ads

৫টি প্রবন্ধ রচনা:- আমাদের দেশ ; বাংলা নববর্ষ ; বাংলাদেশের কৃষক ; বাংলাদেশের উৎসব; বাংলাদেশের নদ-নদী।


আমাদের দেশ

সূচনা : সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা আমাদের এই বাংলাদেশ। সবুজে ঘেরা, পাখি ডাকা দেশটির রূপের কোনো শেষ নেই। কবির দেশ, বীরের দেশ, গানের দেশ, মায়ের দেশ- এ রকম অনেক নামে এ দেশকে ডাকা হয়। দেশের অবারিত ফসলের ক্ষেত, মাঠ-ঘাট, প্রকৃতি প্রভৃতির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তাই কবি গেয়ে উঠেছেন-

“এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,
সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি।”

অবস্থান ও আয়তন : বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি স্বাধীন দেশ। এর সীমান্তের অধিকাংশ জুড়ে রয়েছে ভারত। আর দক্ষিণ-পূর্বের সামান্য অংশে মিয়ানমার এবং দক্ষিণে রয়েছে বঙ্গোপসাগর। এ দেশের আয়তন ১,৪৭,৫৭০ বর্গকিলোমিটার।

স্বাধীনতা লাভ : ১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। এই স্বাধীনতা বাঙালি জাতির জীবনে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল একটি অধ্যায়। সুদীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণে বাঙালি জাতি ছিল দিশেহারা। পলাশীর যুদ্ধের পর ব্রিটিশদের দুশো বছরের অত্যাচারের অবসান ঘটিয়ে আবার শুরু হয় পাকিস্তানিদের অপশাসন। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ এই সময়কালে পাকিস্তানি শাসকচক্রের অত্যাচারে বাঙালি জাতি প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। তারা স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র হাতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অবশেষে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে দীর্ঘ নয় মাসের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের মানচিত্রে নাম লেখায় আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ।

জনসংখ্যা :  জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। বর্তমানে দেশটির জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি। আয়তনের তুলনায় এই জনসংখ্যা অনেক বেশি। ফলে প্রতিনিয়ত এই দেশকে অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ সামলাতে হচ্ছে। এই জনসংখ্যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ বাস করে ঢাকা শহরে।

ভাষা :  বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এ দেশে অনেক জাতি-গোষ্ঠীর লোক বাস করে। যেমনÑ চাকমা, মারমা, মুরং, সাঁওতাল, খুমি, লুসাই, বম, খেয়াং, রাখাইন ইত্যাদি। এদের প্রত্যেকেরই রয়েছে নিজস্ব ভাষা। তবে বাংলা-ই আমাদের রাষ্ট্রভাষা।

ভূ-প্রকৃতি :  বাংলাদেশ পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ। এ দেশের প্রায় সবটাই সমভূমি। তবে সিলেট, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কুমিল্লার কিছু অংশে পাহাড় রয়েছে। এছাড়া রয়েছে শত-সহস্র আঁকাবাঁকা নদ-নদী।

ঋতুবৈচিত্র্য :  বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। প্রতি দুই মাসে একটি করে ঋতুর পালাবদল ঘটে। একেক ঋতুতে প্রকৃতি একেক সাজে সেজে ওঠে। প্রতিটি ঋতুর সৌন্দর্যই অতুলনীয়। এ দেশের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মূল কারণ এই ঋতুবৈচিত্র্য। এ দেশে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত এই ছয়টি ঋতু বিদ্যমান। বৈশাখ মাস থেকে প্রতি দুই মাস অন্তর একটি করে ঋতু ধরা হয়।

জনজীবনের বৈচিত্র্য :  বাংলাদেশে আছে নানা ধর্মের, নানা পেশার লোকজন। ধর্মীয় দিক থেকে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খ্রিষ্টানই প্রধান। এছাড়া পেশার ক্ষেত্রে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, কৃষক, কামার, কুমোর নানা পেশার মানুষ। বাঙালি ছাড়াও দেশে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করে। তাদের আছে নিজস্ব জীবনযাপন পদ্ধতি। সব ধরনের মানুষ এ দেশে মিলেমিশে থাকে।

অর্থনৈতিক অবস্থা : বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। অর্থাৎ সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে পরিচিত হওয়া থেকে এখনও আমরা অনেক পিছিয়ে। তবে আমাদের অর্থনীতি খুবই দ্রæত বিকাশ লাভ করেছে। এ দেশ মূলত কৃষিনির্ভর হলেও বিভিন্ন শিল্পখাত থেকে আমরা অনেক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছি। তাছাড়া আমরা প্রশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর সাহায্যে বিভিন্ন দেশ থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা লাভ করি।

