাবলি। কর্মই মানবজীবনকে মহিমান্বিত করে; বয়সের মধ্যে মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না; কারণ তাকে মরতে হবে। মরার পর কেউ তাকে স্মরণ করবে না, বরং সে যদি এ ক্ষুদ্র পরিসরের জীবনে মানবকল্যাণের জন্য কীর্তির স্বাক্ষর রেখে যেতে পারে তবে সে মরে গিয়েও চিরকাল মানব হৃদয়ে অমর হয়ে থাকে। মানুষের দেহের মৃত্যু আছে কিন্তু তার মহত্ব, কীর্তি ও মহিমার কোনো মৃত্যু নেই। তা যুগ যুগ ধরে মানুষের মাঝে চির অ¤øান হয়ে থাকে। দৈহিক মৃত্যু ঘটলেও তাদের কীর্তির মৃত্যু হয় না। মহামানবেরা তাদের নিজেদের স্বার্থের জন্য কিছুই করেন না। পরের জন্য তারা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে। এ পৃথিবী সৃষ্টি হওয়ার পর এ পর্যন্ত অনেক মানুষই জন্মগ্রহণ করেছে ও পরের জন্য তারা নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। কিন্তু তাদের মধ্যে খুব অল্পসংখ্যকই কর্মগুণে মানুষের হৃদয়ে সমাসীন রয়েছেন। একমাত্র যারা মহত্ব অর্জন করতে পেরেছেন তাদের জীবনই সার্থক। এভাবে কীর্তিমান ব্যক্তিত্ব তাদের সৎকর্মের জন্য অমরত্ব প্রাপ্ত হন। এসব লোকের দৈহিক মৃত্যু হলেও প্রকৃতপক্ষে তারা অমর। সর্বদাই তাঁরা মানবের অন্তরে বিরাজ করে। মানুষ তাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে এবং তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। কীর্তিমান ব্যক্তিবর্গের জীবনদর্শন যুগ যুগ ধরে মানুষের পথপ্রদর্শক হয়ে থাকে। সক্রেটিস, প্লেটো, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গ্যালিলিও প্রমুখ কীর্তিমান ব্যক্তিবর্গের মৃত্যু হয়েছে বহুদিন; কিন্তু আজও তারা চিরভাস্বর মানুষের হৃদয়ে।

মানুষ বেঁচে থাকে তার কর্মের মধ্যে, বয়সের মধ্যে নয়। যেসব কীর্তিমান ব্যক্তি মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ করে মৃত্যুবরণ করেছেন তাঁরা অমর।

৩২. মঙ্গল করিবার শক্তিই ধন, বিলাস ধন নহে।

বিলাস ব্যসন নয়, মানবকল্যাণে ব্যয়িত অর্থই প্রকৃত ধন। বস্তুগত অর্থের যত উপযোগিতাই থাক না কেন, তা দ্বারা মানবসমাজের যত পরিবর্তন হোক না কেন, মানুষ যতটুকুই তৃপ্তি লাভ করুক না কেন, মনের উদারতা ও মানব মঙ্গলের চেয়ে মূল্যবান ধন আর নেই।

মানব সমাজ আজন্ম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। এর একটি দিক হচ্ছে কিভাবে, কতটুকু অর্থের পাহাড় গড়ে তোলা যায় এবং তা নিজের কিংবা মানবসমাজের হিতকর উদ্দেশ্যে ব্যয় করা যায়। অর্জিত কিংবা প্রাপ্য ধন-সম্পদের সার্থকতা নির্ভর করে এর যথার্থ ব্যবহারের ওপর। অর্জিত অর্থ চরম ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে পারে। তা ব্যক্তিকে তৃপ্ত করতে পারে, কিন্তু পূর্ণতা দিতে পারে না। কেননা এ অর্থে মানবকল্যাণ সাধিত হয়নি। ব্যক্তিক প্রয়োজনে ব্যয়িত অর্থে ব্যক্তির প্রয়োজন শুধু মেটে না, অনেক সময় অতি অর্থের সমাগমে সে সমাজের ভারসাম্য নষ্ট করেই ক্ষান্ত হয় না; সমাজ এমনকি নিজের জন্যও মহাক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এসব অর্থ ধন নয় এবং তা কখনোই জাতীয় শক্তির উৎস হতে পারে না। ধনীর ধন তা উপার্জিতই হোক কিংবা দানের মাধ্যমেই অর্জিত হোক, তাতে সমাজের সাধারণ মানুষেরও অল্পবিস্তর অধিকার রয়েছে। সমাজ, সমাজের মানুষ এবং নিরন্নদের বঞ্চিত করে কেবল নিজস্ব ভোগ-বিলাসে যে অর্থ মানুষ ব্যয় করছে তা ধন নয়। মহামানবদের দৃষ্টান্ত থেকে দেখা যায় যে, এদের অনেকেই ধন-সম্পদের অধিকারী ছিলেন না। তাদের যতটুকু সম্পদ ছিল তা মানবকল্যাণে ব্যয় করেছেন। ধনের অন্তর্নিহিত তাৎপর্যই হচ্ছে মানবমঙ্গলের জন্য তা উৎসর্গ করা। বিলাসিতায় ব্যয়িত অর্থ অপব্যয় মাত্র; ধন নয়। সহজ কথায় অর্থের কোনো স্থায়িত্ব নেই। সুতরাং একে ধন বলা যাবে না। মানবমঙ্গল ভাবনা মানব চরিত্রের মহান বৈশিষ্ট্য। এ প্রবণতা মানবজীবনে সম্পদ বলে বিবেচিত হতে পারে।

প্রকৃত ‘ধন’ তাই যার দ্বারা মানবতা উপকৃত হয়; মানবমঙ্গল বিধান করা যায়। সৎপ্রেরণা থেকে উৎসারিত কর্ম ও অর্থ ব্যয়ই প্রকৃত ধন।


৩৩. দ্বার রুদ্ধ করে দিয়ে ভ্রমটাকে রুখি
সত্য বলে, আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি? 

সত্য মানবজীবন অমৃতের মতো, কিন্তুু এটি সহজলভ্য নয়। ভুল-ভ্রান্তিকে বাদ দিয়ে নিছক সত্যানুসন্ধান করলে দুর্লভ সত্যকে খুঁজে পাওয়া কঠিন। কেননা, সত্য অবিমিশ্র নয়; মিথ্যার পাশেই তার অবস্থান।

