ads

নজরুল যে ভাবে ‘বিদ্রোহীকবি ’ হলেন:

ছবি: সংগৃহীত



বিদ্রোহী কবিতার সৃষ্টি: 
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম-বিদ্রোহী কবি হিসেবেই সর্বাধিক পরিচিতি সাহিত্য চর্চার দিনগুলোতেই পান। তাঁর এ বিশেষ বিশেষণ টি তাঁর নামের সাথে সংযুক্ত হয় বিদ্রোহী কবিতা রচনার মধ্য দিয়ে । এ কবিতাটি লিখে তৎকালীন কলকাতা যথা বাংলা-ভারত বর্ষে আলোড়ন সৃষ্টি করেন প্রিয় কবি নজরুল। তাই বলা যায-বিদ্রোহী কবিতা লিখেই নজরুল বিদ্রোহী কবি হয়ে যান।
বৃটিশদের প্রায় দু’শ বছরের অত্যাচার,নিপীড়ন ও জর্জরিত জাতিকে শোষণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা অর্জনের আহবান জানিয়েছেন প্রিয় কবি নজরুল। বিদ্রোহী কবিতাটি কবি নজরুল লিখে সে সময়ে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সরকারের দমন-পীড়নের জবাব দেন। একই সাথে তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন।
পরাধীনতার শৃংখল ভেঙ্গে তরুণ সমাজকে সু-শৃঙ্খল হতে সহায়তা করেছিল বিদ্রোহী কবিতাটি। জীর্ণশীর্ণ ও দু’বছরের একটি পরাধীন জাতিকে একটি স্বাধীন ও শোষণমুক্ত সমাজ গঠনে বিদ্রোহী কবিতার ভূমিকা রয়েছে। তৎকালীন সময়ে বিদ্রোহী কবিতাটি কতটুকু চ্যালেঞ্জিং বিষয় ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না ।
কবি নজরুল ১৯২০ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসে পাকিস্থানের করাচি থেকে কলকাতায় চলে আসেন। ফলে সর্বপ্রথম কলিকাতায় কমরেড মুজাফফর আহমেদের সাথে পরিচয় হয় এবং তাঁর সাথে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে।
এ বছরই নজরুলের সম্পাদনায় ‘সান্ধ্য দৈনিক ‘নববুগ’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। পরে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের ‘নবযুগ’ পত্রিকায় তিনি নিয়মিত সাংবাদিকতা শুরু করলেন। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হতে থাকে তখন।

ছবি: সংগৃহীত
কবিতার জন্মকথা: 
১৯১৯ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে ফিরে কাজী নজরুল ইসলাম তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু মুজাফফর আহমেদের সাথে কলকাতায় বসবাস শুরু করেন। এ সময় তারা কলকাতার তালতলা লেনে বসবাস করছিলেন, তখন নজরুল কবিতাটি লেখেন। বিদ্রোহী কবিতার রচনার প্রেক্ষাপট নিয়ে জানা যায়, ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহের কোনো এক রাতে ৩-৪ সি তালতলা, কলকাতা-১৪ লেনের বাড়ির নিচ তলায় দক্ষিণ-পূর্ব কোণে ঘরে বসে শেষ রাতে নিবিড় পরিবেশে তিনি ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি রচনা করেন। মুজাফফর আহমেদের মতে, কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ৬ জানুয়ারি ১৯২২ সালে সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকায়। প্রকাশের পর, কবিতাটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং দ্য মোসলেম ভারত, প্রবাসী , মধুমতি এবং সাধনা ম্যাগাজিন সহ অন্যান্য কিছু পত্রিকাও কবিতাটি প্রকাশ করে।  কবিতাটি প্রথম ১৯২২ সালের অক্টোবর মাসে আর্য পাবলিশিং হাউস থেকে প্রকাশিত অগ্নিবীণা বইয়ে অন্যান্য ১১টি কবিতার সাথে সংগ্রহ করা হয়েছিল।
বিদ্রোহী কবিতাটিতে ১৪টি ছোট-বড় স্তবক, ১৪১টি লাইন বা পংক্তি এবং ১৪৫ বার ‘আমি’ শব্দটি তিনি ব্যবহার করেছিলেন। ‘আমি’ দ্বারা তিনি হয়তো বুঝাতে চেয়েছেন-ভারত বর্ষের স্বাধীনতাকামী প্রতিটি মানুষের প্রতিনিধি।
ছবি: সংগৃহীত