প্রাকৃতিক সম্পদ :  বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ একটি দেশ। প্রাকৃতিক গ্যাস আমাদের প্রধান সম্পদ। এছাড়াও রয়েছে কয়লা, চুনাপাথর, খনিজ তেল, আকরিক, চীনামাটি প্রভৃতি। এসব খনিজ সম্পদ উত্তোলনের মাধ্যমে নাগরিক জীবনে ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়া বাংলাদেশ তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কমিটি দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রাকৃতিক সম্পদের অনুসন্ধান চালাচ্ছে।

উপসংহার :  বাংলাদেশ আমাদের গর্ব ও অহংকার। অনেক আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা এ দেশকে স্বাধীন করেছি। দেশকে আমরা মায়ের মতো ভালোবাসি। এ দেশে রয়েছে মনোরম প্রকৃতি। পাহাড়, নদী, গাছপালা, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর দেশের সৌন্দর্যকে আরও ফুটিয়ে তুলেছে। তাই দেশের সৌন্দর্যে সকলেই মুগ্ধ হয়।


বাংলা নববর্ষ

সূচনা : বাংলা নববর্ষ বাঙালির জাতীয় জীবনে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। গতানুগতিক জীবনধারার মধ্যে নববর্ষ নিয়ে আসে নতুন সুর, নতুন উদ্দীপনা। পুরোনো দিনের গøানি জরাকে মুছে দিয়ে একরাশ হাসি, আনন্দ আর গান দিয়ে ভুলিয়ে দিয়ে যায় নববর্ষ। প্রাচীনকাল থেকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এটি বাঙালির আনন্দময় উৎসব হিসেবে সুপরিচিত। বাংলা নববর্ষ তাই বাঙালির জাতীয় উৎসব।

বঙ্গাব্দ বা বাংলা সনের ইতিহাস :  বঙ্গাব্দ বা বাংলা সন প্রচলনের ইতিহাস রহস্যে ঘেরা। কোনো কোনো ইতিহাসবিদ মনে করেন, বাংলার সুলতান হোসেন শাহ বাংলা সনের প্রবর্তক। কারো কারো মতে, দিল্লির সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রচলন করেন। তাঁর নির্দেশে আমির ফতেউল্লাহ সিরাজি পূর্বে প্রচলিত হিজরি ও চান্দ্র বছরের সমন্বয়ে সৌরবছরের প্রচলন করেন। তবে সুলতান হোসেন শাহের সময়ে (৯০৩ হিজরি) বাংলা সনের প্রচলন হলেও সম্রাট আকবরের সময় (৯৬৩ হিজরি) থেকেই এটি সর্বভারতীয় রূপ লাভ করে। তখন থেকেই এটি বাঙালি সংস্কৃতির সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। বাংলা সন আপামর বাঙালি জাতির একান্ত নিজস্ব অব্দ।

নববর্ষের উৎসব :  বাঙালিরা প্রাচীনকাল থেকেই নববর্ষ উদ্যাপন করে আসছে। তখন বাংলার গ্রামীণ কৃষক সমাজই ছিল এই উৎসবের মূল। যে সময় বছর শুরু হতো অগ্রহায়ণ মাস থেকে। এটি ছিল ফসল কাটার সময়। সরকারি রাজস্ব ও ঋণ আদায়ের এটিই ছিল যথার্থ সময়। পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা সনের প্রচলন হলে বৈশাখ মাস থেকে বর্ষ গণনা শুরু হয়। আর বাঙালিরা পহেলা বৈশাখে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন করে। বাংলাদেশে নববর্ষ উদ্যাপনে এসেছে নতুন মাত্রা। বর্তমানে আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে নববর্ষ পালন করা হয়।

পহেলা বৈশাখ : বিগত দিনের সমস্ত গøানি মুছে দিয়ে, পাওয়া না পাওয়ার সব হিসাব চুকিয়ে প্রতিবছর আসে পহেলা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষ। মহাধুমধামে শুরু হয় বর্ষবরণ। সবাই গেয়ে ওঠে রবীন্দ্রনাথের এই গান :

এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ,
তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনাÑ দূর হয়ে যাক।