সত্যের অনুসন্ধান এবং তা লাভ করা মানবজীবনের পরম এবং একমাত্র লক্ষ্য হলেও তা অর্জন করা কঠিন। কারণ মানবজীবন মাটির কলসে তোলা কোনো পবিত্র পানি নয়, তা নদীর প্রবহমান জলধারা এবং সেখানে থাকে অনেক আবিলতা। এর মধ্যে থেকে মানুষকে পানের যোগ্য পানিটুকু ছেঁকে নিতে হয়। সত্যও নদীর জলধারার মতো। তার সঙ্গে মিশে থাকে অনেক মিথ্যা এবং ছলনা। সত্য ও মিথ্যা পাশাপাশি অবস্থান করে। এ দুটি এমন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত যে একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটি উদ্ঘাটন করা সম্ভব নয়। আলোর সঙ্গে অন্ধকার যেমন জড়িত, তেমনি সত্যও মিথ্যা দ্বারা আবৃত। জীবনের কণ্টকিত পথে চলতে চলতে মানুষ সকল ভুল-ভ্রান্তি ও মিথ্যাকে অতিক্রম করে একসময় সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ায়; জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা দ্বারা অর্জন করে পরম সত্যকে। যারা ভুল-ভ্রান্তিগুলোকে অতিক্রম না করে শুধু সত্য লাভ করতে চায়, তারা দুর্লভ সত্যের সন্ধান কখনো পায় না। সত্যকে আবিষ্কারের জন্য রূঢ় বাস্তবের দৃপ্ত পদচারণ প্রয়োজন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিষধর সাপের মস্তক থেকে যেমন উদ্ধার করতে হয় মূল্যবান মানিক, তেমনি ভুল-ভ্রান্তি এবং পঙ্কিলতা থেকে উদ্ঘাটন করতে হয় হিরণ¥য় সত্যকে। শিশু যেমন আছাড় খেতে খেতে হাঁটতে শেখে, মানুষও তেমনি ভুল-ভ্রান্তির মধ্য দিয়ে সত্যকে চিনে নেয়। মিথ্যা ছাড়া সত্যের অস্তিত্ব অকল্পনীয়। অন্তত মানবজীবনে এটি সত্য। মানুষের ভুল হবেই। তবে সে ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা প্রয়োজন। দিনকে যেমন রাতের সঙ্গে তুলনা করেই চেনা যায়, তাপকে যেমন শৈত্যের সঙ্গে তুলনা করে অনুভব করা যায় সত্যকেও তেমনি মিথ্যার পাশাপাশি রেখেই নির্ণয় করতে হয়। এজন্য প্রয়োজন মুক্তবুদ্ধির চর্চা করা। উদারনৈতিক মনোভাব ও অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টির মাধ্যমে মানুষ সত্যকে উপলব্ধি করতে পারে; কেবল মিথ্যা, পঙ্কিলতা থেকে নিজেকে দূরে রাখার মধ্য দিয়ে নয়। মন্দের ভয়ে যদি কেউ মনের দ্বারই বন্ধ করে রাখে তাহলে তিনি প্রার্থিত বস্তুটি লাভ করতে পারেন না।

সত্য কিংবা মিথ্যাকে নিরবচ্ছিন্নভাবে উদ্ঘাটন করা সম্ভব নয়। একটি আরেকটির সাথে এমনভাবে জড়িয়ে আছে যেন একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।

৩৪. জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর

স্রষ্টার সৃষ্ট জীবকে ভালোবাসলেই স্রষ্টার সেবা করা হয়। স্রষ্টাকে পাওয়ার উত্তম পথ হচ্ছে তাঁর সৃষ্টিকে ভালোবাসা। স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করেছেন। তাই তাঁকে খুশি করতে হলে তাঁর সৃষ্টিকুলকে খুশি করতে হবে।

শুধু ঈশ্বরের প্রার্থনা করলেই তাঁকে পাওয়া যায় না বা নির্জনে বসে আল্লাহর ধ্যানে মত্ত থাকলেও ধর্ম পালন করা হয় না। তাঁর সৃষ্ট জীবের প্রতি সদয় হলেই তাঁকে ভালোবাসা হয়। কোনো মানুষ যদি ঈশ্বরকে পেতে চায় তবে ঈশ্বরের সৃষ্টি অন্য জীবকুলের প্রতি তাকে দয়া প্রদর্শন করতে হবে। সকল ধর্মেই সৃষ্টকুলকে ভালোবাসার কথা বলা হয়েছে। কোনো ধর্মেই বলা হয়নি যে, মানুষ মানুষকে বা অন্য কোনো প্রাণীকে ঘৃণা করবে। তাই সকল জীবকে ভালোবাসার মাধ্যমেই আমরা ঈশ্বরকে ভালোবাসতে পারি। পবিত্র ধর্মগ্রন্থেও বলা হয়েছে যে, তোমরা যদি আমাকে ভালোবাসতে চাও তবে আমার সৃষ্টিকুলকে ভালোবাস। এতে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, সৃষ্টিকুলকে ভালোবাসার মাধ্যমে তাঁর সান্নিধ্য লাভ করা যায়। পবিত্র বৌদ্ধধর্মে বলা হয় ‘পৃথিবীর সকল প্রাণী সুখী হোক।’ মহান সৃষ্টিকর্তা মানুষকে জ্ঞান, বিবেক ও বুদ্ধি দিয়ে আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। তাই শ্রেষ্ঠ জীব হয়ে জন্মগ্রহণ করেও যদি অন্য প্রাণীর প্রতি যতœবান না হওয়া যায় তবে মনুষ্যত্ব লাভ করা যায় না। মনুষ্যত্ব মানুষকে দান করে হিরণ¥য় দ্যুতি। যার আলোয় মানুষ পথ চলতে পারে। পৃথিবীতে অসংখ্য দীন-দরিদ্র মানুষ ও ঐশ্বর্যশালী মানুষের সাহায্য ও ভালোবাসা প্রত্যাশা করে। আর এসব দুস্থ, কাঙাল, অসহায় মানুষের প্রতি সহানুভূতি দেখালে স্রষ্টার সন্তুষ্টি বিধান করা হয়। শুধু আর্তমানবকে নয়; পশুপাখির মতো মূক ও অসহায় প্রাণীকেও ভালোবাসতে হয়। আজকের পৃথিবীতে যে নৈরাজ্য তার মূলে রয়েছে জীবের প্রতি জীবের ভালোবাসার অভাব। আর তাই আমরা যদি মানুষের প্রতি মানুষ, জীবের প্রতি জীব, প্রাণীর প্রতি প্রাণী সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিই তবেই পৃথিবী হবে সুন্দর, সুশৃঙ্খল।

স্রষ্টাকে পাওয়ার উত্তম পথ হচ্ছে তাঁর সৃষ্টিকে ভালোবাসা। যদি তার সৃষ্টিকে ভালোবাসা যায় তবেই হবে ঈশ্বরকে ভালোবাসা, তবেই জীবন হবে অর্থপূর্ণ।

৩৫. গ্রন্থগত বিদ্যা আর পরহস্তে ধন, নহে বিদ্যা নহে ধন হলে প্রয়োজন।

ধন-সম্পদের সার্থকতা সদ্ভাবে ব্যয়ে আর বিদ্যার সার্থকতা মানসিক বিকাশ ও জগতের কল্যাণ সাধনে। কিন্তু বিদ্যা যদি বইয়ের পাতায় আবদ্ধ থাকে, চর্চা ও অনুশীলনের অভাবে কর্মক্ষেত্রে তার ব্যবহার না হয় তবে বাস্তবজীবনে সে বিদ্যার কোনো মূল্য নেই।

বই হচ্ছে জ্ঞানের ধারক ও বাহক। বই পাঠ করে মানুষ তার জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে পারে। কিন্তু বিদ্যাকে আয়ত্ত না করে কেবল গ্রন্থগত করে রেখে দিলে বা বইয়ের তাকে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখলে তা অর্থহীন হয়ে পড়ে। কারণ গ্রন্থগত বিদ্যা মানুষের প্রয়োজনের সময় কোনো কাজেই আসতে পারে না। অনুরূপ প্রয়োজনের সময় অর্থ-সম্পদ অপরের কাছে রেখে তা নিজের মনে করাটাও বোকামির শামিল। প্রয়োজনের সময় সে অর্থ কোনো কাজে আসে না। গ্রন্থকে সুসজ্জিত বইয়ের তাকে সাজিয়ে রেখে অনেকেই নিজেকে মহাজ্ঞানী ভাবেন। কিন্তু সেটা বোকামিরই পরিচয় বহন করে। আমাদের দেশের অনেক ছাত্রই বইপত্র কিনে টেবিল ভর্তি করে রাখে বা মুখস্থ করে পরীক্ষায় পাস করে বটে; কিন্তু তাতে তাদের প্রকৃত জ্ঞান আহরণ হয় না। আর তাই পরক্ষণেই সব কিছু ভুলে যায়। ধনসম্পদ বলতে বোঝায় যা মানুষের জীবনকে সুন্দর ও সচ্ছলরূপে পরিচালনার জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করে এবং জাগতিক সৌন্দর্য বৃদ্ধিতেও সাহায্য করে। অথচ সেই অর্থ যদি নিজের কাছে না রেখে বা গুদামজাত করে প্রয়োজনের মুহূর্তে না পাওয়া যায় তবে সে ধনসম্পদ নিরর্থক। তাতে কষ্টই বাড়ে, সমাধান হয় না। পুথিতে যে জ্ঞান আবদ্ধ থাকে আর পরের হাতে রক্ষিত ধন থাকে দুটিই সমান। দরকারের সময় সে বিদ্যা বিদ্যা নয়; সে ধন ধন নয়।

