ads

পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ব্যাকরণ: একটি পর্যালোচনা

সূচনা পর্ব: 
পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ব্যাকরণ বলতে বর্তমান নিবন্ধে আমরা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত ব্যাকরণগুলি বোঝাচ্ছি। মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য এগুলি রচিত। উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রণীত, বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রকাশিত, পাঠ্যপুস্তক বোর্ড অনুমোদিত কয়েকটি ব্যাকরণ বাজারে পাওয়া যায়। এই অনুমোদিত ব্যাকরণগুলি নিয়ে আমরা আলোচনা করছি না, আমরা আলোচনা করছি বোর্ড প্রকাশিত ব্যাকরণগুলি নিয়ে।
এখানে উল্লেখ করা দরকার, মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যাকরণের সঙ্গে নির্মিতির নানা প্রসঙ্গ জুড়ে চারটি বই প্রকাশ করেছে বোর্ড। এগুলির মধ্যে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির বই তিনটির নাম অভিন্ন— ‘বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি’ আর নবম-দশম শ্রেণির বইটির নাম ‘বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ও নির্মিতি’। বইগুলির (শিক্ষাবর্ষ ২০২১) প্রথমাংশ অর্থাৎ ব্যাকরণ অংশ আমাদের বর্তমান নিবন্ধের উপজীব্য। আমরা পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ব্যাকরণ চারটির বিভিন্ন অংশের ওপর আলোকপাত করব এবং চেষ্টা করব এগুলিতে বিদ্যমান সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করে সমাধানের পথ নির্দেশ করার। আমাদের লক্ষ্য পাঠ্যপুস্তক বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে সচেতন করা এবং এই ব্যাকরণগুলি ত্রুটিমুক্ত করার উদ্যোগকে স্বাগত জানানো।
ভাষা ও ব্যাকরণ বিষয়ক ধারণা
‘‘ব্যাকরণ রচনা করতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় ‘ভাষা’ কাকে বলে আর ‘ব্যাকরণ’ কাকে বলে।’’ (শিশির ভট্টাচার্য্য, যা কিছু ব্যাকরণ নয়, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৯, পৃ. ১৫৩)। ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণ পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের প্রথম ব্যাকরণ। কিন্তু প্রথম ব্যাকরণ হলেও এতে ব্যাকরণ কী তা বলা হয়নি। ভাষা কী তা বর্ণিত হয়েছে চার ব্যাকরণেই— ব্যাকরণগুলির প্রথম পরিচ্ছেদেই। সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণের এই পরিচ্ছেদে ভাষা, বাংলা ভাষা, ভাষার আঞ্চলিক বৈচিত্র্য, প্রমিত বা মান ভাষা, সাধু ও চলিত রীতির পার্থক্য এসব প্রসঙ্গের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। কিন্তু ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণের প্রথম পরিচ্ছেদে প্রাগুক্ত প্রসঙ্গগুলির পাশাপাশি আলোচিত হয়েছে ভাষার প্রধান তিন (বর্ণভিত্তিক, অক্ষরভিত্তিক ও ভাবাত্মক) লিখন-ব্যবস্থা, প্রকাশমাধ্যম ও ভাষা, ব্যক্তিভাষা, সামাজিক ভাষা, পেশাগগত ভাষা প্রভৃতি বিষয়ও। প্রশ্ন উঠতেই পারে, ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী, ব্যাকরণের প্রথম পাঠ যারা নিচ্ছে, এতো কিছু তাদের কেন শেখাতে হবে?
বোর্ডের ব্যাকরণগুলির শুরুর দিকে, ভাষার প্রাথমিক পরিচয় সম্পর্কিত আলোচনায়, এমন কিছু তথ্য-বর্ণনা-বক্তব্য স্থান পেয়েছে যেগুলি শিক্ষার্থীদের ভাষাবোধকে আলোকিত করে না বরং বিভ্রান্ত করে। যেমন, ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণে দাবি করা হয়েছে, ‘‘সাধুরীতির জন্ম হয়েছে ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে আর চলিতভাষার সৃষ্টি হয় ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে।’’ (পৃ. ৭)। সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণে সাধু রীতির উদ্ভবকাল হিসেবে উনিশ শতককে চিহ্নিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, “উনিশ শতকে বাংলা গদ্যের যে লিখিত রূপ গড়ে ওঠে, তার নাম দেওয় হয় সাধু ভাষা।” (পৃ. ৩)। নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণেও বলা হয়েছে যে, সাধু গদ্যরীতির জন্ম হয় “উনিশ শতকের সূচনায়।” (পৃ. ৫)। প্রকৃতপক্ষে, সাধু কিংবা চলিত রীতির উদ্ভবের সুনির্দিষ্ট সাল-সময় জানা যায় না। এ প্রসঙ্গে দু’জন ভাষাবিজ্ঞানী পবিত্র সরকার ও হুমায়ূন আজাদের কথা আমরা স্মরণ করতে পারি। পবিত্র সরকার জানিয়েছেন, ‘‘বাংলা সাধুভাষা ঊনবিংশ শতাব্দীতে উদ্ভূত হয়েছে, একথা ভ্রান্ত। বস্তুতপক্ষে শিক্ষিত বাঙালি কয়েক শতাব্দী আগে থেকেই সাধুভাষায় চিঠিপত্র লিখে এসেছে।’’ (মাধ্যমিক ভাষা-সন্ধান, গ্রন্থতীর্থ, কলকাতা, ২০০৮, পৃ. ২৬)।
হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন: ​​​​‘বাঙলা মানভাষা অর্জন প্রক্রিয়ার দুটি পরিণতি হচ্ছে সাধু ও চলিত রীতি;— প্রথমটির বিকাশ ঘটতে থাকে মধ্যযুগ থেকেই, এবং উনিশশতকে লাভ করে সুস্থিত মানরূপ; দ্বিতীয়টিরও ধীর- বিকাশ লক্ষ্যে পড়ে মধ্যযুগ থেকে উনিশশতকব্যাপী; এবং বিশশতকে অর্জন করে নমনীয় সুস্থিতি।’ (বাঙলা ভাষা, প্রথম খণ্ড, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০২, পৃ. ৮১)।
ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণে আদর্শ বা প্রমিত ভাষার পরিচয় দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, “একই ভাষার উপভাষাগুলো অনেক সময় বোধগম্য হয় না। এজন্য একটি উপভাষাকে আদর্শ ধরে সবার বোধগম্য ভাষা হিসেবে তৈরি ভাষারূপই হলো প্রমিত ভাষা।” (পৃ. ৫)। প্রমিত বাংলা কোন উপভাষাকে আদর্শ ধরে তৈরি হয়েছে, ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণে তা বলা হয়নি, বলা হয়েছে সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণে। এতে জানানো হয়েছে, “ভাগীরথী নদীর তীরবর্তী এলাকা এবং কলকাতার ভদ্র ও শিক্ষিত সমাজে ব্যবহৃত মৌখিক ভাষাটিকে অল্প-বিস্তর পরিমার্জিত করে একটি সর্বজনবোধ্য আদর্শ কথ্য ভাষা গড়ে তোলা হয়। এটাই হলো বাংলার আদর্শ চলিত ভাষা।”(পৃ. ৩)। নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে বলা হয়েছে যে, প্রমিত ভাষা “এই চলিত রীতিরই নতুন নাম।” (পৃ. ৭)। কিন্তু অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণ অনুসারে প্রমিত রীতি আর চলিত রীতি অভিন্ন নয় বরং ভিন্ন দুই ভাষারীতি। ব্যাকরণটিতে প্রমিত আর চলিত রীতির পৃথক সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, “বিভিন্ন ভাষারীতি কালক্রমে পরিমার্জিত হয়ে” প্রমিত ভাষার রূপ লাভ করেছে আর চলিত ভাষা গড়ে উঠেছে “ভাগীরথী নদীর তীরবর্তী স্থানসমূহের মৌখিক ভাষারীতি মানুষের মুখে মুখে” রূপান্তরিত হয়ে। শুধু সংজ্ঞা নয়, সংজ্ঞার সাথে প্রমিত আর চলিত ভাষারীতির উদাহরণও দেওয়া হয়েছে—
প্রমিত ভাষারীতির উদাহরণ: একজনের দুটো ছেলে ছিল।
চলিত ভাষারীতির উদাহরণ: একজন লোকের দুটি ছেলে ছিল। (পৃ. ৪)।
স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য রচিত ব্যাকরণগুলি মূলত প্রথাগত ধারার ব্যাকরণ। এসব ব্যাকরণে, ব্যাকরণ পাঠের আবশ্যকতা সম্বন্ধে বলা হয়, ধারণা দেওয়া হয় ব্যাকরণের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে। এক্ষেত্রে সাধারণত দাবি করা হয় যে, ব্যাকরণ আয়ত্ত করলে ভাষা শুদ্ধভাবে লেখা ও বলা সম্ভব হবে। বোর্ডের সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণেও অনুরূপ দাবি করা হয়েছে। বলা হয়েছে, “ব্যাকরণ পাঠ করে লেখায় ও কথায় ভাষা প্রয়োগে শুদ্ধতা রক্ষা করা যায়।” (পৃ. ১১)। প্রকৃতপক্ষে, ব্যাকরণ, লিখিত ব্যাকরণ যা বিদ্যালয়ে পড়ানো হয় তা, লেখার শুদ্ধতা রক্ষায় মোটামুটি কার্যকর হলেও বলার শুদ্ধতা রক্ষায় তেমন কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়নি। পবিত্র সরকার যথার্থই বলেছেন:
‘ব্যাকরণ বই পড়ে কেউ ভাষা বলতে শেখে না, শিখতে পারেও না। বলতে শেখা উক্তি-প্রতিবেশ বা spoken context ছাড়া সম্ভব নয়, ব্যাকরণ তাতে একটু সহায়তা করতে পারে মাত্র। অর্থাৎ ব্যাকরণ একক ও স্বাধীনভাবে, অভিজ্ঞ ও ভাষাদক্ষ শিক্ষক, যান্ত্রিক শ্রবণের সরঞ্জাম, শ্রুতিগম্য সাহিত্য ইত্যাদির সহযোগিতা ছাড়া, ভাষা বলতে শেখাতে পারে না। পারে এই দাবি যে অতিরঞ্জিত দাবি তার প্রমাণ এই যে, এ পর্যন্ত শুধু ব্যাকরণ অর্থাৎ স্কুলের ব্যাকরণ পাঠ করে কেউ মান্য ভাষা বলতে সমর্থ হয়েছেন তার সাক্ষ্য পাওয়া যায় না।’ (‘স্কুল-পাঠ্য বাংলা ব্যাকরণ : ব্যাধি ও প্রতিকার’, আকাদেমি পত্রিকা, প্রথম সংখ্যা, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা, ১৩৯৫, পৃ. ৩৯-৪০)।
সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণে, ‘ব্যাকরণ পাঠের প্রয়োজনীয়তা’র আলোচনায়, “ব্যাকরণ পাঠের মাধ্যমে ছন্দ-অলংকার বিষয়ে জ্ঞান লাভ করা যায়” — এমন দাবিও করা হয়েছে। (পৃ. ১১)। এরকম কথা প্রথাগত ধারার অনেক ব্যাকরণেই আছে। তবে তা গ্রহণ-অযোগ্য। কারণ, এ ব্যাপারে কোনো সংশয় নেই যে, “ছন্দ ও অলঙ্কার ব্যাকরণের আলোচ্য বিষয় নয়।” (হুমায়ুন আজাদ, শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ ও অন্যান্য প্রবন্ধ, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০৫, পৃ. ১০০)।
ধ্বনি বিষয়ক আলোচনা: 