বাংলা নববর্ষের অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে পহেলা বৈশাখে অনুষ্ঠিত বৈশাখী মেলা। এটি একটি সর্বজনীন উৎসব। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের মহামিলনক্ষেত্র এই মেলা। এ মেলায় আবহমান গ্রামবাংলার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের একটি পরিচিতি ফুটে ওঠে। বাউল, মারফতি, মুর্শিদি, ভাটিয়ালিসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকগানে মেলার আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়। যাত্রা, নাটক, পুতুল নাচ, সার্কাস, নাগরদোলা ইত্যাদি মেলায় বিশেষ আকর্ষণ সৃষ্টি করে। মেলায় পাওয়া যায় মাটির হাঁড়ি, বাসনকোসন, পুতুল; বেত ও বাঁশের তৈরি গৃহস্থালির সামগ্রী, তালপাখা, কুটিরশিল্পজাত বিভিন্ন সামগ্রী, শিশু-কিশোরদের খেলনা, নারীদের সাজ-সজ্জা ইত্যাদি। এছাড়া চিড়া, মুড়ি, খৈ, বাতাসাসহ নানা রকমের মিষ্টির বৈচিত্র্যময় সমারোহ থাকে বৈশাখি মেলায়। বৈশাখি মেলা ছাড়াও বাংলা নববর্ষের আরেকটি আকর্ষণ হালখাতা। এদিন গ্রামে-গঞ্জে-শহরে ব্যবসায়ীরা তাদের পুরোনো হিসাব-নিকাশ শেষ করে নতুন খাতা খোলেন। এ উপলক্ষ্য্যে তাঁরা নতুন-পুরোনো খদ্দেরদের আমন্ত্রণ জানিয়ে মিষ্টি খাওয়ান। প্রাচীনকাল থেকে এখনো এ অনুষ্ঠানটি বেশ জাঁকজমকভাবে পালিত হয়ে আসছে।

নববর্ষের প্রভাব : বাংলা নববর্ষ বাঙালির জাতীয় জীবনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। এদিন দেশের সর্বত্র সরকারি ছুটি থাকে। পারিবারিকভাবে বিশেষ খাবারের আয়োজন করা হয়। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনকে নিমন্ত্রণ জানানো হয়। সব কিছুতে আনন্দের ছোঁয়া লাগে। আধুনিক রীতি অনুযায়ী ছোট-বড় সবাই নববর্ষের শুভেচ্ছা কার্ড বিনিময় করে। অতীতের লাভ-ক্ষতি ভুলে গিয়ে এদিন সবাই ভবিষ্যতের সম্ভাবনার স্বপ্ন বোনে। নববর্ষ আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে চলার প্রেরণা জোগায়।

নববর্ষের তাৎপর্য : বাঙালির নববর্ষের উৎসব নির্মল আনন্দের উৎসধারা। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এটি আজ আমাদের জাতীয় উৎসব। নববর্ষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে আমরা আমাদের জীবনবাদী ও কল্যাণধর্মী রূপটিই খুঁজে পাই। আমাদের ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক চেতনাকে প্রত্যক্ষ করি। আমাদের নববর্ষ উদ্যাপনে আনন্দের বিস্তার আছে, কিন্তু কখনো তা পরিমিতবোধকে ছাড়িয়ে যায় না। বাংলা নববর্ষ তাই বাঙালির সারা বছরের আনন্দের পসরা-বাহক।

উপসংহার : বাংলা নববর্ষ বাঙালিকে নতুন দিনের স্বপ্ন দেখায়। পুরোনোকে ভুলে গিয়ে নতুনকে গ্রহণের প্রেরণা দান করে। আমাদের জীবনে নবচেতনার সঞ্চার করে, পরিবর্তনের একটা বার্তা নিয়ে আসে নববর্ষ। আমাদের মানবিক মূল্যবোধকে জাগ্রত করে; জাতীয় জীবনে স্বকীয় চেতনা বিকাশে উদ্বুদ্ধ করে। প্রাচীনকাল থেকে বাঙালি জাতি বাংলা নববর্ষের এই চেতনাকে বুকে লালন করে চলেছে অবিরামভাবে। তাই বাংলা নববর্ষ আমাদের জীবনে এত আনন্দ ও গৌরবের।

বাংলাদেশের কৃষক

সূচনা :  বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এ দেশের শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ লোক কৃষক। কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রমে এ দেশ ভরে ওঠে ফসলের সমারোহে। আমরা পাই ক্ষুধার আহার। কৃষকের উৎপাদিত ফসল বিদেশে রফতানি করে দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হয়। বলতে গেলে, কৃষকই আমাদের জাতীয় উন্নয়নের চাবিকাঠি; আমাদের জাতির প্রাণ। কবির ভাষায় :

সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা,
দেশ মাতারই মুক্তিকামী, দেশের সে যে আশা।