বিদ্যা ও সম্পত্তি সাধনার মাধ্যমে অর্জন করতে হবে। গ্রন্থগত বিদ্যাকে অধিকার করতে না পারলে যেমন কোনো লাভ নেই, তেমনি অপরের হাতে অর্থ-সম্পদ আছে জেনে কোনো কাজে হাত দেওয়াও ঠিক নয়।

৩৬. স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন।

অনেক ত্যাগ ও তিতিক্ষার বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করা একটি পরাধীন জাতির জন্য অনেক কঠিন কাজ। কিন্তু স্বাধীনতার যথার্থ মূল্য দিয়ে তাকে রক্ষা করা আরো বেশি কঠিন কাজ। এ কারণে অর্জিত স্বাধীনতাকে রক্ষা ও সুসংহত করার জন্য প্রত্যেকটি নাগরিকের অতন্দ্রপ্রহরীর মতো সদা সতর্ক থাকা প্রয়োজন।

‘স্বাধীনতা’ মানুষের হৃদয়ে কাক্সিক্ষত শব্দ। স্বাধীনতা প্রতিটি মানুষের জন্মগত অধিকার। আর মানুষ মাত্রই স্বাধীনতাকামী। পরাধীন জীবন কারো কাম্য নয়। জীবনের পরিপূর্ণ আস্বাদ গ্রহণের জন্য মানুষ চায় স্বাধীনতা। কবি তা উচ্চারণ করেছেনÑ‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে কে বাঁচিতে চায়?’ তাই প্রত্যেক মানুষের প্রধান আকাক্সক্ষা স্বাধীনতা। কিন্তু স্বাধীনতা ছাড়া কোনো মানুষই অধিকার নিয়ে বাঁচতে পারে না। স্বাধীনতা কথাটি যতই মধুর হোক না কেন, এটা অর্জন করা অনেক কঠিন। এটা অর্জন করতে অত্যন্ত বেদনাদায়ক, অনেক মূল্যের বিনিময়ে কিনতে হয়। বিদেশি শাসন-শোষণের নিষ্পেষণ থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন হয় কঠিন সংগ্রামের। প্রায়ই ক্ষেত্রে বিদেশি শাসক শক্তি হয় পরাক্রমশালী। তাদের থাকে সুশৃঙ্খল প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। সেই সঙ্গে বিপুল রণসম্ভার। তাদের বিরুদ্ধে লড়তে গেলে প্রয়োজন হয় জাতীয় ঐক্য, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, বিপুল সাংগঠনিক শক্তি এবং দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি। স্বাধীনতা সংগ্রামে সংগ্রাম হয় প্রত্যক্ষ, শত্রু থাকে প্রকাশ্য এবং লক্ষ্য হয় একমুখী। স্বাধীনতার দুর্বার আকাক্সক্ষায় জনগণ অগ্রসর হয় ত্যাগী মনোভাব নিয়ে। স্বার্থবুদ্ধি বা বিভেদের শক্তি তখন বড় হয়ে উঠতে পারে না। তার অস্তিত্ব থাকলে তা হয় অদৃশ্য। কিন্তু পদে পদে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয় স্বাধীনতা-উত্তরকালে দেশ গঠনপর্বে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দেশের যাত্রা শুরু হয়। একদিকে থাকে পরাজিত শক্তি ও তাদের এদেশীয় অনুচরদের জিজ্ঞাসা ও মরণ কামড়ের জ্বালা, অন্যদিকে স্বাধীনতা পক্ষের শক্তির অভ্যন্তরীণ রেষারেষি। এ পরিস্থিতিতে নব অর্জিত স্বাধীনতাকে ধ্বংস করার চক্রান্ত মোকাবিলা করা সহজ নয়। ভৌগোলিক ও পতাকার স্বাধীনতা নিয়ে বেঁচে থাকা তখন দুরূহ কাজ হয়ে দাঁড়ায়। সে কারণে অর্জিত স্বাধীনতাকে রক্ষা করা অনেক কঠিন কাজ। এ কারণে স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলতে হলে চাই সঠিক নেতৃত্ব। অর্থনৈতিক মুক্তির স্বাধীনতাই আমাদের কাম্য। তা না হলে জীবনে উন্নতি ও প্রগতি হবে না। স্বাধীনতা অর্থবহ হবে না। তাই আমাদের দরকার দায়িত্ব ও কর্তব্যের সঙ্গে কাজ করা।

বলিষ্ঠ ও আত্মপ্রত্যয়ী জাতি হিসেবে আমাদের স্বাধীনতাকে অ¤øান রাখতে সচেষ্ট থাকতে হবে। তবেই অর্জিত স্বাধীনতা রক্ষা করা সম্ভব। নতুবা ঈপ্সিত স্বাধীনতা ভূলুণ্ঠিত হয়ে পড়বে। আপন কর্মপ্রেরণা, চিন্তাধারা ও শৃঙ্খলাবোধের দ্বারাই প্রমাণ করতে হবে কাক্সিক্ষত স্বাধীনতার আদর্শ। 

৩৭. দুঃখের মতো এত বড় পরশপাথর আর নেই।

প্রত্যেক মানুষের জীবনে রয়েছে সুখ-দুঃখের সহাবস্থান। একটিকে ছাড়া অন্যটি মানুষ সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারে না। দুঃখের সংস্পর্শে না এলে মানুষের স্বীয় সত্তা ও অন্তরশক্তি সঠিকভাবে জাগ্রত হয় না। দুঃখের পরশেই মানুষের বিবেক জাগ্রত হয়, মানুষের জীবন হয় মানবিক বোধে আলোকিত, মানুষ হয়ে ওঠে মহানুভব ও মহীয়ান।

স্রষ্টার বিচিত্র রূপ। তিনি কখনও করুণা ধারায় তাঁর সব সুধা ঢেলে দেন, কখনও তিনি দুঃখের রুদ্রমূর্তি ধারণ করে আমাদের পরীক্ষায় ফেলেন। সুখবিলাসী মানুষ জীবনের সারবত্তা পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারে না। দুঃখে পতিত হলে মানুষ সুখের যথার্থ মর্ম বুঝতে পারে। দুঃখের দারুণ দহন শেষে মানুষের জীবনে যে সুখ আসে, তা অনাবিল ও অতুলনীয়। দুঃখই পারে মানুষের অন্তর্নিহিত মনুষ্যত্ব ও বিবেককে জাগ্রত করতে এবং মানুষকে খাঁটি মানুষে পরিণত করতে। দুঃখ মোকাবিলা করার শক্তি দিয়েই মানুষ আপন শক্তির পরিচয় দিতে পারে। পৃথিবীতে মহৎ কিছু অর্জন করতে হলে দুঃখ সইতে হয়। কষ্ট ছাড়া কেষ্ট পাওয়া যায় না বলেই পৃথিবীতে মহামনীষীরা দুঃখকে তুলনা করেছেন পরশপাথরের সঙ্গে। পরশপাথরের ছোঁয়ায় লোহা যেমন স্বর্ণপিণ্ডে পরিণত হয়, দুঃখও তেমনি মানুষের জীবনকে নতুন রূপ দেয়; দুঃখ, কষ্ট ও ত্যাগ-তিতিক্ষা ছাড়া জীবনের স্বর্ণশিখরে আরোহণ সম্ভব নয়। পৃথিবীর বহু মনীষী দুঃখকে অন্তর দিয়ে অনুভব করেছিলেন। দুঃখকে বরণ করে নিয়েছিলেন বলেই আজও তারা স্মরণীয়-বরণীয় হয়ে আছেন। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.), যিশুখ্রিস্ট, গৌতম বুদ্ধ প্রমুখ মহান ধর্মবেত্তা দুঃখকে জয় করে খাঁটি মানুষে পরিণত হয়েছিলেন; কাজ করেছিলেন মানবজাতির কল্যাণে।