ধ্বনি কী, কাকে বলে ধ্বনি? বোর্ডের সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণে ধ্বনির সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এভাবে— “মানুষের বাগযন্ত্রের সাহায্যে তৈরি আওয়াজকে ধ্বনি বলে।” (পৃ. ১২)। “গলনালি, মুখবিবর, কণ্ঠ, জিভ, তালু, দাঁত, নাক প্রভৃতি প্রত্যঙ্গ দিয়ে… ধ্বনি তৈরি”র কথা নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণেও আছ। (পৃ. ১)। কিন্তু ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণে বলা হয়েছে, “ভাষার ধ্বনি শুধু বাগযন্ত্রের সাহায্যে উৎপাদিত হলে চলবে না, তাকে অবশ্যই অর্থপূর্ণ হতে হবে।” (পৃ. ৩)। এ বিষয়ে অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণের বক্তব্য হলো— “কোনো ভাষার উচ্চারিত শব্দকে বিশ্লেষণ করলে যে উপাদানসমূহ পাওয়া যায় সেগুলোকে পৃথকভাবে ধ্বনি বলে। ধ্বনির সঙ্গে সাধারণত অর্থের সংশ্লিষ্টতা থাকে না। ধ্বনি তৈরি হয় বাগযন্ত্রের সাহায্যে।” (পৃ. ৯)। অর্থাৎ পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ব্যাকরণগুলি থেকে ধ্বনি সম্পর্কে তিন রকমের ধারণা মেলে।
স্বর আর ব্যঞ্জনধ্বনি সম্পর্কেও অভিন্ন ধারণা পাওয়া যায় না বোর্ডের ব্যাকরণগুলি থেকে। ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণে স্বরধ্বনির যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে তা এরকম— “যে-বাগধ্বনি উচ্চারণের সময় ফুসফুস-আগত বাতাস মুখের মধ্যে কোনোভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয় না সেগুলোই হলো স্বরধ্বনি।” (পৃ. ১৩)। এর সঙ্গে মেলে নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে দেওয়া সংজ্ঞা— “যেসব ধ্বনি উচ্চারণের সময়ে বায়ু মুখগহ্বরের কোথাও বাধা পায় না, সেগুলোকে স্বরধ্বনি বলে।” (পৃ. ১২)। কিন্তু সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণে বলা হয়েছে, “যেসব ধ্বনি অন্য ধ্বনির সাহায্য ছাড়া নিজে নিজে পূর্ণ ও স্পষ্টরূপে উচ্চারিত হয়, তাকে স্বরধ্বনি বলে।” (পৃ. ১৩)। আর অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণে আছে, “যে ধ্বনি উচ্চারণের সময় মুখের ভেতরে কোথাও বাধা পায় না এবং যা অন্য ধ্বনির সাহায্য ছাড়া নিজেই সম্পূর্ণরূপে উচ্চারিত হয় তাকে স্বরধ্বনি বলে।” (পৃ. ৯)। ষষ্ঠ আর নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে প্রদত্ত সংজ্ঞা আধুনিক ধ্বনিবিজ্ঞানসম্মত আর সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণের সংজ্ঞা প্রাচীন সংস্কৃত ব্যাকরণ থেকে গৃহীত। অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণের সংজ্ঞায় প্রাচীন আর আধুনিক ধারণাকে এক জায়গায় আনার চেষ্টা করা হয়েছে।
ব্যঞ্জনধ্বনির সংজ্ঞা প্রদানের ক্ষেত্রেও একই রকম কাজ করা হয়েছে বোর্ডের ব্যাকরণগুলিতে। ষষ্ঠ আর নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে ব্যঞ্জনধ্বনির সংজ্ঞায় আধুনিক ধ্বনিবিজ্ঞান এবং সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণের সংজ্ঞায় প্রাচীন সংস্কৃত ব্যাকরণের ধারণা ব্যবহার করা হয়েছে। অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণের সংজ্ঞায় যথারীতি এক জায়গায় আনার চেষ্টা করা হয়েছে প্রাচীন আর আধুনিক ধারণাকে। বলা হয়েছে, “যে ধ্বনি উচ্চারণের সময় মুখের ভেতরে কোথাও না কোথাও বাধা পায় এবং যা স্বরধ্বনির সাহায্য ছাড়া স্পষ্টরূপে উচ্চারিত হতে পারে না তাকে ব্যঞ্জনধ্বনি বলে।” (পৃ. ৯)। এভাবে প্রাচীন আর আধুনিক ধারণাকে সব সময় মেলানো যায় না। ব্যঞ্জনধ্বনির সংজ্ঞার কথাই ধরা যাক। স্বরধ্বনির সাহায্য ছাড়া ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারিত হতে পারে না, এরকম কথা কয়েকটি ব্যঞ্জন সম্বন্ধে খাটলেও সব ব্যঞ্জন সম্বন্ধে খাটে না। “মান্য চলিত বাংলার (Standard Colloquial Bengali) র্ , ল্ , শ্ , ঙ্ , ম্ , ন্ ইত্যাদি ব্যঞ্জন স্বরধ্বনির সাহায্য ছাড়াই উচ্চারিত হতে পারে।” (পবিত্র সরকার, পূর্বোক্ত প্রবন্ধ, পৃ. ৫৩)।
ধ্বনির সংজ্ঞা সম্পর্কে যেমন তেমনি বাংলা মূল ধ্বনির সংখ্যা সম্বন্ধেও বোর্ডের ব্যাকরণের লেখক-সম্পাদকগণ একমত হতে পারেননি। নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে প্রদত্ত বিবরণ অনুসারে বাংলা ভাষার মূলত সাঁইত্রিশটি ধ্বনি আছে। এগুলির মধ্যে মূল স্বরধ্বনি সাতটি আর মূল ব্যঞ্জনধ্বনি ত্রিশটি। (পৃ. ১২)। ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণে এবিষয়ে ভিন্ন রকম তথ্য মেলে। এই ব্যাকরণে ধ্বনির যে হিসাব দেওয়া হয়েছে তাতে ব্যঞ্জনধ্বনি বাংলায় ত্রিশ নয়, বত্রিশটি। (পৃ. ২৪-২৫)। মতের এই ভিন্নতা অন্তস্থ য় আর অন্তস্থ ব-কে নিয়ে। নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে যে-ত্রিশটি ব্যঞ্জনকে মূল ধ্বনি বলা হয়েছে, অন্তস্থ য় আর অন্তস্থ ব-ধ্বনি সেগুলির মধ্যে নেই। ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণে ঐ ত্রিশটি ব্যঞ্জনের সাথে অন্তস্থ য় আর অন্তস্থ ব-কে যুক্ত করে বত্রিশটি ব্যঞ্জনধ্বনির তালিকা তৈরি করা হয়েছে।
বোর্ডের চার ব্যাকরণের তিনটিতে — ষষ্ঠ, সপ্তম আর নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে — বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত ধ্বনিসমূহের শ্রেণিকরণ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণে বিধৃত ধ্বনির শ্রেণিকরণ বিষয়ক আলোচনা অপর দুই ব্যাকরণের তুলনায় গভীর ও ব্যাপক। ব্যাকরণটিতে স্বরধ্বনির শ্রেণিকরণের কাজে জিভের উচ্চতা, জিভের অবস্থান, ঠোঁটের আকৃতি, কোমল তালুর অবস্থা এসব মানদণ্ড ব্যবহার করা হয়েছে। ধ্বনিবিজ্ঞানে উচ্চারণ দৈর্ঘ্য অনুসারেও স্বরধ্বনি বিচারের রীতি আছে। কিন্তু স্বরের দীর্ঘতা-হ্রস্বতা বাংলা ভাষায় শব্দের অর্থের তারতম্য ঘটায় না। তাছাড়া, বাংলায় উচ্চারণের দিক থেকেও সুনির্দিষ্টভাবে কোনো একক স্বরের হ্রস্ব-দীর্ঘ ভেদ নেই। বানানে যা হ্রস্ব তাও বাংলায় কখনো-কখনো দীর্ঘ উচ্চারিত হয়। তাই উচ্চারণ দৈর্ঘ্য বাংলা স্বরধ্বনির শ্রেণিকরণের মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে না। ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণে এই মানদণ্ডের কথা উল্লেখের পর “লিখিত ভাষায় যা-ই থাকুক, আমাদের সব স্বরই হ্রস্ব” (পৃ. ১৫) বলে আলোচনা শেষ করা হয়েছে। কিন্তু সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণে “উচ্চারণের সময়ের তারতম্য” অনুসারে স্বরধ্বনিগুলিকে হ্রস্বস্বর ও দীর্ঘস্বর এই দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে — অ, ই, উ, ঋ হলো হ্রস্বস্বর আর আ, ঈ, ঊ, এ, ঐ, ও, ঔ হলো দীর্ঘস্বর। (পৃ. ১৩)। স্বরধ্বনির এরকম শ্রেণিকরণ প্রথাগত সংস্কৃত ব্যাকরণে পাওয়া যায়। সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণের লেখক-সম্পাদকমণ্ডলী তারই অনুসরণ করেছেন।
স্বরধ্বনির মতো ব্যঞ্জনধ্বনির শ্রেণিকরণের ক্ষেত্রেও ষষ্ঠ আর সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণে অভিন্ন তত্ত্ব-কৌশল অনুসরণ করা হয়নি। নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণের ব্যঞ্জনধ্বনির শ্রেণিকরণ সম্বন্ধেও একথা বলা চলে। তত্ত্ব-কৌশল অভিন্ন না হওয়া শ্রেণিকরণও হয়েছে বিভিন্ন রকম। ব্যাপারটা সহজে-সংক্ষেপে বোঝানোর জন্য আমরা বোর্ডের ব্যাকরণ তিনটিতে উচ্চারণস্থান অনুযায়ী ব্যঞ্জনধ্বনির যে-শ্রেণিকরণ করা হয়েছে তার কথা বলতে পারি। উচ্চারণস্থান বিবেচনায় বাংলা ব্যঞ্জনধ্বনিসমূহকে ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণে দ্বি-ওষ্ঠ্য, দন্ত্য, দন্তমূলীয়, প্রতিবেষ্টিত, তালব্য-দন্তমূলীয়, তালব্য, জিহ্বামূলীয় এবং কণ্ঠনালীয় ব্যঞ্জন — এই আট ভাগে (পৃ. ১৭-২০), সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণে ওষ্ঠ্য, দন্ত্য, মূর্ধন্য, তালব্য এবং কণ্ঠ্য বা জিহ্বামূলীয় ব্যঞ্জন — এই পাঁচ ভাগে (পৃ. ১৪-১৫), আর নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে ওষ্ঠ্য, দন্ত্য, দন্তমূলীয়, মূর্ধন্য, তালব্য, কণ্ঠ্য এবং কণ্ঠনালীয় ব্যঞ্জন — এই সাত ভাগে (পৃ. ১৮-১৯) ভাগ করা হয়েছে।
সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণ অনুসারে ট্ ঠ্ ড্ ঢ্ ণ্ র্ ড়্ ঢ়্ ষ্ — এই নয়টি ব্যঞ্জনধ্বনি মূর্ধা থেকে উচ্চারিত হয়। নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণ অনুসারে নয়টি নয় বরং ছয়টি বাংলা ব্যঞ্জন উচ্চারিত হয় মূর্ধা থেকে । এগুলি হলো — ট্ ঠ্ ড্ ঢ্ ড়্ ঢ়্ । ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণে প্রাগুক্ত ধ্বনি ছয়টির চারটি অর্থাৎ ট্ ঠ্ ড্ ঢ্ –কে তালব্য-দন্তমূলীয় আর দুটি অর্থাৎ ড়্ ঢ়্ –কে প্রতিবেষ্টিত ব্যঞ্জন বলা হয়েছে । আবার, সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণ অনুসারে ক্ খ্ গ্ ঘ্ এবং ঙ্-এর মতো হ্ ধ্বনিরও উচ্চারণস্থান কণ্ঠ্যনালির উপরিভাগ বা জিহ্বামূল। কিন্তু ষষ্ঠ আর নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণ অনুসারে ক্ খ্ গ্ ঘ্ এবং ঙ্-এর উচ্চারণস্থান জিহ্বামূল হলেও হ্ ধ্বনির উচ্চারণস্থান জিহ্বামূল নয়, হ্-এর উচ্চারণস্থান কণ্ঠনালি।
পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের প্রাগুক্ত ব্যাকরণগুলিতে — ষষ্ঠ, সপ্তম আর নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে — ধ্বনির শ্রেণিকরণের বিবরণে শ্রেণিগুলির সংজ্ঞাও পাওয় যায়। তবে সব ক্ষেত্রে অভিন্ন সংজ্ঞা মেলে না। কোনো কোনো শ্রেণির সংজ্ঞা তিন ব্যাকরণে তিন রকম। যেমন ঘোষ আর অঘোষ ব্যঞ্জনধ্বনির সংজ্ঞা। ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণে বলা হয়েছে, “কিছু ব্যঞ্জন উচ্চারণে স্বরতন্ত্র কম্পিত হয়। এগুলো হলো ঘোষ ব্যঞ্জন আর যেগুলোর উচ্চারণে স্বরতন্ত্র কম্পিত হয় না, সেগুলো হলো অঘোষ ব্যঞ্জন।” (পৃ. ২৩)। নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে আছে, “যেসব ধ্বনি উচ্চারণের সময়ে ধ্বনিদ্বারের কম্পন অপেক্ষাকৃত বেশি, সেসব ধ্বনিকে বলা হয় ঘোষ ধ্বনি।” আর, “যেসব ধ্বনি উচ্চারণের সময়ে ধ্বনিদ্বারের কম্পন অপেক্ষাকৃত কম, সেসব ধ্বনিকে বলা হয় অঘোষ ধ্বনি।” (পৃ. ২১)।
সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণে বলা হয়েছে, যেসব ধ্বনির উচ্চারণকালে “আঘাতজনিত ঘোষ বা শব্দ সৃষ্টি হয় না” সেগুলি অঘোষ আর যেসব ধ্বনির উচ্চারণকালে “আঘাতজনিত ঘোষ বা শব্দ সৃষ্টি হয়” সেগুলি ঘোষধ্বনি। (পৃ. ১৫-১৬)। ষষ্ঠ আর নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণের সংজ্ঞা অভিন্ন না হলেও, স্বরতন্ত্র বা ধ্বনিদ্বারের কথা আছে দুটিতেই। সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণে সেরকম কিছু নেই, আছে আঘাতজনিত শব্দ হওয়া না হওয়ার প্রসঙ্গ। কিন্তু কিসের আঘাত, কোথায় আঘাত তার উল্লেখ নেই।
অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ(‘ধ্বনি ও বর্ণ’ শীর্ষক)-এর দুটি অংশের শিরোনাম এরকম — ‘বর্ণের উচ্চারণ-স্থান’ ও ‘বর্ণের উচ্চারণ প্রকৃতি’। নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণের একটি পুরো পরিচ্ছেদেরই শিরোনাম ‘বর্ণের উচ্চারণ’ (৮ সংখ্যক পরিচ্ছেদ)।প্রশ্ন হচ্ছে, মানুষ বর্ণ উচ্চারণ করে না ধ্বনি উচ্চারণ করে? নিঃসন্দেহে ধ্বনিই উচ্চারণ করে মানুষ। অষ্টম আর নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণের উল্লিখিত স্থানগুলিতে ‘বর্ণ’ কথাটি আসলে ‘ধ্বনি’ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রথাগত ধারার অনেক বাংলা ব্যাকরণে এমনটা লক্ষ্য করা যায়। এসব ব্যাকরণের প্রণেতা-রচয়িতাগণ প্রায়ই ‘বর্ণ’ শব্দ দিয়ে ‘ধ্বনি’ বোঝান। ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়েই কাজটা করেন তারা। পবিত্র সরকারের ভাষায়— ‘‘এই ভ্রান্তি ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ইয়োরোপে চলেছে, সেখানকার তুলনামূলক ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানীরা letter বলতেই ধ্বনি বুঝিয়েছেন। পরে আধুনিক ধ্বনিবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠা ও বিকাশে এই বোধ ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, letter হল ধ্বনিটির লিখিত প্রতীক-রূপ মাত্র, আসল ধ্বনিটি উচ্চারিত বায়ুকম্পনসমষ্টি।” (পবিত্র সরকারের পূর্বোক্ত প্রবন্ধ, পৃ. ৫১)।
ইয়োরোপে letter শব্দটি ধ্বনি অর্থে এখন আর ব্যবহৃত হয় না। কিন্তু আমাদের দেশে প্রথাগত ধারার অনেক ব্যাকরণে, এমন কি পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ব্যাকরণেও, ধ্বনি বোঝাতে বর্ণ শব্দটি ব্যবহৃত হয়।
পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ব্যাকরণ : একটি পর্যালোচনা (দ্বিতীয় পর্ব)
চার. রূপ ও শব্দ বিষয়ক আলোচনা
পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণের তৃতীয় পরিচ্ছেদ রূপতত্ত্ব। কিন্তু ‘রূপ’ কী তা এর কোথাও বলা হয়নি। পরিচ্ছেদটিতে আলোচিত হয়েছে ‘শব্দ’, ‘শব্দের গঠন’, ‘শব্দের শ্রেণিবিভাগ বা সংবর্গ’, ‘শব্দের শ্রেণি বা সংবর্গ পরিবর্তন’, ‘লিঙ্গ’, ‘বচন’, ‘পক্ষ বা পুরুষ’ এসব প্রসঙ্গ। এগুলির মধ্যে প্রাধান্য পেয়েছে শব্দের শ্রেণিবিভাগের আলোচনা। বাংলা শব্দরাজিকে এতে বিশেষ্য, সর্বনাম, অব্যয়, বিশেষণ ও ক্রিয়া এই পাঁচ শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণে এই শ্রেণিগুলিকে, প্রথাগত ধারার আর সব বাংলা ব্যাকরণের মতোই, শব্দ-শ্রেণি নয় বরং পদ-শ্রেণি বলা হয়েছে। নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণেও এগুলি পদ-শ্রেণি হিসাবে বর্ণিত। তবে পদ-শ্রেণির সংখ্যা সেখানে পাঁচটি নয়, আটটি — বিশেষ্য, বিশেষণ, সর্বনাম, ক্রিয়া, ক্রিয়াবিশেষণ, অনুসর্গ, যোজক ও আবেগ। সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণে শব্দ-শ্রেণির বা পদ-শ্রেণির পরিচিতিমূলক আলোচনা না থাকলেও শব্দগঠন ও পদগঠনের আলোচনা আছে। অষ্টম আর নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণেও শব্দগঠন ও পদগঠন-প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে। তফাৎ এখানে যে, শেষোক্ত অর্থাৎ নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে পদগঠন সম্পর্কিত আলোচনা আছে শব্দগঠন বিষয়ক আলোচনার পরে। কিন্তু সপ্তম আর অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণে পদগঠন বিষয়ক আলোচনার পরে ‘শব্দগঠন’-পরিচ্ছেদ যুক্ত হয়েছে।
ইতিপূর্বে, ‘ধ্বনি বিষয়ক আলোচনায়’, আমরা উল্লেখ করেছি যে, ধ্বনি সম্পর্কে বোর্ডের ব্যাকরণগুলি থেকে অভিন্ন ধারণা পওয়া যায় না। শব্দের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটেছে। ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণে আছে, “দুই বা তার চেয়ে বেশি ধ্বনি মিলে শব্দ তৈরি হয়। যেমন — ম্ এবং আ মিলে হয় মা; আ +ম্ +আ র্+ = আমার। একটি ধ্বনি দিয়েও একটি শব্দ তৈরি হতে পারে। যেমন— ই, উ, আ।” (পৃ. ৪০)। সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণে বলা হয়েছে, “এক বা একাধিক ধ্বনির সমন্বয়ে তৈরি অর্থবোধক ও উচ্চারণযোগ্য একককে বলা হয় শব্দ।” (পৃ. ৪৩)। অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণে শব্দের দুটি সংজ্ঞা আছে। একটি এরকম — “এক বা একাধিক ধ্বনির সম্মিলনে যদি কোনো নির্দিষ্ট অর্থ প্রকাশ পায় তবে তাকে শব্দ বলে।” (পৃ. ২৫)। অন্য সংজ্ঞাটি হলো, “এক বা একাধিক অর্থপূর্ণ ধ্বনির সমষ্টিকে শব্দ বলে।” (পৃ. ৫২)। ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণের সংজ্ঞা অনুসারে শব্দ কেবল ধ্বনি দিয়ে তৈরি। শব্দের সঙ্গে অর্থের কোনো যোগ আছে কি না তা ঐ সংজ্ঞা থেকে বোঝার উপায় নেই। সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণের সংজ্ঞানুযায়ী শব্দ ধ্বনির সমন্বয়ে তৈরি এমন একক যা একইসঙ্গে অর্থবোধক ও উচ্চারণযোগ্য। উচ্চারণযোগ্য নয় এমন ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টি আছে কি? অষ্টম শ্রেণির শেষোক্ত সংজ্ঞানুসারে শব্দ অর্থপূর্ণ ধ্বনির সমষ্টি। ধ্বনি কি অর্থপূর্ণ হয়? হুমায়ুন আজাদ জানিয়েছেন, “এটা একটি গৃহীত সত্য যে, ধ্বনির কোনো অর্থ নেই।” (শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ ও অন্যান্য প্রবন্ধ, পৃ. ১০২)। সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণের প্রাগুক্ত সংজ্ঞা আর অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণের শেষোক্ত সংজ্ঞাটি আছে ঐ দুই ব্যাকরণের ‘শব্দগঠন’ শীর্ষক (যথাক্রমে ষষ্ঠ আর পঞ্চম) পরিচ্ছেদে। সংজ্ঞা দেওয়ার পর পরিচ্ছেদ দুটিতে মৌলিক ও সাধিত শব্দের গঠন সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণে বলা হয়েছে, ‘‘মৌলিক শব্দ গঠনের প্রথম উপায় বর্ণের সঙ্গে বর্ণ যোগ।” এছাড়াও, “সরল বর্ণের সঙ্গে ‘কার’ বা ‘ফলা’ যোগ করে শব্দ গঠন করা যায়।” (পৃ. ৪৩)। অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণেও আছে, “ব্যঞ্জনবর্ণের সাথে ‘কার’ যোগ করে” এবং “ব্যঞ্জনবর্ণের সাথে ‘ফলা’ যোগ করে” শব্দগঠন করা যায়। “এগুলো হচ্ছে শব্দগঠনের প্রাথমিক উপায়।” (পৃ. ৫২)। ব্যাকরণ দুটিতে ধ্বনি দিয়ে শব্দ তৈরি হয় একথা যে অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে তার ঠিক পরের অনুচ্ছেদেই বর্ণের সঙ্গে বর্ণ আর বর্ণের সঙ্গে কার বা ফলা যোগকে শব্দগঠনের উপায় বলা হয়েছে। ব্যাপারটা বিস্ময়কর।
বিস্ময় জাগানিয়া ব্যাপার আরও আছে বোর্ডের ব্যাকরণগুলোর শব্দগঠন সম্পর্কিত আলোচনায়। যেমন, ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণের ‘রূপতত্ত্ব’ পরিচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, প্রত্যয়, উপসর্গ আর সমাসের মতো বিভক্তিও শব্দগঠনের ‘ভাষিক উপাদান’ ।(পৃ. ৪০)। কিন্তু ‘বাক্যতত্ত্ব’ পরিচ্ছেদে জানানো হয়েছে, “শব্দের সঙ্গে বিভক্তি যোগ করলেই পদ তৈরি হয়।”(পৃ. ৪৮)। একই রকম কাণ্ড লক্ষ্য করা যায় অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণেও। এই ব্যাকরণে, শব্দ আর পদের পার্থক্যের আলোচনায় আছে, “শব্দে বিভক্তি যুক্ত হলেই তাকে পদ বলা হয়।” (পৃ. ২৫-২৬)। আর, শব্দের গঠন সম্পর্কিত আলোচনায়, ‘শব্দের শেষে বিভক্তি যোগ’-কে ‘শব্দগঠনের নানা উপায়ে’র একটি বলা হয়েছে।(পৃ. ৫৩)। অষ্টম শ্রেণির এই ব্যাকরণ অনুসারে ‘বিভিক্তি যোগ’ ছাড়া আরও যেসব ‘উপায়ে বা প্রক্রিয়ায়’ শব্দ গঠিত হতে পারে সেগুলি হলো — ‘মৌলিক শব্দ যোগে’, ‘শব্দের আগে উপসর্গ যোগ করে’, ‘শব্দের পরে প্রত্যয় যোগ করে’, ‘সন্ধির সাহায্যে’, ‘সমাসের সাহায্যে’ এবং ‘শব্দ দ্বৈতের মাধ্যমে’।(পৃ. ৫২-৫৪)। কিন্তু সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণ অনুসারে শব্দগঠনের এতো প্রক্রিয়া পৃথিবীর কোনো ভাষাতেই নেই। ব্যাকরণটিতে এ বিষয়ে বলা হয়েছে, “যে কোনো ভাষার শব্দগঠন প্রক্রিয়া দুইটি।” এদুটি হলো — “প্রত্যয়ের সাহায্যে শব্দগঠন” এবং “সমাসের সাহায্যে শব্দগঠন”। উপসর্গ সম্পর্কে বলা হয়েছে, “উপসর্গ শব্দগঠনের প্রক্রিয়া নয়, উপাদান মাত্র। কারণ, উপসর্গযুক্ত সকল শব্দই সমাস-সাধিত শব্দ; হয় অব্যয়ীভাব সমাস নয় প্রাদি সমাস।” একইভাবে, সন্ধিও “শব্দগঠনের প্রক্রিয়া নয়। কেননা সন্ধিবদ্ধ শব্দ মাত্রই হয় প্রত্যয়-সাধিত শব্দ, নয় সমাস-সাধিত শব্দ।” (পৃ. ৪৪)। নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণ অনুসারে বাংলা শব্দগঠনের প্রক্রিয়া দুটি মাত্র নয়, আরও বেশি। এই ব্যাকরণের ‘শব্দ ও পদের গঠন’ শীর্ষক পরিচ্ছেদে বলা হয়েছে — উপসর্গ ও প্রত্যয় দিয়ে তৈরি শব্দকে সাধিত শব্দ বলা হয়। উপসর্গ ও প্রত্যয় ছাড়া শব্দ গঠনের আরো কিছু প্রক্রিয়া রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান প্রক্রিয়া হলো সমাস, যার মাধ্যমে একাধিক শব্দ এক শব্দে পরিণত হয়।… এছাড়া কোনো শব্দের দ্বৈত ব্যবহারে নতুন শব্দ গঠিত হলে তাকে বলে শব্দদ্বিত্ব …। (পৃ. ২৬)।
দেখা যাচ্ছে, শব্দ গঠনের উপাদান আর উপায়-প্রক্রিয়া সম্বন্ধে বোর্ডের ব্যাকরণগুলির লেখক-সম্পাদকেরা একমত নন। আর তা নন বলেই এক ব্যাকরণে যেগুলি শব্দগঠনের ‘উপাদান’, অন্য ব্যাকরণে সেগুলি শব্দগঠনের ‘উপায় বা্ প্রক্রিয়া’, আরেক ব্যাকরণে সেগুলির কোনোটি শব্দগঠনের ‘উপদান’ আর কোনোটি শব্দগঠনের ‘প্রক্রিয়া’।
