ads

প্রযুক্তি : করোনায়



করোনা ভাইরাস মহামারির মধ্যে দেশে প্রযুক্তির বিপ্লব ঘটেছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, করোনা না এলে এই বিপ্লব ঘটতে আরো পাঁচ বছরের বেশি সময় লাগত। করোনা শুরুর পর গত ৯ মাসে ইন্টারনেট ব্যবহার বেড়েছে আড়াই গুণেরও বেশি। গ্রাহকও বেড়েছে ১ কোটির বেশি। ই-কমার্সে লেনদেন ২০ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে। অফিস থেকে শুরু করে পড়াশোনা—সবকিছুই এখন প্রযুক্তিনির্ভর। তবে ইন্টারনেট সেবায় মহা-অসন্তুষ্ট গ্রাহক। কাঙ্ক্ষিত সেবা মিলছে না। শুধু মোবাইল ফোন নয়, ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটেও চাহিদা অনুযায়ী গতি মিলছে না। পাশাপাশি প্রযুক্তিনির্ভর প্রতারণাও বেড়ে গেছে অনেক গুণ।

টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন-, ‘বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ পরিকল্পনা শুনে যারা হেসেছিলেন, এখন করোনার মধ্যে তারা বুঝতে পেরেছেন এই পরিকল্পনা কতটা বাস্তবসম্মত ছিল। আজ যদি আমরা প্রযুক্তির পথে না হাঁটতাম, তাহলে কতটা পিছিয়ে পড়তাম সেটা এখন অনেকেই বুঝেছেন। এই সেক্টরে এখনো অনেক সমস্যা রয়ে গেছে। সেগুলো এখন আমাদের সামনে এসেছে। গ্রাহকেরা যে সঠিকভাবে সেবা পাচ্ছেন না, সেটা আমি অস্বীকার করব না। আমরা বারবার চাপ দিচ্ছি। আসলে মোবাইল অপারেটরদের কাছে পর্যাপ্ত তরঙ্গ নেই। কিন্তু তারা সেটা কিনছেও না। ফলে কম তরঙ্গ দিয়ে বেশি মানুষকে সেবা দিতে গিয়ে তারা ভালো সেবা দিতে পারছে না। এটারও সমাধান হবে।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থনীতি, শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ— সবকিছুতেই লেগেছে প্রযুক্তিনির্ভরতার ছোঁয়া। ঘরে বসেই চলছে অফিসের কাজ। প্রধানমন্ত্রীর মিটিং, ব্যাংক-বিমা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, করপোরেট কোম্পানিসহ বড় বড় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং করছেন বাসা থেকে। শিক্ষার্থীদের ক্লাস-পরীক্ষা, ভর্তি, চাল-ডাল-সবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনা, অসুস্থ রোগীর চিকিত্সা—কোনো কিছুর জন্যই বের হতে হচ্ছে না ঘর থেকে। অনলাইনে চলছে আদালতের বিচারকাজ। করোনা বদলে দিয়েছে সবকিছু। আকস্মিক এক পরিস্থিতিতে বিপ্লব ঘটে গেছে প্রযুক্তির। বিশেষজ্ঞদের মতে, যেভাবে হঠাৎ করেই প্রযুক্তিনির্ভরতা বেড়ে গেছে, তাতে প্রচলিত প্রযুক্তির পরিবর্তে উচ্চগতির ফাইবারভিত্তিক কানেকটিভিটি দরকার। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও টেলিমেডিসিন সেবা, অনলাইন প্রশিক্ষণ, বাণিজ্যিক সভা-সম্মেলন প্রভৃতি খাতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) ও বিগডাটা প্রয়োগ বৃদ্ধি পাবে।