বস্তুত, মানুষের মনুষ্যত্ব ও অন্তর্নিহিত গুণাবলির জাগরণের জন্য দুঃখ মানুষের জীবনে পরশপাথরের মতোই কাজ করে।

৩৮. বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।

সৃষ্টিকর্তা নারী ও পুরুষকে সৃষ্টি করেছেন একে অপরের পরিপূরক হিসেবে। তাই নারী ও পুরুষ চিরকালের সার্থক সঙ্গী।

জগতে চিরকালই পুরুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা সকল ক্ষেত্রে নারী ছায়ার মতো পাশে থেকেছে। নারী ও পুরুষের সম্মিলিত প্রয়াস ছাড়া এই বিশ্বসংসার, সমাজ, সভ্যতা সবকিছুই অন্ধকারেই থেকে যেত। নারী ও পুরুষ পাশাপাশি থেকেছে বলেই সভ্যতার অগ্রগতি ত্বরান্বিত হয়েছে। তাই নারী ও পুরুষ একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। সৃষ্টির আদিমকাল থেকে নারী পুরুষকে জুগিয়েছে প্রেরণা, শক্তি ও সাহস। আর পুরুষ বীরের মতো সব কাজে অর্জন করেছে সাফল্য। আজ পর্যন্ত বিশ্বে যত অভিযান সংঘটিত হয়েছে, তার অন্তরালে নারীর ভূমিকাই মুখ্য। যুদ্ধক্ষেত্রে বীর যেমন জীবন দান করেছে তেমনি নারীও তার সিঁথির সিঁদুর হারিয়েছে। আবার ইতিহাসে পুরুষের পাশাপাশি অনেক বীরাঙ্গনাও রয়েছে যারা যুদ্ধের ময়দানে যুদ্ধ করেছে। সংগত কারণেই নারী ও পুরুষের কার্যক্ষেত্রে ভিন্নতা আছে। তবুও নারী যেমন পুরুষের ওপর নির্ভরশীল, পুরুষও তেমনি নারীর মুখাপেক্ষী। তাই নারীকে বাদ দিয়ে পুরুষের জীবন অসম্পূর্ণ, অর্থহীন। নারী ও পুরুষের মিলনের মধ্যেই রয়েছে জগতের সমস্ত কল্যাণ। উভয়ের দানে পুষ্ট হয়েছে আমাদের পৃথিবী। মানবসভ্যতা বিকাশে নারী ও পুরুষের সমান অবদান রয়েছে। নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই গড়ে উঠেছে আমাদের সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতি।

প্রকৃতপক্ষে পুরুষের শৌর্য-বীর্য আর নারীহৃদয়ের সৌন্দর্য, প্রেম ও ভালোবাসা এ দুয়ের সমন্বয়েই বিশ্বের সকল উন্নতি সাধিত হয়েছে। তাই নারীর অবদানকে খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই।

৩৯. সঙ্গদোষে লোহা ভাসে।

মানুষের স্বভাব-চরিত্রের বিকাশের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করে সঙ্গী নির্বাচন।

প্রত্যেক মানুষই তার জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি স্বাধীন সত্তা বহন করে। সে একাই তার বিবেককে নিয়ন্ত্রণ করে। তবে এক্ষেত্রে তার সঙ্গের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ভবিষ্যতের সুন্দর বা খারাপের বিষয়টি নির্ভর করে ব্যক্তির ইচ্ছা বা সঙ্গ নির্বাচনের ওপর। যেসব মানুষ উন্নত চরিত্র বা সৎ-স্বভাবের লোকের সঙ্গে মেলামেশা করে, তাদের স্বভাব-চরিত্রও সুন্দর ও বিকশিত হয়ে ওঠে। অন্যদিকে যারা কুসঙ্গে বা কুসংসর্গে এসেছে তাদের চরিত্রের অধঃপতন ঘটেছে। চরিত্রের গঠনে ভালো মন্দ উভয় দিকই নির্ভর করে সঙ্গী নির্বাচনের ওপর। যারা খারাপ সঙ্গীর সংস্পর্শে থেকে নিজেদের চরিত্রের অধঃপতন ঘটিয়েছে, সমাজে তাদের বিপর্যয় অনিবার্য। তাই মানবজীবনে সঙ্গ নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রকৃতিতেও যেসব বস্তু সুন্দর ও রমণীয়, সেগুলোর সংস্পর্শে যেসব বস্তু থাকে তারাও সুন্দর ও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। খারাপ বস্তুটি সুন্দর বস্তুটির গুণ নিজের মধ্যে ধারণ করে অন্যের কাছে নিজেকে মর্যাদাবান ও গ্রহণযোগ্য করে তোলে। প্রকৃতপক্ষে, সঙ্গই সৃষ্টিকে মহিমান্বিত করে তোলে। আর এজন্য সঙ্গই হলো সবকিছুর সাফল্য ও বিফলতার চাবিকাঠি। ব্যক্তি যতই মনে করুক সে ভালো চরিত্রের অধিকারী হবে সে তা কখনোই হতে পারবে না যদি খারাপ সঙ্গীর সংস্পর্শে থাকে। কেননা খারাপের সঙ্গে থাকতে থাকতে একসময় প্রভাবিত হয়ে ব্যক্তি খারাপকে গ্রহণ করবে। তাই ভালো চরিত্র লাভ করতে ভালো সঙ্গী নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ।

ব্যক্তির চরিত্র গঠনে সঙ্গই ভালো মন্দের নির্ণায়ক।

৪০ . লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু।

লোভের পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। লোভ মানুষের পরম শত্রু। লোভ মানুষকে অন্ধ করে; তার বিবেক বিসর্জন দিয়ে তাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়।

লোভের বশবর্তী হয়েই মানুষ জীবনের সর্বনাশ ডেকে আনে। মানুষ নিজের ভোগের জন্য যখন কোনো কিছু পাওয়ার প্রবল ইচ্ছা পোষণ করে তাকে লোভ বলে। তখন যা নিজের নয়, যা পাওয়ার অধিকার তার নেই, তা পাওয়ার জন্য মানুষ লোভী হয়ে ওঠে। সে তার ইচ্ছাকে সার্থক করে তুলতে চায়। লোভের মোহে সে সত্য-মিথ্যা, ভালো-মন্দ সব বিসর্জন দেয়। তার ন্যায়-অন্যায় বোধ লোপ পায়। সে পাপের পথে ধাবিত হয়। নিজের স্বার্থের জন্য অন্যের সর্বনাশ করে। এভাবে লোভ মানুষকে পশুতে পরিণত করে। ডেকে আনে মৃত্যুর মতো ভয়াবহ পরিণাম। লোভের মোহে পড়লে মানুষের ব্যক্তিত্ববোধ লোপ পায়। ফলে লোভ ব্যক্তি তার হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য সচেষ্ট থাকে। এতে তার চাহিদা তো পূরণ হয়ই না বরং আরও পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। ফলে একসময় লোভের কারণে তার পতন আসন্ন হয়ে ওঠে।

লোভের কারণে অন্তরের সুখ হারিয়ে যায়। ফলে এটি ব্যক্তির পতনের কারণ হয়। তাই সার্থক জীবনের জন্য লোভ পরিহার করা প্রয়োজন।