প্রথাগত ধারার বাংলা ব্যাকরণে সন্ধির আলোচনা থাকেই। পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ব্যাকরণগুলিতেও তা আছে। ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণে সন্ধির আলোচনা ধ্বনিতত্ত্বের অংশ আর নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে তা অংশ হয়েছে রূপতত্ত্বের। শেষোক্ত ব্যাকরণে সন্ধির সংজ্ঞা দিয়ে বলা হয়েছে — “পৃথিবীর বহু ভাষায় পাশাপাশি শব্দের একাধিক ধ্বনি নিয়মিতভাবে সন্ধিবদ্ধ হলেও বাংলা ভাষায় তা বিরল।” (পৃ. ৪১)। অধ্যাপক শিশির ভট্টাচার্য্য জানিয়েছেন, বহু নয়, সব মানব ভাষাতেই “সন্ধি আছে, কিন্তু ভারত আর বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো দেশেই সম্ভবত আধুনিক ভাষার ব্যাকরণ-শিক্ষার্থীদের ওপর ‘সন্ধি’ নামক একটি অধ্যায় অকারণে চাপিয়ে দেওয়া হয়নি।” এই চাপিয়ে দেওয়ার কাজটা কোন যুক্তিতে করা হয়েছে? অধ্যাপক ভট্টাচার্য্যের পর্যবেক্ষণ অনুসারে, যুক্তি এখানে দুটি — “এক সংস্কৃত ব্যাকরণের ঐতিহ্য আর বহুচর্চিত অভ্যাসের অজুহাত।” (বাংলা ব্যাকরণের রূপরেখা, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১৬, পৃ. ২৩৬-২৩৭)।দুটি যুক্তিই দুর্বল। হতাশার বিষয় হলো, এরকম দুর্বল যুক্তির ওপর ভর করে, বাংলা ভাষার এক বিরল ব্যাপার সন্ধি বোর্ডের চার ব্যাকরণেই ঢুকে পড়েছে এবং বর্ণিত-ব্যাখ্যাত হয়েছে। প্রসঙ্গত সমাসের কথা বলা যায়। বাংলা ভাষায় সন্ধি বিরল কিন্তু সমাস বিরল নয়। অথচ সমাসের বিবরণ-বিশ্লেষণ বোর্ডের চার ব্যাকরণের একটিতে, শুধু নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে, আছে।
পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের দুটি ব্যাকরণে, সপ্তম ও নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে, কারক-বিভক্তির বিবরণ মেলে। এই বিবরণ সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণে আছে একসঙ্গে, একটি অভিন্ন পরিচ্ছেদে, রূপতত্ত্ব অংশে। নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে কারক-বিভক্তির আলোচনা একত্রে করা হয়নি— কারকের আলোচনা করা হয়েছে বাক্যতত্ত্বে আর বিভক্তির আলোচনা করা হয়েছে রপতত্ত্ব অংশে। সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণে, ‘বিভক্তির প্রয়োজনীয়তা’ শীর্ষক অনুচ্ছেদে দাবি করা হয়েছে, বাংলা বাক্য কারক-প্রধান নয়, বিভক্তি-প্রধান। যুক্তি দেখানো হয়েছে —
... ক্রিয়াহীন অনেক বাক্য বাংলায় রয়েছে। ক্রিয়া নেই বলে এই বাক্যগুলোর অন্তর্গত নাম শব্দগুলোর কারকও নেই। সে জন্য বলা হয় বাংলা বাক্য কারক প্রধান নয়। কিন্তুবিভক্তি ছাড়া বাংলা বাক্য ঠিকভাবে গঠিত হতে পারে না এবং বাক্যও অর্থগ্রাহ্য হয় না। ... সে জন্য বাংলা বাক্য বিভক্তি-প্রধান। (পৃ. ২৮-২৯)।
এটা ঠিক যে, ক্রিয়াপদের উল্লেখ নেই এমন বাক্য আছে বাংলায়। এটাও কিন্তু ঠিক যে, বিভক্তির উল্লেখ নেই এমন পদও ব্যবহৃত হয় বাংলা বাক্যে। প্রশ্ন হলো, ক্রিয়াপদের উল্লেখ নেই এরকম বাংলা বাক্যের সংখ্যা কি সত্যিই অনেক? দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, বাংলা কি আসলেই বিভক্তি-প্রধান বা বিভক্তি-বহুল ভাষা? প্রশ্ন দুটির মীমাংসা হওয়া দরকার। প্রথম প্রশ্নের উত্তর খোঁজার ক্ষেত্রে নবম-দশম শ্রেণির বিগত শিক্ষাবর্ষের (২০২০) ব্যাকরণ আমাদের সাহায্য করতে পারে। এতে বলা হয়েছে —
ক্রিয়াপদ বাক্যগঠনের অপরিহার্য অঙ্গ। ক্রিয়াপদ ভিন্ন কোনো মনোভাবই সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করা যায় না। তবে কখনো কখনো বাক্যে ক্রিয়াপদ উহ্য বা অনুক্ত থাকতে পারে। (বাংলা ভাষার ব্যাকরণ, পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, শিক্ষাবর্ষ ২০২০, পৃ. ১১২)।
ক্রিয়াপদের উল্লেখহীন বাংলা বাক্য ব্যবহৃত হয় ‘কখনো কখনো’। ক্রিয়াপদ উহ্য রেখে বাংলায় বেশিক্ষণ আলাপ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এই কারণে, ‘ক্রিয়াহীন অনেক বাক্য বাংলায় রয়েছে’ — শিক্ষার্থীদের এরকম ধারণা দেওয়া অনুচিত। একইভাবে অনুচিত বাংলা বিভক্তি-প্রধান বা বিভক্তি-বহুল ভাষা এরকম ধারণা দেওয়াও। কারণ, বাংলায় ক্রিয়াপদের উল্লেখ নেই এমন বাক্যের চেয়ে বিভক্তির উল্লেখ নেই এমন পদ যুক্ত বাক্য বহুগুণে বেশি। বিভক্তির উল্লেখ নেই এমন পদের ক্ষেত্রে প্রথাগত ধারার বাংলা ব্যাকরণবিদগণ, সংস্কৃত ব্যাকরণের অনুসরণে, বিভক্তি (শূন্য বিভক্তি) অনুমান করে নেন এবং বাংলাকে সংস্কৃতের মতোই ‘বিভক্তি-প্রধান’ ভাষা বলেন। প্রকৃতপক্ষে, সংস্কৃত ভাষায় পদের বিভক্তিহীনতা “ব্যতিক্রমী ঘটনা” আর “বাংলায় বিভক্তিহীনতাই স্বাভাবিক…।” (পবিত্র সরকার, বাংলা ব্যাকরণ প্রসঙ্গ, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০০৬, পৃ. ১২৭)। আরও সহজ করে বলতে গেলে, সংস্কৃত “বিভক্তিবহুল” আর বাংলা “বিভক্তিবিরল” ভাষা। (রফিকুল ইসলাম ও পবিত্র সরকার, ‘রূপতত্ত্বের ভূমিকা’, বাংলা একাডেমী প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যকরণ, প্রথম খণ্ড, ঢাকা, ২০১২, পৃ. ১৬২)।
বচন কী? ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণ অনুসারে বচন হলো সংখ্যার ধারণা। (পৃ. ৪৩)। অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণেও আছে, “বচন অর্থ সংখ্যার ধারণা।” এতে বচনের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এভাবে, “যে শব্দ দিয়ে ব্যাকরণে কোনো কিছুর সংখ্যার ধারণা প্রকাশ করা হয়, তাকে বচন বলে।” (পৃ. ২৯)। কিন্তু নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণ অনুসারে, “একের বেশি সংখ্যা বোঝাতে যেসব লগ্নক বিশেষ্য বা সর্বনামের সঙ্গে যুক্ত হয়, সেগুলোকে বচন বলে।” (পৃ. ৭২)। এই সংজ্ঞা আছে ব্যাকরণটির ‘বচন’ পরিচ্ছেদে। ‘শব্দ ও পদের গঠন’ পরিচ্ছেদেও উদাহরণসহ বচনের অনুরূপ সংজ্ঞা পাওয়া যায় — “যেসব শব্দাংশ পদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পদের সংখ্যা বোঝায়, সেগুলোকে বচন বলে। ‘ছেলেরা’ বা ‘বইগুলো’ পদের ‘রা’ বা ‘গুলো’ হলো বচনের উদাহরণ।” (পৃ. ২৬)। নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে ‘রা’, ‘গুলো’-কে বচন বলা হলেও অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণে এগুলিকে বিভক্তি বলা হয়েছে। (পৃ. ৩০)। আর ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণে বলা হয়েছে ‘বচনের চিহ্ন’। (পৃ. ৪৩)। (চলবে)
পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ব্যাকরণ : একটি পর্যালোচনা (তৃতীয় পর্ব)
বাক্য বিষয়ক আলোচনা
ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণের বাক্যতত্ত্ব-পরিচ্ছেদে বাক্যের পরিচয় দেওয়া হয়েছে এভাবে — ‘আমরা বাক্য তৈরি করি এক বা একাধিক শব্দ একত্রে সাজিয়ে।’ (পৃ. ৪৮)। এই ব্যাকরণের অন্যত্র, প্রথম পরিচ্ছেদে, বাক্যের এরকম একটি সংজ্ঞা পাওয়া যায়— ‘যা উক্তি হিসেবে সম্পূর্ণ এবং যাতে শ্রোতা পরিপূর্ণভাবে তৃপ্ত হয় তা-ই হলো বাক্য।’(পৃ. ৩)। সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণে বলা হয়েছে, ‘যে সুবিন্যস্ত পদসমষ্টি দ্বারা কোনো বিষয়ে বক্তার মনোভাব সম্পূর্ণরূপে প্রকাশিত হয়, তাকে বাক্য বলে।’ (পৃ. ৫৮)। অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণে আছে, ‘এক বা একাধিক পদের দ্বারা যখন বক্তার মনোভাব সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ পায়, তখন তাকে বাক্য বলে।’ (পৃ. ৫৫)। নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে বলা হলেছে, ‘এক বা একাধিক শব্দ দিয়ে গঠিত পূর্ণ অর্থবোধক ভাষিক একককে বাক্য বলে। বাক্য দিয়ে বক্তার মনের ভাব সম্পূর্ণ প্রকাশিত হয়।’ (পৃ. ৮৩)।
এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হলো ষষ্ঠ, অষ্টম আর নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণ অনুসারে বাক্য এক শব্দ/পদ দিয়ে যেমন তৈরি হতে পারে, তেমনি একাধিক শব্দ/পদ দিয়েও তৈরি হতে পারে। কিন্তু সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণ অনুসারে বাক্য তৈরির জন্য পদসমষ্টি প্রয়োজন— এক নয়, একাধিক পদ তাতে থাকতে হবে। আবার, ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণে বলা হয়েছে, বাক্যকে উক্তি হিসেবে সম্পূর্ণ হতে হবে। সপ্তম, অষ্টম আর নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণ তিনটির সংজ্ঞায়ও আছে যে, বাক্য বক্তার মনোভাব সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করবে। বাক্যের এই বৈশিষ্ট্যের কথা প্রথাগত ব্যাকরণে দু-হাজার বছর ধরে বর্ণিত হয়ে আসছে। কিন্তু এই দু-হাজার বছরে, ‘প্রথাগত আনুশাসনিক ব্যাকরণবিদেরা কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে পারেন নি একটি বাক্যে ঠিক কি পরিমাণ ভাবনার প্রকাশ ঘটালে মনোভাব সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ পায়।’ (হুমায়ুন আজাদ, বাক্যতত্ত্ব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৯৪, পৃ. ১৮)। এরকম সিদ্ধান্তে পৌঁছানো আসলে সম্ভবই নয়। ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণে শ্রোতাকে ‘পরিপূর্ণভাবে তৃপ্ত’ করার শর্ত আছে। বক্তার উক্তি কেমন হলে শ্রোতা পরিপূর্ণভাবে তৃপ্ত হবে সেরকম সিদ্ধান্তে পৌঁছানোও অসম্ভব।
ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণে বলা হয়েছে যে, বাক্য গঠনের সময় পদ সাজানোর নিয়ম মানতে হবে, ‘পদগুলো পরপর সাজালেই বাক্য হবে না।’ (পৃ. ৪৮)। সপ্তম আর অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণ অনুসারে, আদর্শ বাক্য গঠিত হবে তখন, যখন তা আকাঙ্ক্ষা, আসত্তি ও যোগ্যতার শর্ত পূরণ করবে। ব্যাকরণ দুটিতে আকাঙ্ক্ষা, আসত্তি ও যোগ্যতার যে-বিবরণ আছে তা সংক্ষেপে এরকম— বাক্যের অর্থ পরিষ্কারভাবে বোঝার জন্য এক পদের পর অন্য পদ শোনার ইচ্ছা হলো আকাঙ্ক্ষা, বাক্যের অর্থসঙ্গতি রক্ষার জন্য সুশৃঙ্খল পদবিন্যাসই আসত্তি আর বাক্যস্থিত পদসমূহের অন্তর্গত ও ভাবগত মিলবন্ধনের নাম যোগ্যতা। কেবল সপ্তম আর অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণেই নয়, উল্লিখিত তিন শর্ত এবং সেগুলির অনুরূপ ব্যাখ্যা, প্রথাগত ধারার বহু বাংলা ব্যাকরণে আছে। শর্ত তিনটির উৎস সংস্কৃত ব্যাকরণ। সংস্কৃতের অন্বিতাভিধানবাদী বৈয়াকরণেরা মনে করতেন, আসত্তি, আকাঙ্ক্ষা ও যোগ্যতাসম্পন্ন শব্দের সমষ্টিই বাক্য। শর্ত তিনটির যে-ব্যাখ্যা তাঁরা দিয়েছিলেন, হুমায়ূন আজাদের ভাষায়, তা হলো — আসত্তি (নৈকট্য) বলতে বোঝায় যে, বাক্যের যে-সমস্ত শব্দের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান, সেগুলো পরস্পরের থেকে সুদূরে অবস্থান করবে না, তাদের অবস্থান হবে সন্নিকট। আকাঙ্ক্ষা বলতে বোঝায় যে, অনন্বয়ী শব্দপুঞ্জের সমাহার বাক্য নয়, বাক্যে ব্যবহৃত শব্দসমূহ সহাবস্থানযোগ্য হ’তে হবে। যোগত্য (সঙ্গতি) বোঝায় যে, বাক্যে ব্যবহৃত শব্দসমূহের অর্থে সঙ্গতি থাকতে হবে।(বাক্যতত্ত্ব, পৃ. ৪০৩)।
প্রথাগত বাংলা ব্যাকরণে আকাঙ্ক্ষা আর আসত্তির ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সপ্তম আর অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণ সম্পর্কেও এই কথা সমভাবে প্রযোজ্য।
বোর্ডের ব্যাকরণগুলির মধ্যে ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণে বাক্যের উপাদান বা অঙ্গগুলি সম্পর্কে কোনো আলোচনা নেই, আছে সপ্তম, অষ্টম আর নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে। তবে সে আলোচনা তেমন সুশৃঙ্খল নয়, যৌক্তিকতারও ঘাটতি আছে তাতে। যেমন, সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণে বলা হয়েছে, ‘সাধারণত প্রতিটি বাক্যের দুটি প্রধান অংশ থাকে : ১. উদ্দেশ্য ও ২. বিধেয়।’ (পৃ. ৫৯)। আর নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে বলা হয়েছে, ‘প্রতিটি বাক্যকে উদ্দেশ্য ও বিধেয়— এই দুই অংশে ভাগ করা যায়।’ (পৃ. ৮৩)। অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণেও প্রত্যেক বাক্যে উদ্দেশ্য-বিধেয় থাকার কথা আছে। (পৃ. ৫৭ )। লক্ষণীয় যে, সাধারণত বা সচরাচর উদ্দেশ্য ও বিধেয় অংশ নিয়ে বাক্যশরীর নির্মিত হয়, এমন কথা সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণে থাকলেও অষ্টম আর নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে তা নেই। অর্থাৎ, সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণ অনুসারে, উদ্দেশ্য ও বিধেয়-এর যে কোনো একটি ছাড়াও বাক্য গঠিত হতে পারে। কিন্তু অষ্টম আর নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণ অনুসারে তা পারে না। স্মরণ করা যেতে পারে — ষষ্ঠ, অষ্টম আর নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে বাক্যের সংজ্ঞায় একটিমাত্র পদ নিয়েও বাক্য গঠিত হওয়ার কথা আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এক পদবিশিষ্ট বাক্যে উদ্দেশ্য-বিধেয় দুটিই কী করে থাকবে?
আলোচ্য ক্ষেত্রে আরও একটি উদাহরণ দেওয়া যায়। নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে ‘বর্গ’ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। বর্গের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘বাক্যের মধ্যে একাধিক শব্দ দিয়ে গঠিত বাক্যাংশকে বর্গ বলে।’ (পৃ. ৮৬)। বর্গ আসলে এক শব্দ দিয়েও গঠিত হতে পারে। বর্গের মধ্যে একাধিক শব্দ থাকতেই হবে এমন কোনো কথা নেই।
বোর্ডের চার ব্যাকরণের তিনটিতে— সপ্তম, অষ্টম আর নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে— বাক্যের গঠনগত শ্রেণিবিভাগের বিবরণ আছে। বিবরণের শুরুতেই আছে সরল বাক্যের কথা। সপ্তম আর অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণে বলা হয়েছে, যে-বাক্য একটি উদ্দেশ্য বা কর্তা ও একটি সমাপিকা ক্রিয়া বা বিধেয় থাকে তাকে সরল বাক্য বলে। কিন্তু নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে বলা হয়েছে, ‘যে বাক্যে একটি সমাপিকা ক্রিয়া থাকে, তাকে সরল বাক্য বলে।’ (পৃ. ৯০)।
অর্থাৎ সরল বাক্যের সংজ্ঞা সম্পর্কে বোর্ডের ব্যাকরণের লেখক-সম্পাদকগণ একমত হতে পারেননি। এই বিষয়ে প্রথাগত বাংলা ব্যাকরণের পুরোধা-পণ্ডিতেরাও মতৈক্যে পৌঁছুতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁদের কেউ কেউ এবিষয়ে আগে প্রকাশ করা মত পরে পরিবর্তনও করেছেন। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সরল বাক্যের সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে— ‘কোনও বাক্যে একটি সমাপিকা ক্রিয়া থাকিলে তাহা সরল বাক্য।’ (বাঙ্গালা ব্যাকরণ, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ২০০৩, পৃ. ১৬০ )। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘ভাষা-প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণে’ (১৯৩৯) বলেছেন, “যে বাক্যে একটি মাত্র উদ্দেশ্য ও একটি মাত্র বিধেয় (সমাপিকা ক্রিয়া) থাকে, তাহাকে সরল বাক্য বলে।’ এই মত পরে তিনি পুনর্বিবেচনা করেন এবং ‘সরল ভাষা-প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ’ (১৩৬৬) গ্রন্থে বলেন, ‘যে বাক্যের বিধেয় একটি, সেই বাক্যকে বলে সরল বাক্য।’ (উদ্ধৃত, হুমায়ুন আজাদের বাক্যতত্ত্ব, পৃ. ১০০)। লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, সুনীতিকুমার ‘একটি মাত্র উদ্দেশ্য’-এর শর্ত থেকে সরে এসেছেন এবং বিধেয় অংশে সমাপিকা ক্রিয়া থাকা না থাকার বিষয়ে নীরবতা পালন করেছেন। শেষোক্ত গ্রন্থে তিনি সরল বাক্যের যেসব উদাহরণ দিয়েছেন সেগুলির একটি এরকম— ‘ঠেলাগাড়িতে ইংরাজ রমণী এবং অশ্বপৃষ্ঠে ইংরাজ পুরুষগণ বায়ু-সেবনে বাহির হইয়াছেন।’ (উদ্ধৃত, হুমায়ূন আজাদের বাক্যতত্ত্ব, পৃ. ১০১)।
এই বাক্যে বিধেয় একটি বলে সুনীতিকুমারের মতে এটি সরল বাক্য। সমাপিকা ক্রিয়া একটি থাকায়, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবং পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণের সংজ্ঞানুসারেও এটিকে সরল বাক্য বলতে বাধা নেই। কিন্তু বোর্ডের সপ্তম আর অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণের সংজ্ঞা অনুসারে, ক্রিয়া সম্পাদনকারী বা কর্তা একাধিক হওয়ায়, বাক্যটিকে সরল বাক্য বলা যাবে না। বোর্ডের প্রগুক্ত ব্যাকরণ তিনটিতে সরল বাক্যের পরই আছে জটিল বাক্যের আলোচনা। সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণে জটিল বাক্যের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এভাবে — যে বাক্যের মধ্যে একটি প্রধান বাক্য থাকে এবং একাধিক বাক্যকে প্রধান বাক্যের ওপর নির্ভরশীল দেখা যায়, তাকে জটিল বা মিশ্র বাক্য বলে। অথবা, অন্যভাবে বলা যায়, যে বাক্যে একটি প্রধান খণ্ড বাক্যের এক বা একাধিক আশ্রিত বাক্য পরস্পর সাপেক্ষভাবে ব্যবহৃত হয়, তাকে জটিল বা মিশ্র বাক্য বলে। (পৃ. ৬০)।
লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, এখানে দুটি সংজ্ঞা আছে। প্রথম সংজ্ঞানুসারে জটিল বাক্য তিন বা ততোধিক বাক্যের সমষ্টি। এর মধ্যে ‘একটি প্রধান বাক্য’ থাকবে আর সেই প্রধান বাক্যের ওপর ‘নির্ভরশীল’ থাকবে ‘একাধিক বাক্য’। দ্বিতীয় সংজ্ঞা অনুযায়ী তিনের কম বাক্য নিয়েও জটিল বাক্য গঠিত হতে পারে। জটিল বাক্যে কোনো ‘প্রধান খণ্ড বাক্যের এক বা একাধিক আশ্রিত বাক্য’ ব্যবহৃত হয় ‘পরস্পর সাপেক্ষভাবে’। নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে জটিল বাক্যের পরিচয় দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘একটি মূল বাক্যের অধীনে এক বা একাধিক আশ্রিত বাক্য বা বাক্যাংশ থাকলে জটিল বাক্য তৈরি হয়। যেমন— যদি তোমার কিছু বলার থাকে, তবে এখনই বলে ফেল।’ (পৃ. ৮৩)।
আরও বলা হয়েছে, ‘যে-সে, যারা-তারা, যিনি-তিনি, যাঁরা-তাঁরা, যা-তা প্রভৃতি সাপেক্ষ সর্বনাম এবং যদি-তবে, যদিও-তবু, যেহেতু-সেহেতু, যত-তত, যেটুকু-সেটুকু, যেমন-তেমন, যখন-তখন প্রভৃতি সাপেক্ষ যোজক দিয়ে যখন অধীন বাক্যগুলো যুক্ত থাকে, তাকে জটিল বাক্য বলে।’ (পৃ. ৯০)। জটিল বাক্যের অধীন-আশ্রিত বাক্যকে সাপেক্ষ সর্বনাম বা সাপেক্ষ যোজক দিয়ে যুক্ত করতে হবে — এরকম কথা সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণে নেই, নেই অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণেও। শেষোক্ত ব্যাকরণে জটিল বাক্যের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এভাবে— ‘যে বাক্যে একটি স্বাধীন বাক্য এবং এক বা একাধিক অধীন বাক্য পরস্পর সাপেক্ষভাবে ব্যবহৃত হয়, তাকে জটিল বাক্য বা মিশ্র বাক্য বলে।’ এই সংজ্ঞা দেওয়ার পর, অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণে, উদাহরণ হিসাবে তিনটি বাক্য ব্যবহার করা হয়েছে। বাক্য তিনটির দুটি এরকম— ‘কোথাও পথ না পেয়ে তোমার কাছে এসেছি’ এবং ‘তুমি আসবে বলে আমি অপেক্ষা করে আছি’। (পৃ. ৫৯)। লক্ষণীয় যে, কোনোটিতেই সাপেক্ষ সর্বনাম বা সাপেক্ষ যোজক নেই। প্রশ্ন হচ্ছে এগুলিকে জটিল বাক্য বলার অবকাশ আছে কি? আরও একটি প্রশ্ন না করলেই নয়। জটিল বাক্য সম্পর্কে নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণ থেকে যে-দুটি উদ্ধৃতি আমরা দিয়েছি, সে-দুটির শেষোক্তটি(পৃ. ৯০ থেকে নেওয়া) এক বাক্যের। এতে সাপেক্ষ যোজক ‘যখন-তখন’-এর প্রথমাংশ ‘যখন’ ব্যবহৃত হয়েছে, শেষাংশ ‘তখন’ ব্যবহৃত হয়নি। এভাবে সাপেক্ষ যোজকের একাংশ বাদ দিয়ে জটিল বাক্য তৈরি করা যায় কি?