কৃষকের অতীত ইতিহাস : প্রাচীনকালে এ দেশে জনসংখ্যা ছিল কম, জমি ছিল বেশি। উর্বরা জমিতে প্রচুর ফসল হতো। তখন শতকরা ৮৫ জনই ছিল কৃষক। তাদের গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু আর পুকুর ভরা থাকত মাছে। তাদের জীবন ছিল সুখী ও সমৃদ্ধ। তারপর এলো বর্গীর অত্যাচার, ফিরিঙ্গি-পর্তুগিজ জলদস্যুদের নির্যাতন, ইংরেজদের খাজনা আদায়ের সূর্যাস্ত আইন, শোষণ ও নিপীড়ন। এলো মন্বন্তর, মহামারি। গ্রামবাংলা উজাড় হলো। কৃষক নিঃস্ব হয়ে গেল। সম্পদশালী কৃষক পরিণত হলো ভূমিহীন চাষিতে। দারিদ্র্য তাকে কোণঠাসা করল। কৃষকের জীবন হয়ে উঠল বেদনাদায়ক। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় : 

স্কন্ধে যত তার চাপে ভার
বহি চলে মন্দগতি যতক্ষণ থাকে প্রাণ তার
তারপর সন্তানেরে দিয়ে যায় বংশ বংশ ধরি
… শুধু দুটি অন্ন খুঁটি কোনো মতে কষ্ট-ক্লিষ্টপ্রাণ
রেখে দেয় বাঁচাইয়া।

এভাবেই এককালের সুখী ও সমৃদ্ধ কৃষকের গৌরবময় জীবন-ইতিহাস অন্ধকারে হারিয়ে যায়।

বর্তমান অবস্থা :  বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে। কিন্তু বাঙালি কৃষকের উদ্বাস্তু, অসহায় ও বিষণœ জীবনের কোনো রূপান্তর ঘটেনি। বাংলার কৃষক আজও শিক্ষাহীন, বস্ত্রহীন, চিকিৎসাহীন জীবন-যাপন করছে। দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে, কমেছে কৃষি জমির পরিমাণ। জমির উর্বরতাও গেছে কমে। ফলে বাড়তি মানুষের খাদ্য জোগানোর শক্তি হারিয়েছে এ দেশের কৃষক। পৃথিবীজুড়ে চাষাবাদ পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটেছে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে উন্নত দেশ কৃষকের শক্তি বৃদ্ধি করছে। কিন্তু এ দেশে এখনো মান্ধাতার আমলের চাষাবাদ ব্যবস্থা বহাল আছে। বাংলার কৃষকও ভোঁতা লাঙল আর কলঙ্কালসার দুটো বলদের পেছনে ঘুরতে ঘুরতে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, বন্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ- কোনো কিছুই মোকাবেলা করার কৌশল ও সামর্থ্য কৃষকের নেই। তবে ধীরে ধীরে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে। কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি ও উন্নত পদ্ধতি প্রয়োগের গুরুত্ব বাড়ছে। স¤প্রতি ব্যাংক, সমবায় সমিতি বা মহাজনের ঋণের টাকায় আর উচ্চ ফলনশীল বীজের সাহায্যে কৃষিতে ফলন বেড়েছে। কিন্তু ক্ষেতের ফসল কৃষকের ঘরে ওঠার আগেই ব্যাংক, সমবায় প্রতিষ্ঠান কিংবা মহাজনের ঋণ পরিশোধ করতে হয়। তাই কৃষকের সুখ-স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। কৃষি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান অবলম্বন হলেও কৃষকের শোচনীয় অবস্থার পরিবর্তন হয় না। এখনো তারা নানা রোগ-শোক, অশিক্ষা-কুশিক্ষা, দারিদ্র্য ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে।

কৃষকের উন্নয়ন : বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর দেশ। দেশীয় অর্থনীতিতে কৃষির অবদানও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। তাই দেশের উন্নয়নের স্বার্থে কৃষকের উন্নয়ন সাধন করা দরকার। বাংলার কৃষকের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য আজ সবচেয়ে বেশি দরকার চাষাবাদে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রবর্তন। নিজের জমিতে কৃষক যেন স্বল্পমূল্যে উন্নত বীজ, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক পায় তার ব্যবস্থা করা। প্রয়োজনে কৃষককে সুদমুক্ত ঋণ প্রদান করতে হবে। আবার কৃষক তার ফসলের যেন ন্যায্য দাম পায় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। আমাদের দেশের অধিকাংশ কৃষকই অশিক্ষিত। তাদের শিক্ষিত করে তুলতে হবে। আধুনিক কৃষি-যন্ত্রপাতি ব্যবহার করার জন্য তাকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সারা বছর কৃষকের কাজ থাকে না। তাই তার অবসর সময়টুকু অর্থপূর্ণ করার জন্য কুটিরশিল্প সম্পর্কে তাকে আগ্রহী করে তুলতে হবে। সেই সঙ্গে কৃষকের চিত্তবিনোদন ও রোগ-ব্যাধির চিকিৎসারও সুবন্দোবস্ত করতে হবে।