তিনি কবিতার ভাষায় বলতে চেয়েছেন কারো অধীন হয়ে নয়-বরং আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকাই মানুষের সার্থকতা। ভাব-ভাষা ও উপমা-ছন্দে বিদ্রোহী কবিতাটি রচিত এক অনবদ্য রচনা। বিদ্রোহী কবিতাটি যখন তিনি রচনা করেন-তখন ভারতবর্ষে বৃটিশ বিরোধী গান্ধীজির নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন চলছিল এবং এক উত্তাল হাওয়া বিদ্যমান ছিল। গোটা ভারতবর্ষে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ছিল। এর মধ্যেই তার কালজয়ী রচনা‘ বিদ্রোহী’। বিদ্রোহী কবিতার প্রথম শ্রোতা তাঁর বন্ধু কমরেড মুজ্জাফর আহমেদ।
১৯২২ সালের জানুয়ারি কবিতাটি অবিন্যাশ চন্দ্র ভট্টাচার্য সম্পাদিত তৎকালীন ‘সাপ্তাহিক বিজলী’পত্রিকায় দেন। পরে মসলেম ভারত পত্রিকার সম্পাদক আজজালুল হক প্রিয় কবিকে অনুরোধ করলে তিনি তারঁ কাছে রাখা পেন্সিল দিয়ে লেখা কপিটি ছাপাতে দিয়ে দেন।
প্রথম প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক ‘বিজলী’ পত্রিকায় ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি বা বঙ্গাব্দ ১৩২৮ সালের ২২ পৌষ তারিখে। এরপর মাসিক ‘মোসলেম ভারত’পত্রিকার কার্তিক সংখ্যায় পত্রিকাটি অনিয়মিত হওয়ায় ১৩২৮ সালের কার্তিক মাসের পরিবর্তে মাঘ মাসে প্রকাশিত হয়েছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি আবারও ছাপা হয়।
বল বীর
উন্নত মম শির ……..
পরের দিন কবি নিজেই বিজলী পত্রিকার ৪টি কপি নিয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুটিরে গিয়ে আবৃত্তি করে শুনান। এতে কবিগুরু অভিভূত হন এবং তিনি বলেন,‘ তুমি অনেক বড় কবি হতে পারবে।’সেই থেকে তাঁর নাম চারদিকে ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে এবং পরে বিদ্রোহীকবি বলে স্বীকৃতি লাভ করেন। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার এ পুনঃ পুনঃ প্রকাশনা তখনকার সময়ে পাঠক ও প্রকাশকের মধ্যে এর তুমুল জনপ্রিয়তার প্রমাণ বহন করে। একই বছর এটি মাসিক ‘প্রবাসী’এবং মাসিক‘বসুমতী’ এবং পরের বছর ১৩২৯ বঙ্গাব্দে মাসিক ‘সাধনা’য় পুন:প্রকাশিত হয়। 
কলকাতা ৩/৪ সি,তালতলা লেন,কলকাতা-১৪ বাড়িটি ছিল তখন‘রাজেন্দ্র কুঠির’ নামে। পরে মালিকানা পরিবর্তন হয়ে হয় সীমা সাহার বাড়ি’। বর্তমানে‘নজরুল স্মৃতি কক্ষ’ হিসেবে পরিচিতি রয়েছে। 
১৯২৯ সালে কলকাতার অ্যালবার্ট হলে বিদ্রোহী কবি বা জাতীয় কবি হিসেবে সংবর্ধনা প্রদান করেন। প্রধান অতিথি ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু এবং ভারতের তৎকালীন বিজ্ঞানী প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ছিলেন অনুষ্ঠানের সভাপতি। বস্তত:এ কবিতার জন্ম বাংলা সাহিত্য ও বাঙালির সংগ্রামের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত সাড়া জাগানো ঘটনা। 
পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকা,ব্রিটিশরাজের অনুগ্রহ-প্রত্যাশী বাঙালি জাতিকে নজরুল এ কবিতার মাধ্যমে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিলেন। বিশেষ করে মুক্তিকামী বাঙালি তরুণ সমাজের কাছে এ কবিতা ছিল রক্তে উন্মাদনা সৃষ্টিকারী, হৃদয়ে অগ্নি-প্রজ্বলনকারী এক বজ্রকঠিন ধ্বনি। কবির রচিত অগ্নীবীণা কাব্যগ্রন্থে বিদ্রোহী কবিতাটি অর্ন্তভূক্ত করা হয়েছে।  আর এভাবেই কবি বিদ্রোহী কবি হয়ে গেলেন। 




No comments

Thank you, best of luck

Theme images by sbayram. Powered by Blogger.