৪১. জ্ঞানহীন মানুষ পশুর সমান।

জ্ঞান বা বিবেক না থাকলে মানুষ ও পশুর মধ্যে কোনো তফাৎ থাকে না।

সৃষ্টির অন্যান্য প্রাণী থেকে মানুষকে আলাদা করেছে তার বিবেক বা জ্ঞান, যা অন্য কোনো প্রাণীর মধ্যে নেই। প্রতিটি মানুষের মধ্যেই জ্ঞান বা বিবেক সুপ্ত অবস্থায় থাকে। অনুশীলনের মাধ্যমে তাকে জাগিয়ে তুলতে হয়। জ্ঞান মানুষকে যোগ্যতা দান করে। নানা বিদ্যায় পারদর্শী করে তোলে। জ্ঞানের আলোকেই মানুষের জীবন বিকশিত হয়ে ওঠে। তাই মানুষ হিসেবে শ্রেষ্ঠত্ব লাভের জন্য জ্ঞানের সহায়তা অপরিহার্য। অন্য প্রাণীর সঙ্গে মানুষের পার্থক্য এখানেই। জ্ঞানবান মানুষ কখনো খারাপ কাজ করতে পারে না। তার বিবেক তাকে খারাপ আচরণ করতে বাধা দেয়। অন্যদিকে জ্ঞানহীন মানুষ পশুর মতো নির্বোধ। পশুর যেমন জ্ঞান নেই। সে ন্যায়-অন্যায় বোঝে না। আপন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে না। জ্ঞানহীন ব্যক্তিরও তেমনি কোনো বিবেক নেই। জ্ঞানের অভাবে তারা আধুনিক জীবনের সম্পূর্ণ স্বাদ উপভোগ করতে পারে না। তাদের জীবনের সঙ্গে পশুর জীবনের কোনো পার্থক্য নেই। জ্ঞানই মানুষ ও পশুর মধ্যে পার্থক্যের সীমারেখা টেনে দেয়। জ্ঞান রয়েছে বলেই মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। এটি মানুষের জীবনে হিরন্ময় শিখার মতো অনন্য মানবীয় গুণ। জ্ঞানই একজন মানুষকে পরিপূর্ণ মানুষরূপে গড়ে তোলে। পশু যেমন নিজস্ব স্বকীয়তা হারিয়ে ধুকে ধুকে মৃত্যুবরণ করে তেমনি জ্ঞানহীন মানুষের ক্ষেত্রেও একই ঘটে। ফলে জ্ঞান নামক মানবীয় গুণের উপস্থিতিই মানুষকে পশু থেকে উন্নত করে তুলেছে।

পশুর বিবেক নেই বলেই সে বেঁচে থাকাকেই জীবনের ধর্ম মনে করে। আর বিবেকহীন মানুষেরাও পশুর মতো কুপ্রবৃত্তির দাসত্তে নিমগ্ন থাকে। তাই জ্ঞানহীন মানুষ এবং পশুর মধ্যে কোনো প্রভেদ নেই।

৪২. পিতামাতা গুরুজনে দেবতুল্য জানি, 
যতনে মানিয়া চল তাহাদের বাণী।

বাবা, মা ও অভিভাবকবৃন্দ আমাদের জীবন গঠন ও পরিচালনার জন্য যেসব উপদেশ দেন, সেগুলো মেনে চলা আমাদের একান্ত কর্তব্য।

পিতা-মাতা আমাদের সবচেয়ে আপনজন। অনেক কষ্ট করে তাঁরা আমাদের লালন-পালন করেন। পিতা-মাতার সঙ্গে অন্য গুরুজনরাও আমাদের সুস্থ জীবন বিকাশে সহায়তা করেন। তাঁরা আমাদের স্নেহ করেন, ভালোবাসেন এবং সর্বদাই মঙ্গল কামনা করেন। এঁরা সবাই বয়সে, জ্ঞানে, বুদ্ধিতে, প্রজ্ঞায় আমাদের থেকে অনেক বড়। অভিজ্ঞতার আলোকে তাঁরা জানেন কী করলে আমাদের ভালো হবে। আর কোন পথটি আমাদের জন্য ক্ষতিকর। নবীনতা ও অনভিজ্ঞতার কারণে এই কঠিন ও জটিল পৃথিবীর অনেক কিছুই আমাদের অজানা। সে জন্য পিতা-মাতা, গুরুজন ও বিশ্বের মহান ব্যক্তিদের উপদেশ চলার পথের আলোকবর্তিকা হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। আর তা অবহেলা করলে জীবনে সফলতা আসবে না। প্রতি মুহূর্তেই আমরা হোঁচট খাব। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বায়েজিদ বোস্তামি গুরুজনদের আদেশ-উপদেশ শ্রদ্ধাভরে পালন করেছেন। আর সে কারণেই তাঁরা সকলের শ্রদ্ধার পাত্রে পরিণত হতে পেরেছেন। তাই পিতা-মাতা, গুরুজন আদর্শস্থানীয়, দেবতুল্য এবং আরাধনাযোগ্য। তাঁদের বাণী অনুসরণ করে নিজের জীবন গড়তে হবে এবং দেশ, জাতি তথা সমগ্র বিশ্বকে শাশ্বত কল্যাণের দিকে এগিয়ে নিতে হবে।

পিতা-মাতা, গুরুজন ও বিশ্বের মহান ব্যক্তিদের উপদেশ মানলে নিজের জীবন সুন্দর ও বিকশিত হবে এবং দেশ ও জাতি উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে পারবে।

৪৩. নানান দেশের নানান ভাষা
বিনা স্বদেশী ভাষা মিটে কি আশা?

মাতৃভাষার মাধ্যমেই মানুষ যেকোনো কিছুর প্রকৃত রস আস্বাদন করতে পারে এবং এই ভাষাতেই তার প্রাণের স্ফ‚র্তি ঘটে।

পৃথিবীর প্রায় সব জাতিরই নিজস্ব ভাষা আছে এবং এক ভাষা থেকে অন্য ভাষা আলাদা। ভাষার মাধ্যমে আমরা শুধু নিজের মনের ভাবই অন্যের কাছে প্রকাশ করি না, মাতৃভাষার সাহায্যে অন্যের মনের কথা, সাহিত্য-শিল্পের বক্তব্যও নিজের মধ্যে অনুভব করি। নিজের ভাষার কিছু বোঝা যত সহজ, অন্য ভাষায় তা সম্ভব নয়। বিদেশে গেলে নিজের ভাষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা যায় আরও প্রবলভাবে। তখন নিজের ভাষাভাষী মানুষের সান্নিধ্য পেতে ভেতরে ভেতরে মরুভ‚মির মতো তৃষিত হয়ে থাকে মানুষ। আমরা বাঙালি, বাংলা আমাদের ভাষা। বাংলা ভাষায় আমরা কথা বলি, পড়ালেখা করি, গান গাই, ছবি আঁকি, সাহিত্য রচনা করি, হাসি-খেলি, আনন্দ-বেদনা প্রকাশ করি। অন্য ভাষায় আমাদের সব অনুভ‚তি স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ এই ভাষায় সাহিত্য রচনা করে যশস্বী হয়েছেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত জীবনের শুরুতে অন্য ভাষায় সাহিত্য রচনা করে পরে আক্ষেপ করেছেন এবং মাতৃভাষায় সাহিত্যচর্চা করে বিশ্বখ্যাতি লাভ করেছেন। মায়ের মুখের বুলি থেকে শিশু তার নিজের ভাষা আয়ত্ত করা শুরু করে এবং এই ভাষাতেই তার স্বপ্নগুলোকে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করে, এই ভাষাতেই লেখাপড়া করে এবং জগৎ ও জীবনকে চিনতে শুরু করে। ভিন্ন ভাষাভাষীদের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক রক্ষার জন্য, দেশ-বিদেশের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে নিজেদের সংযুক্ত রাখার জন্য আমাদের অন্যান্য ভাষাও শিখতে হয়। কিন্তু কোনো বিষয় বোঝার জন্য মাতৃভাষার মতো সহায়ক আর কিছু নেই। অন্য ভাষা শেখার জন্যও মাতৃভাষার বুনিয়াদ শক্ত হওয়া জরুরি।