উপসংহার : বাংলার কৃষকরাই বাঙালি জাতির মেরুদণ্ড। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি তারা। তবুও কৃষকরা বহুকাল ধরে অবহেলিত। বিশেষ করে তাদের সামাজিক মর্যাদা এখনো নিম্নমানের। এ বিষয়ে আমাদের সকলের সচেতন দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। কৃষক ও কৃষিকে গুরুত্ব দিলেই আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল থাকবে। দেশের দারিদ্র্য দূর হবে। বাংলার ঘরে ঘরে ফুটে উঠবে স্বাচ্ছন্দ্যের ছবি। বলা যায়, কৃষকের আত্মার ভেতরই লুকিয়ে আছে আমাদের সমৃদ্ধি ও প্রাচুর্যের বীজ।

বাংলাদেশের উৎসব

ভূমিকা : বাংলাদেশ উৎসবের দেশ। বাঙালি জাতি উৎসবমুখর জাতি হিসেবে বিশ্বে পরিচিত। এই বাংলার বুকে নানা ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের মানুষের বসবাস রয়েছে। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবাই মিলেমিশে বাস করে এই বাংলায়। নানা ধর্মের মানুষের নানা উৎসবে বাংলাদেশ বর্ণিল হয়ে ওঠে। একের উৎসবে অন্যরাও স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে অংশগ্রহণ করে থাকে। বাঙালির এ উৎসব উদ্যাপন যেন রবীন্দ্রনাথের সেই উক্তিকেই স্মরণ করিয়ে দেয়Ñ ‘আমার আনন্দ সকলের আনন্দ হউক, আমার শুভ সকলের শুভ হউক, আমি যাহা পাই, তাহা পাঁচজনের সহিত মিলিত হইয়া উপভোগ করি- এই কল্যাণী ইচ্ছাই উৎসবের প্রাণ।’

বাংলাদেশের বিভিন্ন উৎসব : বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন ধরনের উৎসবের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। এসব উৎসবের কোনোটা ধর্মীয়, কোনোটা সামাজিক এবং কোনোটা পারিবারিক। বাংলাদেশে প্রচলিত নানা ধরনের এসব উৎসব সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো-

(ক) ধর্মীয় উৎসব :  বাংলাদেশে নানা ধর্মের মানুষ বসবাস করে। প্রত্যেকের উৎসবও আলাদা আলাদা। ধর্মীয় উৎসবগুলোর মধ্যে মুসলমানদের দুটি ঈদ, হিন্দুদের দুর্গাপূজা, কালীপূজা, সরস্বতী পূজা, জন্মাষ্টমী, খ্রিস্টানদের ইস্টার সানডে, বড়দিন, বৌদ্ধদের বুদ্ধ পূর্ণিমা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

(১) ঈদ : মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব হলো ঈদুল ফিতর। রমজান মাসে পুরো এক মাস রোযা রাখার পর আসে ঈদুল ফিতরের আনন্দঘন মুহূর্ত। এ দিন সবাই নতুন পোশাক পরিধান করে, ঈদের জামাতে যোগ দেয়, মিষ্টিমুখ করে এবং আরও নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ঈদের আনন্দকে সবার মাঝে ভাগ করে নেয়। মুসলমানদের আরেকটি বৃহৎ উৎসব হলো ঈদুল আজহা। একে কোরবানির ঈদও বলা হয়। এটি হচ্ছে আত্মত্যাগের ঈদ। এ ঈদেও অত্যন্ত আনন্দের সাথেও জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালন করা হয়।

(২) পূজা : হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব হলো দুর্গাপূজা। শরৎকালে এ পূজা হয় বলে একে শারদীয় দুর্গোৎসবও বলা হয়। আশ্বিন মাসে যে চাঁদ ওঠে তার সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী এই তিন দিন পূজা অনুষ্ঠিত হয়। দশমীর দিন মাকে বিসর্জন দেওয়া হয় পুকুরে বা নদীতে। এ পূজা অত্যন্ত উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালিত হয়। এছাড়া হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মাঝে সরস্বতী পূজা, কালী পূজা, ল²ীপূজা পৃভৃতিতে উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