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, জটিল বাক্যের আলোচনা প্রথমে এসেছে সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণে। এই আলোচনায় ‘খণ্ড বাক্য’ ও ‘আশ্রিত বাক্যে’র কথা আছে। কিন্তু এগুলির সংজ্ঞায়ন ব্যাকরণটিতে করা হয়নি। তা করা হয়েছে অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণে। এতে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, উদাহরণও দেয়া হয়েছে সাথে। তবে সংজ্ঞা আর উদাহরণের মধ্যে মিল সবক্ষেত্রে পাওয়া যায় না। যেমন ‘খণ্ডবাক্যে’র সংজ্ঞা আর উদাহরণ —
একটি উদ্দেশ্য ও একটি বিধেয় ক্রিয়ার (সমাপিকা) সমষ্টি যদি নিজে একটি স্বাধীন বাক্য হিসেবে ব্যবহৃত না হয়ে অন্য কোনো বৃহত্তর বাক্যের অংশরূপে ব্যবহৃত হয়, তাকে খণ্ডবাক্য বলে। যেমন : যারা ভালো ছেলে, তারা শিক্ষকের আদেশ পালন করে। এ বাক্যে দুটি খণ্ডবাক্য আছে : ১. যারা ভালো ছেলে ২. তারা শিক্ষকের আদেশ পালন করে। (পৃ. ৫৭)।
প্রথম অর্থাৎ ১ সংখ্যক পদসমষ্টিতে কোনো বিধেয় ক্রিয়া (সমাপিকা) নেই। সে-কারণে, প্রদত্ত সংজ্ঞানুসারে, এটি খণ্ডবাক্য হতে পারে না। অথচ এটিকে খণ্ডবাক্যের উদাহরণ হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে।
জটিল বাক্য বিষয়ক আলোচনায় উল্লেখ করেছি, এই ধরনের বাক্যের দুটি সংজ্ঞা মেলে সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণে। যৌগিক বাক্যেরও দুটি সংজ্ঞা পাওয়া যায়, তবে তা সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণে নয়, নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে। সংজ্ঞা দুটির একটি এরকম— ‘এক বা একাধিক বাক্য বা বাক্যাংশ যোজকের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে যৌগিক বাক্য গঠন করে।’ (পৃ. ৮৩)। অন্য সংজ্ঞাটি হলো — ‘দুই বা ততোধিক স্বাধীন বাক্য যখন যোজকের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে একটি বাক্যে পরিণত হয়, তখন তাকে যৌগিক বাক্য বলে।’ (পৃ. ৯১)। সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণে যৌগিক বাক্যের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এভাবে— ‘পরস্পর নিরপেক্ষ দুই বা ততোধিক সরল বা জটিল বাক্য মিলিত হয়ে যখন একটি সম্পূর্ণ বাক্য গঠন করে, তখন তাকে যৌগিক বাক্য বলে।’ (পৃ. ৬১)।
আর অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণে বলা হয়েছে, ‘দুই বা তার অধিক সরল বা জটিল বাক্য মিলিত হয়ে যদি একটি সম্পূর্ণ বাক্য গঠন করে, তবে তাকে যৌগিক বাক্য বলে।’ (পৃ. ৫৯)। সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণের সংজ্ঞায় যৌগিক বাক্যের অন্তর্গত বাক্যগুলিকে ‘পরস্পর নিরপেক্ষ’ বলা হয়েছে কিন্তু অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণের সংজ্ঞায় সে রকম কিছু বলা হয়নি। তবে পরে, জটিল ও যৌগিক বাক্যের তুলনামূলক আলোচনায়, অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘জটিল বাক্যের অন্তর্গত বাক্যাংশগুলো পরস্পর সাপেক্ষ’ আর ‘যৌগিক বাক্যের অন্তর্গত বাক্যগুলো প্রায় স্বতন্ত্র।’ (পৃ. ৫৯)। প্রশ্ন উঠতে পারে, ‘পরস্পর নিরপেক্ষ’ আর ‘প্রায় স্বতন্ত্র’ পদগুচ্ছের অর্থ কি এক? নিশ্চয়ই নয়। এক্ষেত্রে আরও একটি ব্যাপার লক্ষ্য করার মতো। যৌগিক বাক্যের অন্তর্গত বাক্যগুলি কোন দিক থেকে, কোন বিবেচনায় পরস্পর নিরপেক্ষ বা প্রায় স্বতন্ত্র তা বলা হয়নি ব্যাকরণ দুটিতে। বললে ভালো হতো। কারণ, খোয়াল-খুশি মাফিক একাধিক বাক্য জুড়ে যৌগিক বাক্য তৈরি করার নিয়ম নেই। যৌগিক বাক্যে যে-দুই বা ততোধিক বাক্য যুক্ত হবে তাদের মধ্যে ‘একটা ব্যাপক সংগতি থাকা চাই। যেমন: ‘শাহেদুল ভালো ফুটবল খেলে আর আমার কুকুরটার সামনের ডানদিকের ঠ্যাংটা ভেঙে গেছে’ ঠিক সিদ্ধ যৌগিক বাক্য হবে না।’ (পবিত্র সরকার, পকেট বাংলা ব্যাকরণ, পাঞ্জেরী পালিকেশন্স, ঢাকা, ২০১১ পৃ. ১৩২)।
নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে, সরল বাক্যের আলোচনায় বলা হয়েছে, ‘সরল বাক্যে অনেক সময় ক্রিয়া অনুপস্থিত থাকে।’ (পৃ. ৯০)। এরকম কথা জটিল বা যৌগিক বাক্যের আলোচনায় নেই। জটিল আর যৌগিক বাক্যে কি ক্রিয়া উহ্য-অনুপস্থিত থাকতে পারে না? পারে, অবশ্যই পারে। সরল বাক্য যেমন, জটিল আর যৌগিক বাক্যও তেমনি ক্রিয়া উহ্য রেখে গঠন করা যায়। তাহলে জটিল ও যৌগিক বাক্যের আলোচনায় তা কেন উল্লেখ করা হবে না?
পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চার ব্যাকরণের তিনটিতে — সপ্তম, অষ্টম আর নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে — উদ্দেশ্য-বিধেয়ভিত্তিক বাক্যবর্ণনা আছে। এক্ষেত্রে, প্রথাগত ধারার আর সব বাংলা ব্যাকরণের মতই, অনুসরণ করা হয়েছে প্রথাগত ইংরেজি ব্যাকরণকে। সপ্তম আর নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে কারকের আলোচনাও আছে। কারক হলো প্রথাগত সংস্কৃত ব্যাকরণের বাক্যতত্ত্ব। হুমায়ুন আজাদের ভাষায়—
‘কারকতত্ত্বের মর্মবাণী হচ্ছে বাক্যের ক্রিয়ার সাথে বিভিন্ন বিশেষ্যপদ জড়িত থাকে কয়েক রকম সম্পর্কে; অর্থাৎ বাক্য শুধু দুটি প্রধান খণ্ডে বিভাজ্য নয়, বেশ কয়েকটি খণ্ডে ভাগ করা সম্ভব বাক্যসংগঠন … উদ্দেশ্যবিধেয়তত্ত্বের সার কথা হচ্ছে বাক্য দ্বিআংশিক, তা যতো বড়ো বা ছোটো হোক-না-কেন। তত্ত্ব দুটি পরস্পরবিরোধী, তাই তাদের মিশ্রণ অসম্ভব।’ (বাক্যতত্ত্ব, পৃ. ১০৮ )।
বহু বাংলা ব্যাকরণবিদ এই অসম্ভবকে সম্ভব করতে গেছেন এবং ব্যর্থ হয়েছেন। সপ্তম আর নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণের লেখক-সম্পাদকমণ্ডলীকেও সে-ব্যর্থতা বরণ করতে হয়েছে। (চলবে)
পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ব্যাকরণ: একটি পর্যালোচনা (শেষ পর্ব)
ছয়. অর্থ ও বানান বিষয়ক আলোচনা
পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণে ‘বাগর্থ’ শিরোনামে একটি পরিচ্ছেদ আছে। এই পরিচ্ছেদের শুরুতে বাগর্থের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এভাবে — “শব্দ ও বাক্যের অর্থের আলোচনা হলো বাগর্থ।” শব্দ আর বাক্যের অর্থের আলোচনা যদি বাগর্থ হয় তাহলে বাগর্থতত্ত্ব কী ? বলা হয়েছে, “অভিধানে প্রতিটি শব্দের অর্থ থাকে। কিন্তু সেই অর্থের বাইরে নানা অর্থে শব্দ ব্যবহৃত হয়। বাগর্থতত্ত্বে এসব দিক বিস্তৃতভাবে আলোচনা করা হয়।” (পৃ. ৫১)। অর্থাৎ, ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণের লেখক-সম্পাদকমণ্ডলীর বিবেচনায়, ‘বাগর্থ’ আর ‘বাগর্থতত্ত্ব’ এই পরিভাষা দুটি সমার্থক। এবিষয়ে তাঁদের সাথে নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণের লেখক-সম্পাদকমণ্ডলী একমত হতে পারেননি। জানিয়েছেন, “শব্দের বৈচিত্রময় অর্থকে বাগর্থ বলে।” (পৃ. ১০৬)। প্রাগুক্ত দুই ব্যাকরণের লেখক-সম্পাদকমণ্ডলী অর্থ সম্পর্কিত আরও কোনো কোনো বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তাই শব্দের অভিধান-অতিরিক্ত অর্থ ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণে ‘রূপক’ (পৃ. ৫৩) আর নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে ‘লক্ষার্থ’ (পৃ. ১০৬) হিসেবে বর্ণিত হয়েছে।
বোর্ডের ষষ্ঠ, সপ্তম আর অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণে ‘বানান’ শিরোনামে একটি করে পরিচ্ছেদ আছে। ষষ্ঠ শ্রেণির পরিচ্ছেদটি তিন অংশে বিভক্ত — ভূমিকা, ‘বানানের ধারণা’ ও ‘বানানের নিয়ম’। ‘বানানের ধারণা’ অংশের শেষ বাক্যটি এরকম — “বাংলা একাডেমির বানানরীতি এখন সর্বত্র মানা হচ্ছে।” (পৃ. ৫৭)। এই বাক্য পড়ে এমটা মনে হতেই পারে যে, ‘বানানের নিয়ম’ অংশে একাডেমির বানানরীতি অথবা তার প্রধান নিয়মগুলির বিবরণ থাকবে। কিন্তু আসলে তা নেই। ঐ অংশে ব্যাকরণটির লেখক-সম্পাদকমণ্ডলী নিজেদের বিবেচনা মতো বানানের ছয়টি নিয়ম সংকলন করেছেন। নিয়মগুলির বিবরণ এরকম —
১. বিদেশি শব্দের (ইংরেজি, আরবি-ফারসি ও অন্যান্য ভাষার শব্দ) বানানে সব সময় হ্রস্ব ই বা ই-কার (ি) হবে।... ২. বাংলা শব্দের বানানে সব সময় হ্রস্ব ই বা ই-কার (ি) হবে।... ৩. ভাষা ও জাতিবাচক শব্দের শেষে হ্রস্ব ই-কার হবে।... ৪. ইংরেজি শব্দে a-উচ্চারণ যেখানে অ্যা সেখানে এর জন্য অ্যা, s-এর উচ্চারণ যেখানে দন্তমূলীয় স্ সেখানে s-এর জন্য স, যেখানে শ-এর জন্য sh এবং st-এর জন্য স্ট হবে।... ৫. সংস্কৃত বা তৎসম শব্দে ‘র’-এর পরে ‘ণ’ (মূর্ধন্য-ণ) হবে।... ৬. বাংলা শব্দে র-এর পর ন হবে। (পৃ. ৫৭-৫৮)।
লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, নিয়মের বিবরণে ‘বিদেশি শব্দে’র পরিচয় দেওয়া হয়েছে, সংস্কৃত শব্দ বললে ‘তৎসম’ শব্দ বোঝায় তাও বলা হয়েছে, শুধু বলা হয়নি ‘বাংলা শব্দ’ (২ ও ৬ সংখ্যক নিয়মে উল্লিখিত) বলতে কী বোঝায়। তৎসম আর বিদেশি শব্দ ছাড়া আর সব শব্দই কি ‘বাংলা শব্দ’? স্পষ্ট করে বলা উচিত ছিল। উচিত ছিল বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত শব্দরাজির উৎসগত শ্রেণিবিভাগ সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দিয়ে তারপর বানানের নিয়ম লিপিবদ্ধ করা। নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে বাংলা শব্দের উৎসগত শ্রেণিবিভাগ সম্পর্কে আলোচনা আছে।(পৃ. ৫১)। ঐ আলোচনায় ‘বাংলা শব্দ’ নামে কোনো শব্দশ্রেণির উল্লেখ পর্যন্ত নেই। ষষ্ঠ শ্রেণির বানান-পরিচ্ছেদের ‘বানানের নিয়ম’ অংশে যে ছয়টি নিয়ম সংকলিত হয়েছে সেগুলির প্রথম তিনটিতে বাংলা একাডেমির প্রমিত বানানরীতির ‘অতৎসম শব্দ’ শীর্ষক পরিচ্ছেদের প্রথম (২.১ সংখ্যক) নিয়মের একাংশের বক্তব্য স্থান পেয়েছে। তিন-তিনটি নিয়ম রচনা করেও একাডেমির একটি নিয়মের বক্তব্য পুরোপুরি তুলে ধরা গেল না! একাডেমির ঐ নিয়মে আছে—
সকল অতৎসম অর্থাৎ তদ্ভব, দেশি, বিদেশি, মিশ্র শব্দে কেবল ই এবং উ এবং এদের কারচিহ্ন ি ু ব্যবহৃত হবে।... পদাশ্রিত নির্দেশক টি-তে ই-কার হবে।... সর্বনাম, বিশেষণ, ক্রিয়া-বিশেষণ ও যোজক পদরূপে কী শব্দটি ঈ-কার দিয়ে লেখা হবে।... যেসব প্রশ্নবাচক বাক্যের উত্তর হ্যাঁ বা না হবে, সেইসব বাক্যে ব্যবহৃত ‘কি’ হ্রস্ব ই-কার দিয়ে লেখা হবে। (বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম, পরিমার্জিত সংস্করণ, ২০১২, পৃ. ১৭-১৮)।
‘বানানের নিয়ম’ অংশের চতুর্থ নিয়মের বিবরণে গোলমাল আছে। নিয়মটিতে লেখক-সম্পাদকগণ সম্ভবত বলতে চেযেছেন— “ইংরেজি শব্দে a-এর উচ্চারণ যেখানে অ্যা সেখানে a-এর জন্য অ্যা, s-এর উচ্চারণ যেখানে দন্তমূলীয় স্ সেখানে s-এর জন্য স, sh-এর উচ্চারণ যেখানে তালব্য শ্ সেখানে sh-এর জন্য শ এবং st-এর জন্য স্ট হবে।” পঞ্চম নিয়মে “তৎসম শব্দে ‘র’-এর পরে ‘ণ’ (মূর্ধন্য-ণ)” এবং ষষ্ঠ নিয়মে “বাংলা শব্দে র-এর পর ন” ব্যবহার করতে বলা হয়েছে। কিন্তু বিদেশি শব্দে র-এর পরে ‘ণ’ আর ‘ন’-এর মধ্যে কোনটি ব্যবহার করতে হবে তা বলা হয়নি।
সপ্তম আর অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণের বানান-পরিচ্ছেদেও কিছু বিচ্যুতি-অসঙ্গতি আছে। পরিচ্ছেদ দুটি থেকে একটি করে উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণের বানান-পরিচ্ছেদের শেষাংশ “ষত্ব-নিষেধ (বানানে দন্ত্য-স)” শীর্ষক। এর প্রথম নিয়মে বলা হয়েছে, “তদ্ভব বা খাঁটি বাংলা শব্দে মূর্ধন্য-ষ হয় না, দন্ত্য-স হয়। যেমন: মিনসে।” (পৃ. ৭২)। একথা ঠিক নয়। তদ্ভব শব্দে ষ - স দুটিই চলে। ওষুধ, চাষ, মানুষ, ষাট, ষোল, ষাঁড় ইত্যাদি তদ্ভব শব্দের ‘ষ’-যুক্ত বানান ব্যাপকভাবে গৃহীত ও প্রচলিত। পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের বই-পত্রেও শব্দগুলির বানানে ‘ষ’ ব্যবহার করা হয়। অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণের বানান-পরিচ্ছেদে যে নিয়মগুলি সংকলিত হয়েছে সেগুলির প্রথমটি এরকম— “যেসব তৎসম শব্দের বানানে হ্রস্ব ও দীর্ঘ উভয় স্বর (ই ঈ, উ ঊ) অভিধানসিদ্ধ, সে ক্ষেত্রে এবং অতৎসম (তদ্ভব, দেশি, বিদেশি, মিশ্র) শব্দের বানানে শুধু হ্রস্বস্বর (ই ি , উ ু ) হবে।” (পৃ. ৬৬)। এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হলো, অতৎসম শব্দ বলতে তদ্ভব, দেশি, বিদেশি আর মিশ্র শব্দকে বোঝানো হয়েছে। বাদ গেছে অর্ধ-তৎসম শব্দের কথা।
সাত. সমস্যার কারণ ও সমাধানের উপায়
পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ষষ্ঠ, সপ্তম আর অষ্টম শ্রেণির ‘বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি’ বইয়ের ‘প্রসঙ্গ কথা’ অংশটি অভিন্ন। এতে বলা হয়েছে, “পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের বিপুল কর্মকাণ্ডের মধ্যে অতি অল্প সময়ে পুস্তকটি রচিত হয়েছে। ফলে কিছু ত্রুটি থেকে যেতে পারে।” এতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ ‘অতি অল্প সময়ে’ কেন করতে হলো সে-বিষয়ে সমালোচনায় প্রবৃত্ত না হয়েও আমরা বলতে পারি, বোর্ডের ব্যাকরণগুলিতে যে-ত্রুটি আছে তা পরিমাণে ‘কিছু’ নয়, প্রচুর। তাছাড়া, বোর্ডের ব্যাকরণগুলি পরীক্ষা করে আমাদের মনে হয়েছে, ত্রুটি কেবল রচনাতেই নয়, পরিকল্পনাতেও আছে। যথেষ্ট সময় নিয়ে, ভেবে-চিন্তে পরিকল্পনা করা হয়নি। কোন শ্রেণির ব্যাকরণে কোন বিষয় কতখানি আলোচিত হবে, কোন বিষয়টি আগে আর কোনটি পরে আলোচনা করতে হবে, অধ্যায়-পরিচ্ছেদ-অনুচ্ছেদের বিভাজন-বিন্যাস কীরকম হবে এবং অন্য ভাষার প্রথাগত ব্যাকরণের সূত্র-সিদ্ধান্ত নির্বিচারে গ্রহণ-ব্যবহার করা যাবে কিনা, এসব ব্যাপারে বোর্ডের ব্যাকরণগুলোর লেখক-সম্পাদকদের কাছে সুস্পষ্ট নির্দেশনা ছিল বলে মনে হয় না। যদি তা থাকতো তাহলে শিক্ষার্থীরা ষষ্ঠ শ্রেণিতেই ব্যাকরণ কী সে-বিষয়ে ধারণা লাভ করত, ধ্বনি-শব্দ-বাক্যের বিভিন্ন সংজ্ঞা পেত না তারা, শব্দগঠনের আগে পদনির্মণের কৌশল শিখতে হতো না তাদের, বহু অপ্রয়োজনীয় সূত্র-দৃষ্টান্ত মুখস্থ করার কষ্ট থেকে, পরস্পরবিরোধী নানা বর্ণনা-বিবরণ পড়ার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেত তারা।