স্বদেশের ভাষাকে ভালোবাসতে হবে, এর বিকাশ ও সমৃদ্ধিকে অবাধ করতে হবে এবং বিকৃতিকে রোধ করতে হবে। সুপেয় জল যেমন আকর্ষণীয়, তেমনি স্বদেশের ভাষা সুমিষ্ট।

৪৪. লাইব্রেরি জাতির সভ্যতা ও উন্নতির মানদণ্ড

লাইব্রেরি হচ্ছে জ্ঞানের আধার। একটি জাতির রুচি, জ্ঞানের গভীরতা ও সভ্যতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায় ঐ জাতির লাইব্রেরির মাধ্যমে।

একটি জাতি বা দেশের সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান, খেলাধুলা-বিনোদন, সভ্যতা-সংস্কৃতির পরিচয়কে ধারণ করে সেই জাতির সযত্নে তৈরি লাইব্রেরি। কখনো কখনো মানুষের মুখ যেমন ব্যক্তির অন্তর্গত রূপ বা পরিস্থিতিকে নির্দেশ করে, তেমনি লাইব্রেরি জাতির উন্নতি ও অগ্রগতিকে চিহ্নিত করে। লাইব্রেরি জাতির অতীত ও বর্তমানকে এক সুতায় বেঁধে রাখে এবং ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা দেয়। জ্ঞানান্বেষী ও সত্যসন্ধানী মানুষ লাইব্রেরিতে এসে নিজেকে সমৃদ্ধ করে এবং জাতির ক্রমোন্নতিতে ভ‚মিকা রাখে। একটি লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত সাহিত্যগ্রন্থ দেখে সংশ্লিষ্ট জাতির সাহিত্যরুচি উপলব্ধি করা যায়, বিজ্ঞানগ্রন্থ দেখে জাতির বিজ্ঞান-চিন্তা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা অনুভব করা যায়। তাই গ্রন্থাগার হচ্ছে কালের সাক্ষী। জ্ঞান-বিজ্ঞানসংক্রান্ত যেকোনো প্রয়োজনে লাইব্রেরি পরম বন্ধু এবং অনন্ত উৎস। পৃথিবীতে যত বড় বড় আবিষ্কার হয়েছে, সেগুলোর প্রতিটির পেছনে রয়েছে লাইব্রেরির গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা। তাই অনেক বড় বড় যুদ্ধের পরে দেখা গেছে বিজয়ী শক্তি পরাজিত জাতির লাইব্রেরিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। একটি বৃহৎ লাইব্রেরি জাতির সব ধরনের তথ্যই শুধু সংরক্ষণ করে না, দেশের সঠিক উন্নতিতেও প্রভাবকের ভ‚মিকা পালন করে। লাইব্রেরি মানুষের আনন্দেরও খোরাক জোগায় এবং মানুষের মনকে প্রশান্ত করে। পুস্তক পাঠ মানুষের একটি সৃষ্টিশীল শখ। আর এই শখ পূরণের জন্য লাইব্রেরির প্রয়োজনীয়তা অবশ্যম্ভাবী।

যে জাতি যত উন্নত, সেই দেশের লাইব্রেরি তত সমৃদ্ধ।


৪৫. বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। 

প্রকৃতির সবকিছুরই একটি স্বাভাবিক সৌন্দর্য আছে। সেই সৌন্দর্য যথোপযুক্ত পরিবেশেই স্বতঃস্ফ‚র্ত ও আকর্ষণীয়।

সৌন্দর্য প্রকৃতির এক মহামূল্যবান দান। কোথায় সেই সৌন্দর্য সবচেয়ে মানানসই, তা প্রকৃতিই নির্ধারণ করে দেয়। নির্দিষ্ট পরিবেশের ব্যত্যয় ঘটলে সৌন্দর্যের স্বাভাবিক ঔজ্জ্বল্য নি®প্রভ হয়ে যায়। বন্য প্রাণীরা বনেই সুন্দর, পাখি মুক্ত আকাশে। ফুল সুন্দর গাছে, মাছ স্বাভাবিক জলে। কিন্তু বন্য প্রাণীকে লোকালয়ে, পাখিকে খাঁচায়, ফুলকে ফুলদানিতে, মাছকে ডাঙায় রাখলে তাদের জীবনের গতি ব্যাহত হয়, সৌন্দর্যের হানি ঘটে, কখনো কখনো জীবননাশের আশঙ্কা তৈরি হয়। প্রত্যাশিত পরিমণ্ডল হারিয়ে এরা নি®প্রাণ হয়ে ওঠে। শিশুরও যথার্থ স্থান মায়ের কোল। মায়ের কোলে শিশুকে যতটুকু মানায়, অন্য কোথাও তা সম্ভব নয়। নিজেদের শখ-আহ্লাদ পূরণের জন্য মানুষ কখনো কখনো কৃত্রিম পরিবেশ তৈরি করে বন্য প্রাণী, পাখি, মাছ পোষার চেষ্টা করে, কিছুটা হয়তো সফলও হয়। কিন্তু এতে সেই সব প্রাণীর জীবনের ছন্দ নষ্ট হয়, বিকাশ ব্যাহত হয়। তাই কৃত্রিমতা কখনো গ্রহণযোগ্য নয়। শুধু প্রাণীর আবাস নয়, মানুষের জীবনেও কৃত্রিমতা কাম্য নয়। যে যেখানে উপযুক্ত তাকে সেখানেই থাকতে দেওয়া উচিত। তাহলে তার প্রকৃত সৌন্দর্য প্রকাশ পায়।

যার যেখানে স্থান, তাকে সেখানেই থাকতে দেওয়া উচিত। প্রকৃত রূপেই সবকিছু সুন্দর, কৃত্রিমতা স্বতঃস্ফ‚র্ততা ও নান্দনিকতার অন্তরায়।

৪৬. সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই

মানুষে মানুষে অনেক ধরনের বিভেদ-বৈষম্য থাকতে পারে। কিন্তু সামগ্রিক বিবেচনায় সবচেয়ে বড় সত্য হচ্ছে আমরা সবাই মানুষ।

সব মানুষ একই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি। সৃষ্টির মধ্যে মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ। পৃথিবীর একই জল-হাওয়ায় আমরা বেড়ে উঠি। আমাদের সবার রক্তের রং লাল। তাই মানুষ একে অন্যের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। ভৌগোলিকভাবে আমরা যে যেখানেই থাকি না কেন, অথবা আমরা যে যুগেরই মানুষ হই না কেন, আমাদের একটিই পরিচয়- আমরা মানুষ। কখনো কখনো স্বার্থসিদ্ধির জন্য আমরা জাত-কুল-ধর্ম-বর্ণের পার্থক্য তৈরি করে মানুষকে দূরে ঠেলে দিই, এক দল আরেক দলকে ঘৃণা করি, পরস্পর হানাহানিতে লিপ্ত হই। কিন্তু এগুলো আসলে সাময়িক। প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে, আমরা একে অন্যের পরম সুহৃদ। আমাদের উচিত সবাইকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ রাখা। প্রত্যেককে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দেওয়া এবং তার অধিকার সংরক্ষণে একনিষ্ঠ থাকা। মানুষের মধ্যে নারী-পুরুষ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-দরিদ্র, ব্রাহ্মণ-শূদ্র, আশরাফ-আতরাফ, হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান, কেন্দ্রবাসী-প্রান্তবাসী এমন ভাগাভাগি কখনোই কাম্য হতে পারে না। তাতে মানবতার অবমাননা করা হয়। তাই আধুনিককালে এক বিশ্ব, এক জাতি চেতনার বিকাশ ঘটছে দ্রæত। মানবজাতির একই একাত্ম-ধারণা প্রতিষ্ঠিত হলে যুগে যুগে, দেশে দেশে মারামারি, যুদ্ধ-বিগ্রহ কমে আসবে। মানুষ সংঘাত-বিদ্বেষমুক্ত শান্তিপূর্ণ এক বিশ্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। সর্বত্র মনুষ্যত্বের জয়গাথা ঘোষিত হবে।