(৩) বড়দিন : বড়দিন হলো যিশুখ্রিস্টের জন্মদিন। এ দিনকে ঘিরে খ্রিস্টান স¤প্রদায় বেশ আনন্দ করে থাকে। গির্জায় গিয়ে প্রার্থনা করার পর সকলের সাথে কুশল বিনিময়ের মাধ্যমে বড়দিনের উৎসব উদ্যাপনের সূচনা হয়।

(৪) বৌদ্ধ পূর্ণিমা : বৌদ্ধ পূর্ণিমা হলো গৌতম বুদ্ধের জন্মদিন। এদিন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা উৎসব পালন করে থাকে। বৌদ্ধবিহারে এদিন অনুষ্ঠিত হয় প্রভাবফেরি, ফুলপূজা, প্রদীপপূজা প্রভৃতি। এছাড়া বিহারগুলোতে এদিন পঞ্চশীল ও অষ্টশীল প্রদান করা হয়।

(খ) সামাজিক উৎসব : সামাজিক উৎসব পালনের মূল উদ্দেশ্য হলো আনন্দ উপভোগ করা। বাংলাদেশের সামাজিক উৎসবের মধ্যে বিভিন্ন জাতীয় উৎসবও রয়েছে।

(১) স্বাধীনতা দিবস : ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরুর পথ উন্মুক্ত হয়। আমরা প্রতিবছর আনন্দের সাথে দিনটি পালন করে থাকি।

(২) বিজয় দিবস : আমরা বিজয় দিবস উদ্যাপন করে থাকি প্রতিবছরের ১৬ই ডিসেম্বরে। এ দিনই আমরা স্বাধীন দেশ ও জাতি হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছিলাম। তাই বিজয় দিবস আমাদের কাছে বিশেষ তাৎপর্যবহ।

(৩) নবর্বষ : নববর্ষ বাঙালির অন্যতম সামাজিক উৎসব। প্রতিবছর পয়লা বৈশাখের দিন আমরা নববর্ষ উদ্যাপন করি। নববর্ষকে ঘিরে সারা দিনব্যাপী আয়োজনের মধ্যে রয়েছেÑ মঙ্গল শোভাযাত্রা, বৈশাখী মেলা, হালখাতা ইত্যাদি। সর্বস্তরের জনগণ এ উৎসব অত্যন্ত আনন্দের সাথে উদ্যাপন করে থাকে। এটি এখন সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে।
এছাড়াও আরও যেসব সামাজিক উৎসব রয়েছে সেগুলো হলো-

(১) পহেলা ফাল্গুন : বাঙালি উৎসবমুখর জাতি। উৎসবের তালিকায় পহেলা ফাল্গুন এমনি একটি উৎসব। বসন্তকে বরণ করে নিতে এ উৎসব পালন করা হয়। বাসন্তী রঙের নিজেকে রাঙিয়ে তোলে সবাই পহেলা ফাল্গুনের দিনে।

(২) পৌষ-পার্বণ : এটি মূলত পিঠা উৎসব। এ উৎসবের মূল আকর্ষণ হলো নানা ধরনের পিঠা বানিয়ে খাওয়া। এছাড়া পুরান ঢাকার অধিবাসীরা এদিনে ঐতিহ্যবাহী ঘুড়ি উৎসবও উদ্যাপন করে থাকে।

(৩) বিভিন্ন ধরনের মেলা :  আমাদের দেশে নানা উৎসবকে ঘিরে বিভিন্ন মেলা সকল মানুষের পদচারণে মুখর হয়ে ওঠে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- বৈশাখি মেলা, একুশের বইমেলা, বাণিজ্য মেলা ইত্যাদি।

(৪) ক্রিকেট খেলা : বর্তমান সময়ে ক্রিকেট খেলাও একটি উৎসবে পরিণত হয়েছে। সকলে মিলে হইচই করে স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলা দেখার আনন্দ উপভোগ করে। ওয়ানডে ম্যাচ, টি-টোয়েন্টি এরূপ বিভিন্ন খেলা মানুষকে আনন্দ দিতেই আয়োজিত হয়ে থাকে। তাই এগুলোও এখন সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়েছে।

(৫) বিখ্যাত ব্যক্তিদের স্মরণোৎসব :  বাংলাদেশে বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তিদের স্মরণে নানা উৎসব পালন করা হয়। এসব উৎসবের মধ্যে রয়েছেÑ নজরুল জয়ন্তী, রবীন্দ্র জয়ন্তী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মোৎসব এবং অন্য মহান নেতাদের স্মরণেও অনুষ্ঠান করা হয়।