দেশে চলতি বছরের শুরুতে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের ব্যবহার ছিল সর্বোচ্চ ৯০০ জিবিপিএস। বছর শেষে সেই ব্যান্ডউইথের ব্যবহার দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২০০ জিবিপিএসে। অর্থাৎ প্রায় আড়াই গুণ। অন্যদিকে গত ফেব্রুয়ারিতে ইন্টারনেটের গ্রাহক ছিল ৯ কোটি ৯৯ লাখ ৮৪ হাজার। ৩০ নভেম্বর সেই ইন্টারনেট গ্রাহক দাঁড়িয়েছে ১১ কোটি ৫ লাখ ৬১ হাজারে। এর মধ্যে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট গ্রাহক ফেব্রুয়ারিতে ৫৭ লাখ ৪৩ হাজার থেকে বেড়ে নভেম্বর শেষে দাঁড়িয়েছে ৮৬ লাখ ৬৭ হাজারে।

করোনার মধ্যে ই-কমার্স ব্যবসায় বিস্ফোরণ ঘটেছে। বর্তমানে ই-কমার্সের বাজার ২০ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে, যা গত বছরের ডিসেম্বরেও ছিল ১৩ হাজার ১০০ কোটি টাকা। প্রতিযোগিতা কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৬ সালের পর থেকে দেশে ই-কর্মাস ব্যবসার প্রবৃদ্ধি হতে শুরু করেছে। ২০১৭ সালে ই-কর্মাস বাজারের আকার ছিল ৮ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের শেষে গিয়ে দাঁড়ায় ১০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। গত আগস্ট মাসের শেষে দেশে ই-কর্মাস বাণিজ্যের বাজার ছিল ১৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ফেব্রুয়ারি মাসের তুলনায় করোনা ভাইরাস-পরবর্তী সময়ে দেশে আন্তঃব্যাংক ইন্টারনেট ব্যাংকিং সেবার প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২১৪ শতাংশ। আন্তর্জাতিক পেমেন্ট সিস্টেম নেটওয়ার্ক মাস্টার কার্ডের হিসাবে করোনা ভাইরাসের আগে বাংলাদেশে ই-কমার্সে ডিজিটাল পেমেন্টের পরিমাণ ১৫ শতাংশের মতো ছিল। এখন এই লেনদেনের পরিমাণ দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে বলে তাদের মত। করোনার মধ্যে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে ৫০ লাখের মতো। এখন মোবাইল অপারেটরদের সঙ্গে এমএফএস কোম্পানিগুলোর পার্টনারশিপ হচ্ছে। এর মধ্যে নগদের সঙ্গে টেলিটক, রবি ও গ্রামীণফোনের চুক্তির ফলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে এমএফএস একাউন্ট খোলা ও ব্যবহার করা যাচ্ছে।

তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য ও সেবা চালুর মধ্যেই এটা সীমিত থাকবে না। প্রতিনিয়তই নিত্যনতুন ও অধিকতর উন্নত প্রযুক্তি আসবে। পুরনো পণ্যসেবাগুলোর জায়গায় হালনাগাদ পণ্যসেবা দ্রুত চালু হবে। এরই ধারাবাহিকতায় স্মার্টফোনের সক্ষমতা, ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট, ক্লাউড কম্পিউটিং, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, রিয়েল-টাইম স্পিচ রিকগনিশন, ন্যানো কম্পিউটার, ওয়্যারেবল ডিভাইস ও নিয়ার ফিল্ড কমিউনিকেশন, সাইবার সিকিউরিটি, স্মার্ট সিটিজ, ইন্টারনেট সেবা আরো উন্নত হবে।

প্রযুক্তির এই বিপ্লবের মধ্যে গ্রাহকের সেবা না পাওয়ার হতাশাও আছে। আছে প্রতারণাও। এখন ব্রডব্যান্ডেও মিলছে না ইন্টারনেটের কাঙ্ক্ষিত গতি। কখনো কখনো সংযোগই থাকছে না। অথচ মাস শেষে বিল পরিশোধের জন্য সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের তাগাদা তো আছেই। কেন ব্রডব্যান্ডে কাঙ্ক্ষিত গতি মিলছে না? এমন প্রশ্নের উত্তরে সেবাদাতারা বলছেন, খোদ রাজধানীর পাড়া মহল্লায় মাস্তানদের কাছে তারা জিম্মি। তারা কম ব্যান্ডউইথ কিনে বেশি মানুষকে সেবা দিচ্ছেন। ফলে গ্রাহকরা কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অন্যদিকে কম তরঙ্গ দিয়ে বেশি গ্রাহককে সেবা দিতে গিয়ে সেবার মান একেবারে তলানিতে পৌঁছেছে মোবাইল ফোনগুলোর ইন্টারনেটের মান। কোয়ালিটি অব সার্ভিস বলতে যা বোঝাই তা একেবারেই নেই।

ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএসপিএবি) সভাপতি আমিনুল ইসলাম হাকিম বলেন, করোনার মধ্যে হঠাৎ করেই ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ঠিকভাবে সেবা দেওয়া যাচ্ছে না। দ্রুততম সময়ের মধ্যে সার্কিটও আপডেট করা যায়নি। এছাড়া আগের সময়ে যেখানে বাসাবাড়িতে সারাদিনে সেভাবে ইন্টারনেটের চাহিদা থাকত না। রাত ৯টা থেকে ১২টা পর্যন্ত ইন্টারনেট ব্যবহার হতো। এখন সেখানে বাসাবাড়িতেই সকাল থেকে ইন্টারনেটের পুরো ব্যবহার হচ্ছে। সে কারণে সেবাদাতারা হিমশিম খাচ্ছেন।

সাধারণভাবে উন্নত দেশগুলোতে এক মেগাহার্টজ বেতার তরঙ্গ দিয়ে সর্বোচ্চ ৫ লাখ মোবাইল গ্রাহককে সেবা দেওয়া হয়। বাংলাদেশে সেখানে গ্রামীণফোন তার বর্তমান সক্ষমতা অনুযায়ী ২০ লাখ গ্রাহকের জন্য এক মেগাহার্টজ বেতার তরঙ্গ বরাদ্দ করেছে। রবি প্রতি ১৩ লাখ গ্রাহকের জন্য এক মেগাহার্টজ এবং বাংলালিংক এক মেগাহার্টজ বরাদ্দ রাখতে পারছে ১২ লাখ গ্রাহকের জন্য। টেলিটকের গ্রাহক সংখ্যার অনুপাতে বেতার তরঙ্গের পরিমাণ অনেক বেশি। কিন্তু ঢাকার বাইরে অনেক জায়গায় তাদের নেটওয়ার্কই নেই।

টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী বলেন, দেশের প্রতিটি মানুষের দোরগোড়ায় দ্রুতগতির ইন্টারনেট পৌঁছে দিতে সরকার বদ্ধপরিকর। ইতিমধ্যে দেশের প্রায় ৪ হাজার ইউনিয়নে দ্রুতগতির ইন্টারনেট পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। ২০২১ সালের মধ্যে এমন কোনো ইউনিয়ন থাকবে না যেখানে দ্রুতগতির ইন্টারনেট সুবিধা থাকবে না। ব্যান্ডউইডথের সর্বনিম্ন মূল্য ১৮০ টাকা নির্ধারণ, ১৫০ টাকায় বিটিসিএল ল্যান্ড ফোনে যতখুশি তত কথা বলা, লাইনরেন্ট মওকুফ এবং ৫২ পয়সা মিনিটে অন্য অপারেটরে কথা বলার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে।

প্রযুক্তি ব্যবহারে প্রতারণাও কম নয়। আলোচিত সাহেদ-সাবরিনারা করোনা পরীক্ষার নামে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। অনলাইনে ভুঁইফোড় আইডি খুলে শত শত মানুষের কাছ থেকে পণ্যের অর্ডার নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার মতো প্রতারণাও হয়েছে। আবার অনলাইনে এক ধরনের পণ্যের অর্ডার নিয়ে ভিন্ন পণ্য পাঠানোর মতো প্রতারণাও হয়েছে। ফেসবুক কেন্দ্রিক প্রতারণাও ঘটছে অহরহ। অবশ্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অনলাইনে প্রতারণার তদন্তে আগের চেয়ে অনেক বেশি সক্ষমতা অর্জন করেছে। অনেক প্রতারক গ্রেফতারও হয়েছে।
সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক 

No comments

Thank you, best of luck

Theme images by sbayram. Powered by Blogger.