বোর্ডের প্রথম ব্যাকরণ অর্থাৎ ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণে প্রধান্য পেয়েছে ধ্বনি সম্পর্কিত আলোচনা। এই আলোচনা পরিমাণের দিক থেকে ভাষা, শব্দ, বাক্য ও অর্থ বিষয়ক আলোচনার সমষ্টির প্রায় সমান। বোর্ডের অন্য তিন ব্যাকরণে সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে রূপতত্ত্ব — শব্দ আর পদ সম্পর্কিত আলোচনা। রূপতত্ত্ব, সপ্তম আর অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণে ধ্বনিতত্ত্ব ও বাক্যতত্ত্বের সমষ্টির চেয়েও বেশি অংশ জুড়ে আছে। নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে তা আছে ধ্বনিতত্ত্ব, বাক্যতত্ত্ব আর অর্থতত্ত্বের সমষ্টির প্রায় সমান অংশ জুড়ে। অথচ, ব্যাকরণগুলিতে সর্বাধিক গুরুত্ব পাওয়ার কথা বাক্যতত্ত্বের। কারণ, বাক্যই ভাষার কেন্দ্রবস্তু — বাক্যের সাহায্যেই মানুষ ভাষিক যোগাযোগ সম্পন্ন করে থাকে। একথা অবশ্য স্বীকার করতেই হবে, কেবল পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ব্যাকরণে নয়, বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া, প্রথাগত ধারার সব বাংলা ব্যাকরণেই রূপতত্ত্বের প্র্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। শব্দ আর পদের আলোচনাই থাকে এধারার ব্যাকরণের বড় অংশটা জুড়ে। এর কারণ কী? হুমায়ুন আজাদের পর্যবেক্ষণ অনুসারে —
রূপতত্ত্বকে আমাদের ব্যাকরণ বইগুলোতে প্রধান স্থান দেয়া হয়, কেননা ও-বিষয়ে শতাব্দী পরম্পরায় কাজ হয়েছে, তাই ও-বিষয়টিকেই সহজ সম্বল করে নেন ব্যাকরণ রচয়িতারা। ... আমাদের ব্যাকরণবিদেরা ধরে নেন যে, বাক্য গঠন করতে আমরা সবাই জানি; এবং বাক্যের অর্থ বুঝি বেশ চমৎকারভাবে, শুধু যা পারি না, বুঝি না, তা হলো শব্দগঠন। তাই সমাসের উপর, সন্ধির উপর, প্রত্যয়ের উপর, বিভক্তির উপর, উপসর্গের উপর তাদের দৃষ্টি পড়ে — দৃষ্টি পড়ে না বাক্যের উপর, অর্থের উপর।” (‘ব্যাকরণবোধ এবং বাংলা ব্যাকরণ’, একুশের সংকলন/৭৭, বাংলা একাডেমি, ঢাকা ১৯৭৭, পৃ. ৬৮-৬৯)।
পবিত্র সরকার একে অর্থাৎ ব্যাকরণে রূপতত্ত্বের ওপর অধিক গুরুত্বারোপের ব্যাপারকে, ‘‘একধরনের অভ্যাস-আলস্যের মৌমাছিতন্ত্র’’ বলেছেন এবং স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, “রামমোহন, হরপ্রসাদ, রবীন্দ্রনাথ, রামেন্দ্রসুন্দর প্রমুখ কয়েকজন তা ভাঙবার চেষ্টা করেও ভাঙতে পারেননি।” (পবিত্র সরকারের পূর্বোক্ত প্রবন্ধ, পৃ. ৪৯)
রামমোহন, হরপ্রসাদ, রবীন্দ্রনাথ, রামেন্দ্রসুন্দর প্রমুখ সফল হতে পারেননি, খুব সম্ভবত, তাঁদের চেষ্টা সংঘবদ্ধ কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক ছিল না বলে। পাঠ্যপুস্তক বোর্ড আমাদের জাতীয় প্রতিষ্ঠান। শিক্ষাক্ষেত্রে এর যে মান্যতা আছে তা আর কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের নেই। বোর্ড চাইলে, সচেষ্ট হলে পরিস্থিতি বদলাতে পারে। মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় নয় এমন অনেক সংজ্ঞা-সূত্র-উদাহরণ-বিবরণ আছে বোর্ডের ব্যাকরণগুলির রূপতত্ত্ব অংশে। অন্য অংশগুলিতেও আছে বেশ কিছু।
বোর্ড এসব বাদ দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। তাছাড়া, একই বিষয়ের বিবরণ-বিশ্লেষণ একাধিক শ্রেণির ব্যাকরণের অন্তর্ভুক্ত না করার সিদ্ধান্তও নিতে পারে বোর্ড। বর্তমানে ধ্বনি-শব্দ-বাক্যের সংজ্ঞা আর শ্রেণিকরণ, ণ-ত্ব ও ষ-ত্ব বিধি, উপসর্গ, প্রত্যয়, শব্দদ্বৈত, সন্ধি, লিঙ্গ, বচন, বিভক্তি, কারক, আকাঙ্ক্ষা-আসত্তি-যোগ্যতা, উদ্দেশ্য-বিধেয়তত্ত্ব, বিরামচিহ্ন, প্রতিশব্দ বা সমার্থক শব্দ, বিপরীতার্থক শব্দ, বাগধারা ইত্যাদি বিষয়ের মধ্যে কোনোটির আলোচনা দুই ব্যাকরণে, কোনোটির আলোচনা তিন ব্যাকরণে আর কোনোটির আলোচনা চার ব্যাকরণেই আছে। একের অধিক ব্যাকরণে এগুলি না থাকলেও চলে। প্রয়োজনে পুনরুল্লেখ থাকতে পারে, পুনরালোচনা অনাবশ্যক। প্রাগুক্ত বিষয়সমূহের পুনরালোচনার পরিবর্তে ব্যাকরণগুলিতে অধিক পরিমাণে বাক্য বিষয়ক পাঠ যুক্ত করার সিদ্ধান্ত যদি নেয় বোর্ড, তাহলে শিক্ষার্থীরা লাভবান হবে।
পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ব্যাকরণগুলিতে বাক্য সম্পর্কিত আলোচনাকে প্রধান স্থান দেওয়া দরকার। দরকার শিক্ষার্থীদের বাক্যবোধ জাগানো চেষ্টাকে ব্যাকরণগুলির মূল উদ্দেশ্য হিসাবে গ্রহণ করা। “পশ্চিমে এ-চেষ্টা অন্তহীন। সেখানে শিক্ষার্থীদের মনে বাক্যবোধ সৃষ্টির নিরন্তর চেষ্টা চালানো হয়, ও শুদ্ধ বাক্য রচনার কৌশল শেখানো হয় নিত্য অভিনব উপায়ে।” (হুমায়ুন আজাদ, বাক্যতত্ত্ব, পৃ. ১৮)।
পাঠ্যপুস্তক বোর্ডকেও অনুরূপ উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ, আকাঙ্ক্ষা-আসত্তি-যোগত্যার প্রথাগত বিবরণ দিয়ে, উদ্দেশ্য-বিধেয়ের প্রচলিত তত্ত্ব গলাধঃকরণ করিয়ে, সরল-জটিল-যৌগিক বাক্যের গতানুগতিক জ্ঞান দিয়ে, বাচ্য বা উক্তিপরিবর্তনের কিছু নিয়ম শিখিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যথার্থ বাক্যবোধ জাগানো যাবে না। তাদের সামনে বাক্যের রহস্য উন্মোচন করতে হবে। বাংলা বাক্যে কোন পদ কোথায় বসে, কোন পদ কী কাজ করে, পদগুচ্ছ কত রকমের হতে পারে, পদগুচ্ছগুলির পারস্পরিক সম্পর্ক কেমন হয়, বাক্যের কোন অংশ (উদ্দেশ্য-বিধেয়) কত ধরনের হতে পারে, বাক্য কত ছোট বা কত বড় করা সম্ভব, কত বিচিত্র উপায়ে গঠিত হতে পারে সরল-জটিল-যৌগিক বাক্য, আদেশ-নিষেধ-অনুরোধ-প্রশ্নকরণের শৃঙ্খলা কী, আগের বাক্যের সঙ্গে পরের বাক্যের সম্পর্ক কী হবে, বাক্যের অর্থ কখন কী রকম হয় ইত্যাদি শিক্ষার্থীদের জানাতে হবে, বোঝাতে হবে। এই জানানো-বোঝানোর কাজ সংক্ষেপে, উল্লেখ-ইঙ্গিতের মাধ্যমে সারলে চলবে না। প্রতিটি বিষয় পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ-উদাহরণসহ শিক্ষার্থীদের সামনে উপস্থাপন করতে হবে। তবেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে যথার্থ বাক্যবোধ জন্মাবে, বাক্য থেকে অবাক্য-অপবাক্য পৃথক করতে পারবে তারা।
পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ব্যাকরণ চারটি প্রণয়ন ও সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেছে ভাষাবিদ-ব্যাকরণবিশারদদের চারটি পৃথক দল। লক্ষ্ করলেই দেখা যাবে, দল চারটির ব্যাকরণ বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গি অভিন্ন নয়। ফলে একই বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য-বর্ণনা বোর্ডের ব্যাকরণগুলিতে স্থান পেয়েছে। এর কিছু দৃষ্টান্ত আমরা দিয়েছি। ভাষাবিদ-ব্যাকরণবিশারদদের একটি অভিন্ন দল ব্যাকরণগুলি প্রণয়ন-সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করলে এরকম সমস্যা হতো না অথবা হলেও পরিমাণে অনেক কম হতো। আমরা তাই মনে করি, বিশেষজ্ঞদের একটি অভিন্ন দলকে বোর্ডের ব্যাকরণগুলি নতুন করে প্রণয়ন ও সম্পাদনার দায়িত্ব দেওয়া দরকার। লেখক-প্রণেতাদের দল ভিন্ন হলেও হয়তো চলে। কিন্তু সম্পাদকমণ্ডলী অভিন্ন হওয়া অত্যাবশ্যক। অন্য ভাষার প্রথাগত ব্যাকরণের অচল-অপ্রয়োজনীয় সূত্রাদির মানদণ্ডে বাংলা ভাষার উপাদান বিশ্লেষণে আগ্রহী নন এমন বিশেষজ্ঞগণই যেন ব্যাকরণগুলির লেখক-সম্পাদক দলে স্থান পান, এটা নিশ্চিত করতে হবে বোর্ডকে।
স্কুলের শিক্ষার্থীদের যে বাংলা ব্যাকরণ পড়ানো হয় তাকে ‘দুঃস্বপ্নে’র সঙ্গে উপমিত করেছেন ভাষাবিজ্ঞানী প্রবাল দাশগুপ্ত। জানিয়েছেন, এই দুঃস্বপ্নের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো ‘জেগে ওঠা।’ জেগে ওঠার অর্থ এক্ষেত্রে ‘লাফ মেরে তড়াক করে জেগে ওঠা’ নয় বরং ‘স্বপ্নের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসার রাস্তা খুঁজে’ নেওয়া। অধ্যাপক দাশগুপ্তের বিবেচনায়, সেই রাস্তা খোঁজার কাজ করতে ‘ধৈর্য’ লাগবে, ‘পরিশ্রম’ লাগবে, সবচেয়ে বেশি লাগবে ‘সাহস’।(কথার ক্রিয়াকর্ম, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ১৯৮৭, পৃ. ৪৯)। এখন থেকে সতেরো-আঠারো বছর আগে পশ্চিমবঙ্গের মধ্যশিক্ষা পর্ষৎ স্কুল-পাঠ্য বাংলা ব্যাকরণ নামক দুঃস্বপ্নের অবসান ঘটানোর পরিকল্পনা করেছিল। কাজও শুরু করেছিল। কিন্তু প্রাচীনপন্থীদের বাধার মুখে বাদ দিয়েছিল সে কাজ। সাহসে কুলায়নি। (বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন, তুষারকান্তি মহাপাত্র সম্পাদিত ভাষা ভাবনা, অবভাস, কলকাতা, ২০০৫)।
এ প্রসঙ্গ আসছে কেন? এর কারণ হলো, বোর্ডের ব্যাকরণগুলির কোনো কোনো পরিচ্ছেদ দেখে আমাদের মনে হয়েছে যে, ব্যাকরণ নামক দুঃস্বপ্নের কবল থেকে শিক্ষার্থীদের মুক্তি দিতে চায় বোর্ড। উদাহরণ হিসাবে ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণের ধ্বনিতত্ত্ব পরিচ্ছেদের কথা বলা যায়। এই পরিচ্ছেদে ধ্বনি সম্পর্কিত আলোচনায় প্রথাগত ব্যাকরণের অচলায়তন ভাঙার যে-চেষ্টা লক্ষ্ করা যায় তা কম সাহস ও সাধনার ব্যাপার নয়। পশ্চিমবঙ্গের মধ্যশিক্ষা পর্ষৎ যেখানে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ আমাদের পাঠ্যপুস্ততক বোর্ড সেখানে কিছুটা হলেও সফল। এক্ষেত্রে পুরোপুরি সফল হতে চাইলে বোর্ডকে আরও প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
আট. কথাশেষ
বর্তমান রচনায় আমরা পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ব্যাকরণগুলির বিভিন্ন অংশের ওপর আলোকপাত করেছি। এসব অংশে বিদ্যমান সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করে সেগুলি দূর করার উপায় নির্দেশের চেষ্টাও করেছি আমরা। এই কাজে সব ক্ষেত্রে সফল হয়েছি এরকম দাবি আমরা করি না। আমরা বরং আশা করি, আমাদের ব্যর্থতা দেখে ভাষাবিদ-ব্যাকরণবিশারদগণ বোর্ডের ব্যাকরণগুলি নিয়ে আরও ব্যাপক ও গভীর আলোচনায় আগ্রহী হবেন এবং তাঁদের আলোচনা-সমালোচনার মধ্য দিয়ে বোর্ডের ব্যাকরণগুলির সমস্ত সমস্যা চিহ্নিত হবে, সমাধানের আরও কার্যকর উপায় বেরিয়ে আসবে। পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ব্যাকরণগুলি ত্রুটিমুক্ত হোক, শিক্ষার্থীদের ভাষাশিক্ষার অপরিহার্য উপকরণে পরিণত হোক, এই আমাদের প্রার্থনা।


মুহাম্মদ শহীদুল ইসলাম
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, খুলনা সরকারি মহিলা কলেজ



No comments

Thank you, best of luck

Theme images by sbayram. Powered by Blogger.