সব ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের মানুষকে মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে, বিশুদ্ধভাবে ভালোবাসতে পারলেই বিশ্বে প্রার্থিত সুখ ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠিত হবে।

৪৭. চরিত্র মানবজীবনের অমূল্য সম্পদ। 

চরিত্র মানবজীবনের মুকুটস্বরূপ। চরিত্রবান ব্যক্তিকে সবাই শ্রদ্ধা করে; চরিত্রহীনকে সকলে ঘৃণা করে।

চারিত্রিক গুণাবলির মধ্য দিয়ে মানুষের জীবনের মহিমা প্রকাশ পায়। চরিত্রবান ব্যক্তি কতগুলো গুণের অধিকারী হন। সততা, বিনয়, উদারতা, নম্রতা, ভদ্রতা, রুচিশীলতা, ন্যায়পরায়ণতা, সত্যবাদিতা, লোভহীনতা, পরোপকারিতা ইত্যাদি গুণ চরিত্রবান ব্যক্তিকে মহত্ত¡ দান করে। এসব গুণ যদি মানুষের মধ্যে না থাকে, তাহলে সে পশুরও অধম বলে বিবেচিত হয়। চরিত্রহীন ব্যক্তির মানুষ হিসেবে কোনো মূল্য নেই। চরিত্রবান ব্যক্তি তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের গুণে সমাজে সমাদৃত হন। অন্যদিকে চরিত্রহীন ব্যক্তিকে কেউ ভালোবাসার দৃষ্টিতে দেখে না, বরং ঘৃণা করে। চরিত্রবান ব্যক্তি জাগতিক মায়া-মোহ-লোভ-লালসার বন্ধনকে ছিন্ন করে লাভ করেন অপরিসীম শ্রদ্ধা ও অফুরন্ত সম্মান। চরিত্রের মাধ্যমেই ঘোষিত হয় জীবনের গৌরব। চরিত্রবান না হলে অন্য কোনো কিছুই মানুষকে সর্বোত্তম মানুষে পরিণত করতে পারে না। চরিত্রবান ব্যক্তি সত্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সর্বদা অবিচল থাকে। এতে সে সকলের নিকট শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্র হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু চরিত্রহীন কখনো কারো সম্মানের পাত্র হতে পারে না। সে সকল সময় মানুষের ঘৃণাই পেয়ে থাকে। স্বাস্থ্য, অর্থ, বিদ্যা মানবজীবনের অপরিহার্য উপাধান হলেও চরিত্র ছাড়া এগুলোর কোনোটাই কাজে আসে না। তাই চরিত্রের মাহাত্ম্য কখনো মূল্য দিয়ে মাপা যায় না।

অর্থ-বিত্ত-গাড়ি-বাড়ি প্রভৃতির চেয়ে চরিত্র অনেক বড় সম্পদ। আর এ মর্যাদা অর্থমূল্যে নয়, মানবিকতা ও নৈতিক পবিত্রতার মানদণ্ডে বিচার করতে হয়। সকলেরই উচিত চরিত্রবান হওয়ার সাধনা করা।


৪৮. পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি

সৌভাগ্য নিয়ে পৃথিবীতে কোনো মানুষের জন্ম হয় না। কর্মের মাধ্যমে মানুষ তার ভাগ্য গড়ে তোলে। পরিশ্রমই সৌভাগ্য বয়ে আনে।

যিনি জন্ম দান করেন তিনি প্রসূতি। মা যেমন সন্তানের প্রসূতি, তেমনি পরিশ্রম হলো সৌভাগ্যের প্রসূতি বা উৎস। মানুষকে তার কর্মফল ভোগ করতে হয়। ভালো কাজের ফল ভালো, মন্দ কাজের ফল মন্দ। কোনো কাজই সহজ নয়। আবার কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে কঠিন কাজও সহজ হয়। জীবনে উন্নতি করতে হলে পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। পরিশ্রম ছাড়া কেউ কখনো তার ভাগ্যকে গড়ে তুলতে পারেনি। জীবনে অর্থ, বিদ্যা, যশ, প্রতিপত্তি লাভ করতে হলে অবশ্যই পরিশ্রম করতে হবে। ছাত্রজীবনে কঠোর পরিশ্রম করে শিক্ষালাভ না করলে ভবিষ্যৎ জীবনে সাফল্য লাভ সম্ভব নয়। পরিশ্রম ছাড়া জাতীয় উন্নতিও লাভ করা যায় না। পৃথিবীতে এমন একটি জিনিসও নেই যা শ্রমলব্ধ নয়। আমাদের সমাজ ও সভ্যতা বর্তমান পর্যায়ে আসার মূলে রয়েছে পরিশ্রম। যুগ যুগ ধরে তিল তিল পরিশ্রমের মাধ্যমে সভ্যতার উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে। মানব কল্যাণে আবিষ্কারকগণ পরিশ্রম করে আবিষ্কার করেছেন বিভিন্ন সূত্র। পরিশ্রম না করে অলস বসে থাকলে কখনো ভালো ফল এসে ধরা দেয় না। ভালো ফল ধরা দেয় তখনই যখন কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে ফলাফলকে নিজের করে নিতে হয়।

শ্রমই হলো উন্নতির চাবিকাঠি। যে জাতি পৃথিবীতে যত বেশি পরিশ্রমী, সে জাতি তত উন্নত। ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত পরিশ্রমের মধ্য দিয়েই জাতির অগ্রগতি অর্জন করা যায়।

৪৯. ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়

জীবন কর্মময়। কর্মশক্তির মূলে রয়েছে উৎসাহ-উদ্দীপনা আর প্রবল আগ্রহ। আগ্রহের সঙ্গে নিষ্ঠা যুক্ত থাকলে অসাধ্যকেও সাধ্য করা যায়।

মানুষকে সব বাধা অতিক্রম করতে সাহায্য করে তার ইচ্ছাশক্তি। প্রতিদিনই আমাদের কোনো না কোনো কাজ করতে হয়। পৃথিবীতে কোনো কাজই বিনা বাধায় করা যায় না। সব কাজেই কিছু না কিছু সুবিধা-অসুবিধা ও বাধা-বিপত্তি থাকে। সেই অসুবিধা ও বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করতে পারলেই সাফল্য আসে। এজন্য প্রয়োজন প্রবল ইচ্ছা। ইচ্ছা থাকলে কোনো কাজ আটকে থাকে না। ইচ্ছাই সকল কর্মের প্রেরণা। ইচ্ছাই মানুষকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। দৃঢ় ইচ্ছার কাছে সকল বাধা হার মানে। প্রবল ইচ্ছা নিয়ে কোনো কাজ করলে অতি কঠিন কাজও শেষ করা যায়। পৃথিবীর মহান ব্যক্তিরা এভাবেই সব ধরনের বিপত্তি অতিক্রম করে লক্ষ্যে পৌঁছেছেন। সম্রাট নেপোলিয়ন তাঁর সেনাবাহিনীসহ আল্পস পর্বতের কাছে গিয়ে অসীম উৎসাহে বলে ওঠেন : ‘আমার বিজয় অভিযানের মুখে আল্পস পর্বত থাকবে না।’ আত্মশক্তি ও ইচ্ছাশক্তির বলে তিনি আল্পস পার হতে পেরেছিলেন। অসাধ্যকে সাধন করতে পেরেছিলেন প্রবল ইচ্ছাশক্তিতে।

মানুষের সকল কাজের মূল হলো ইচ্ছাশক্তি। ইচ্ছাই মানুষকে সাফল্যের দ্বারে পৌঁছে দেয়।

৫০. আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে
আসে নাই কেহ অবনী পরে,
সকলের তরে সকলে আমরা
প্রত্যেকে মোরা পরের তরে।

মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে পরস্পর সহযোগিতার মাধ্যমে তাকে বেঁচে থাকতে হয়।