(৬) পারিবারিক উৎসব : পারিবারিক উৎসবে সাধারণত পরিবারের সদস্য, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং ঘনিষ্ঠজনরাই উপস্থিত থাকে। পারিবারিক উৎসবের মধ্যে রয়েছেÑ বিয়ে, জন্মদিন, অন্নপ্রাশন, খাৎনা, শ্রাদ্ধানুষ্ঠান ইত্যাদি।

উৎসবের তাৎপর্য :  আমাদের দেশে যেসব উৎসব উদ্যাপিত হয় তার সবগুলোই সাম্য, মৈত্রী ও ঐক্যের কথা বলে। বিভিন্ন উৎসবে নানা ধর্ম-বর্ণের মানুষের অংশগ্রহণ বাঙালির সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতিকেই উপস্থাপন করে। মানুষে মানুষে আত্মিক বন্ধন স্থাপনে ভূমিকা রাখে এই উৎসব। উৎসবের মাঝেই ছড়িয়ে থাকে বাঙালির প্রাণের আকুতি। একটি উৎসবকে কেন্দ্র করেই গোটা জাতি একটি পরিবারে রূপ নেয়। আনন্দমুখর পরিবেশে উৎসব উদ্যাপনে মানুষের মনের মলিনতা দূর হয়ে যায়।

উপসংহার : আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একঘেয়েমি দূর করতে উৎসব জাদুমন্ত্রের মতো কাজ করে। মানুষের মাঝে নির্মল আনন্দের সঞ্চার করে উৎসব। তাই সকল ব্যবধান ভুলে গিয়ে উৎসবের মূল উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে হবে এবং বিশুদ্ধ আনন্দকে হৃদয় দিয়ে উপভোগ করতে হবে। উৎসবের শালীনতা ও পবিত্রতা বজায় রেখে প্রকৃত অর্থে উৎসব পালনের জন্য সকলের সচেতন থাকা আবশ্যক। তবেই উৎসবের প্রকৃত আনন্দ উপভোগ করা সম্ভব হবে।

বাংলাদেশের নদ-নদী

সূচনা :  বাংলাদেশ একটি নদীবিধৌত বদ্বীপ। এ দেশের বুক জুড়ে জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে শত শত নদী। এই নদীগুলো বাংলাদেশের প্রাণ। বাংলার মানুষের জীবনযাপনের সাথে এগুলো নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। অতি প্রাচীনকাল থেকেই এসব নদ-নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে এ দেশের মানুষে জীবনব্যবস্থা। ফলে বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেছে।

প্রধান নদ-নদী :  বাংলাদেশে শাখা-প্রশাখাসহ নদ-নদীর সংখ্যা প্রায় ২৩০টি। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র বাংলাদেশের প্রধান নদ-নদী।

পদ্ম :  পদ্মা বাংলাদেশের প্রধান নদী। এটি ভারতের হিমালয় পাহাড়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপত্তি হয়েছে। উৎপত্তির পর ভারতের ওপর দিয়ে গঙ্গা নামে প্রবাহিত হয়ে রাজশাহী অঞ্চল দিয়ে পদ্মা নাম ধারণ করে এটি আমাদের দেশে প্রবেশ করেছে। সেখান থেকে গোয়ালন্দের কাছে যমুনা নদী এবং চাঁদপুরে মেঘনার সাথে মিশে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে।

মেঘনা : মেঘনা বাংলাদেশের আরেকটি প্রধান নদী। ভারতের বরাক নদটি সুরমা ও কুশিয়ারা নামের দুটি শাখায় ভাগ হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। চাঁদপুরের কাছে এসে এ দুটি নদী মিলিত হয়ে মেঘনা নাম ধারণ করেছে। পরবর্তীতে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে নদীটি পতিত হয়েছে। এটি বাংলাদেশের বৃহত্তম নদী।

যমুনা : তিব্বতের সানপু নদীটি আসামের মধ্য দিয়ে যমুনা নাম নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ধরলা, তিস্তা ও করতোয়া যমুনার প্রধান উপনদী। বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরী যমুনার প্রধান শাখানদী।

ব্রহ্মপুত্র : হিমালয় পর্বতের কৈলাশ শৃঙ্গের মানস সরোবর হ্রদ থেকে ব্রহ্মপুত্র নদের উৎপত্তি। নদীটি তিব্বত ও আসামের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুড়িগ্রামের কাছে এসে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এরপর জামালপুরের কাছে দুভাগে বিভক্ত হয়ে প্রধান স্রোতটি জামালপুরের পশ্চিম প্রান্ত ঘেঁষে যমুনা নামে এবং অপরটি পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নামে ময়মনসিংহের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মেঘনার সাথে মিশেছে।

অন্যান্য নদী : এ নদীগুলো ছাড়াও আমাদের দেশে রয়েছে আরও অনেক নামকরা নদনদী। সেগুলোর মধ্যে কর্ণফুলী, কুশিয়ারা, বুড়িগঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, শীতলক্ষ্যা, মধুমতি, সুরমা, তিস্তা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এসব নদীর কোনোটি প্রধান নদীর শাখা নদী আবার কোনোটি উপনদী।

নদীর সৌন্দর্য : বাংলাদেশের নদীগুলোর সৌন্দর্য তুলনাহীন। নদীর বুকের সোনালি স্রোত, পাল তুলে ভেসে চলা নৌকা, নদীর পাড়ের ছবির মতো ঘরবাড়ি ও গাছপালা সবকিছু মিলে অসাধারণ দৃশ্য সৃষ্টি করে। নদীর দুই ধারের কাশবন, বাড়িঘর সবকিছু ছবির মতো লাগে। বর্ষায় পানিতে ভরে গেলে নদ-নদীগুলো আরও প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠে।

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নদ-নদীর প্রভাব : বাংলাদেশে প্রাচীনকাল থেকেই নদীকেন্দ্রিক জীবনব্যবস্থা প্রচলিত। নদীর সঙ্গে আমাদের জীবন গভীরভাবে জড়িত। আমাদের যাতায়াতের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হচ্ছে নদীপথ। নদীকে ঘিরে গড়ে উঠেছে এ দেশের অনেক ব্যবসা-বাণিজ্যকেন্দ্র। আমাদের কৃষিক্ষেত্র অনেকাংশেই নদীর ওপর নির্ভরশীল। এ দেশের কবি-সাহিত্যিক ও শিল্পীরা নদীকে নিয়ে সৃষ্টি করেছেন অসংখ্য সাহিত্যকর্ম।

নদ-নদীর উপকারিতা : বাংলাদেশকে সবুজে-শ্যামলে ভরে তোলার পেছনে নদ-নদীর ভূমিকা অপরিসীম। নদীর পানিতে বয়ে আসা পলি প্রাকৃতিকভাবে আমাদের মাটিকে উর্বর করেছে। আমাদের কৃষির অগ্রগতিতে তাই নদীর ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কৃষিক্ষেত্র ছাড়াও নদীগুলো মিঠা পানির মাছের অন্যতম উৎস। নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে অসংখ্য মানুষ। দেশীয় প্রয়োজন মিটিয়েও মাছ বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা হয়। এ ছাড়া পরিবহন-সংক্রান্ত কাজেও নদীকে ব্যবহার করা হয়। একশ্রেণির মানুষ এ কাজ করেই তাদের জীবিকা নির্বাহ করে। সর্বোপরি নদীকেন্দ্রিক বাংলাদেশে আমরা নদীর কাছ থেকে বিভিন্ন উপকার ভোগ করে থাকি।

নদ-নদীর অপকারিতা : নদীর কিছু অপকারিতাও আমাদের চোখে পড়ে। বর্ষাকালে নদীগুলো ফুলে-ফেঁপে ওঠে। তখন বন্যা দেখা দেয়। এছাড়া নদীর প্রবল স্রোতে ভাঙন শুরু হয়। কখনো কখনো কোনো কোনো গ্রাম ভাঙতে ভাঙতে নদীর মাঝে সম্পূর্ণ হারিয়ে যায়। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মানুষের ঘরবাড়ি, জমিজমা, গাছপালা, গবাদিপশু ও গৃহসামগ্রী। অনেক সময় নদীর প্রবল স্রোতে মানুষের জীবনহানিও ঘটে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় দশ লক্ষ মানুষ নদীভাঙনের শিকার হয়।

উপসংহার : বাংলাদেশ নদীর দেশ। এ দেশের মানুষের জীবন জীবিকা সর্বক্ষেত্রেই নদীর রয়েছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব। তাই এদের বাঁচিয়ে রাখা আমাদের সবার দায়িত্ব। নদ-নদীর অবদানেই আমাদের এ বাংলাদেশ সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা হয়েছে।

No comments

Thank you, best of luck

Theme images by sbayram. Powered by Blogger.