সমাজবিচ্ছিন্ন মানুষের জীবন অর্থহীন। কারণ, সমাজে প্রতিটি মানুষ একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। যে ব্যক্তি কেবল নিজের কথা ভাবে, সমাজের কথা ভাবে না, সে স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক। সমাজবিচ্ছিন্ন মানুষ কখনোই সুখী হয় না। যারা নিজের কথা না ভেবে সমাজের মঙ্গল ও কল্যাণের জন্য নিজেদের জীবন বিলিয়ে দেয় তারাই প্রকৃত মানুষ। অন্যের সুখের জন্য যারা ত্যাগ স্বীকার করে, তাদের মতো সুখী আর কেউ নেই। সমাজে এ রকম মানুষেরাই চিরস্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন। একে অন্যের সাহায্যে এগিয়ে আসাই প্রকৃত মানবধর্ম। আজকের এই সভ্যতা গড়ে ওঠার পেছনে কাজ করেছে মানুষের শুভবুদ্ধি ও অন্যের কল্যাণ করার ইচ্ছা। আর অন্যের কল্যাণ করার এই ইচ্ছা ব্যক্তিকে সকলের কাছে স্মরণীয় ও বরণীয় করে তোলে। সমাজের কল্যাণে নিজেকে নিঃশেষ করে দেওয়ার মাঝে রয়েছে প্রকৃত সুখ। পরার্থে জীবন উৎসর্গ করার মাঝে রয়েছে মানবজীবনের চরম সার্থকতা। আমরা শুধু নিজের জন্যই জন্মগ্রহণ করিনি, নিজের সুখই আমাদের একমাত্র কাম্য হতে পারে না। অন্যের কল্যাণই মানুষকে প্রকৃত মানুষ করে তোলে। আর এটিই সকলের একমাত্র কাম্য হওয়া প্রয়োজন।

ত্যাগের মাঝেই জীবনের সার্থকতা নিহিত, ভোগের মাঝে নয়।

৫১. কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে
দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মহিতে? 

পৃথিবীতে যেকোনো কাজে সাফল্য লাভ করার জন্য প্রয়োজন ঐকান্তিক সাধনা ও নিষ্ঠা; প্রয়োজন সকল প্রতিক‚লতাকে জয় করার মনোবল ও সহ্যশক্তি। দুঃখ-কষ্ট বা পরিশ্রমের ভয়ে কাজ থেকে বিরত থাকা অনুচিত। কেননা দুঃখ ছাড়া সুখ লাভের কোনো উপায় নেই।

হৃদয়গ্রাহী সৌন্দর্যের কারণে ফুল সবার কাছে প্রিয়। কিন্তু তার গায়ে রয়েছে কাঁটা। তাকে পেতে হলে অতিক্রম করা দরকার কাঁটার বাধা। ফুল সংগ্রহকারীকে সহ্য করতে হবে কাঁটার আঘাত। এ আঘাতে হাত ক্ষতবিক্ষত হওয়াও বিচিত্র নয়। যিনি এ আঘাতের কষ্টটুকু বরণ করতে প্রস্তুত, তিনি অবশ্যই কমল পেতে পারেন। পৃথিবীতে মানুষের চলার পথ কখনোই কুসুমাস্তীর্ণ নয়। জীবনে সুখ-সমৃদ্ধি অর্জনের পূর্বশর্ত এই কণ্টকাকীর্ণ দুঃখময় পথে সমস্ত প্রতিক‚লতাকে হাসিমুখে বরণ করে অগ্রসর হওয়া। দুঃখকে বরণ করতে না শিখলে সুখ অর্জন করা সম্ভব নয়। কাঁটার আঘাতের ভয়ে কেউ পদ্মফুল সংগ্রহ করা থেকে বিরত থাকলে, তার পক্ষে কখনোই পদ্মফুল সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। ক্লান্তির ভয়ে পথিক ভীত হয়ে পড়লে তার পক্ষে কখনও গন্তব্যস্থলে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। তাই জীবনে চলার পথের সকল প্রতিক‚লতাকে তুচ্ছজ্ঞান করে দৃপ্ত সংকল্পে মানুষকে অগ্রসর হতে হয় ইপ্সিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য।

ফুলের শোভা মনভরে উপভোগের জন্য কাঁটার আঘাত সইতে হয়। তেমনিভাবে জীবনে সুখলাভের পূর্বশর্ত হচ্ছে দুঃখকে হাসিমুখে বরণ করে নিতে শেখা। শ্রমকে ভয় পেলে জীবনে সাফল্য আসে না। জীবনে কোনো মহৎ প্রাপ্তিই ত্যাগ-তিতিক্ষা ছাড়া অর্জিত হয় না।

৫২. দুর্জন বিদ্বান হইলেও পরিত্যাজ্য।

দুর্জনের স্বভাব-ধর্ম অন্যের ক্ষতি করা। তাই কোনো শিক্ষিত লোক যদি চরিত্রহীন হয়, তবে অবশ্যই তার সঙ্গ পরিহার করা উচিত। কারণ, তার কাছ থেকে উপকার পাওয়ার চেয়ে বরং ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

মানুষ্যত্ববিরোধী কৃপ্রবৃত্তিগুলো দুর্জন লোকের নিত্যসঙ্গী। এই ধরনের ব্যক্তির নৈতিক চরিত্র দুর্বল। সমাজ, দেশ বা জাতি কেউ এদের দ্বারা উপকৃত হয় না। এরা সমাজের কলঙ্ক। এরা আত্মকেন্দ্রিক, লোভী এবং স্বার্থপর। কোনো কোনো দুর্জন লোক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয় বটে, কিন্তু বাস্তবে হয় না জ্ঞানী। তাদের শিক্ষার সার্টিফিকেট একটি কাগজ ছাড়া অন্য কিছু নয়। সার্টিফিকেট-সর্বস্ব শিক্ষা এদের চরিত্র ও মানসিকতায় কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারে না। এরা শিক্ষিত হয়ে আরো ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। চাতুরি ও ছলনায় আরও ক‚টকৈৗশলী হয়ে এরা সহজ-সরল মানুষকে প্রতারিত করে। এদের সাহচর্যে সততার অপমৃত্যু ঘটে। মানুষের সবচেয়ে বড় গুণ তার চরিত্র। মানুষের এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ঠিক রেখে অপরাপর বৈশিষ্ট্যের বিকাশ ঘটানো আবশ্যক। তেমনি, বিদ্বান হওয়াও একটি গুণ। বিদ্যা অর্জনের মাধ্যমে মানুষ যথার্থ মানুষ হয়ে ওঠে। বিদ্বানের সংস্পর্শে এলে জ্ঞানের আলোয় মন আলোকিত হয়। কিন্তু বিদ্বান ব্যক্তি যদি চরিত্রহীন হয়, তবে তার বিদ্যার কোনো মূল্য থাকে না। সে তার বিদ্যাকে অন্যায় কাজে লাগায়। এরা নিজের স্বার্থ বা অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য যেকোনো কৌশলের আশ্রয় নিতে পারে। চরিত্রহীন বিদ্বান ব্যক্তির কাছ থেকে বিদ্যা লাভ করে জীবনে কোনো কল্যাণ সাধন করা যায় না। তাই দুর্জন যদি বিদ্বানও হয়, তবু তার সান্নিধ্য ও সংশ্রব ত্যাগ করাই মঙ্গলজনক।

বিদ্যা অমূল্য ধন। কিন্তু এ ধন অর্জনকারী ব্যক্তি চরিত্রহীন হলে তা অসৎ উদ্দেশ্যে কাজে লাগাতে পারে। তাই তার সঙ্গ পরিত্যাগ করাই শ্রেয়।

প্রিয় জন, বন্ধু-বান্ধবের সাথে শেয়ার করুন






2 comments:

  1. thank you so much🥰

    ReplyDelete
  2. অতৃপ্তিই অসুখের মূল ভাব সম্প্রসারণ

    ReplyDelete

Thank you, best of luck

Theme images by sbayram. Powered by Blogger.