সাধু সাবধান!
কৃষির উন্নয়নে মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন
আমার মা বাড়িতেই শাক-সবজি চাষ করতেন। লাউ-কুমড়া, পালং ইত্যাদি। সেগুলো নিজেরা খাওয়া হতো, প্রতিবেশিদের দেওয়া হতো। চলে যেতো আত্মীয়-সজনদের বাড়িও। মা তাঁর সব মেয়ের জামাইয়ের জন্য হাঁস-মুরগি পালতেন। একেক জামাইয়ের ভাগে পড়ত ২টা করে মুরগি। একেকটা মুরগি বড়ো হতে ৮-১২ মাস সময় লাগত।
আমার নানিও আমাদের জন্য মুরগি পালতেন। বছরে একবার নানাবাড়ি গেলে সেই মুরগি জবাই করা হতো। দাদাবাড়ির অবস্থাও একই রকম। জন্ম থেকে শহরে বড়ো হয়েছি। বছরে একবার দাদাবাড়ি যেতাম। দাদিও মুরগি পালতেন।
এছাড়া তখন দেখতাম সব বাড়িতে গোরু পালত। যে বাড়ির কিছুই নাই সেই বাড়িতেও দুইটা গোরু থাকত। এখন আগের মতো কেউ মুরগি পালে না। কারণ সব বাড়ি এখন দালানে পরিণত হয়েছে। বাড়িতে সুন্দর সুন্দর ফার্নিচার এসেছে। মুরগি পাললে সেই মুরগি ফার্নিচারের উপরে পায়খানা করে দিবে। গ্রামের বাড়িতে গেলে এখন ফার্মের মুরগি খাওয়ায়। এখন তো গ্রামে গ্রামে মুরগির ফার্ম হয়ে গেছে।
চট্টগ্রাম শহরে বড়ো হয়েছি। ১৯৯০ সালেও দেখেছি চট্টগ্রাম শহরের অনেক বিল্ডিংয়ের মালিক গোরু পালতেন। তখন মিল্ক ভিটা আড়ংয়ের দুধ পাওয়া যেত না। আশেপাশে খুঁজলেই কোনো না কোনো বিল্ডিংয়ে দুধ পাওয়া যেত। চট্টগ্রাম শহরের ইদগাহে থাকতাম। পাশেই ছিল ওয়াবদা কলোনি। সেখানে বাবু নামের কয়েকটা ছেলে ছিল। এর মধ্যে এক বাবুর বাবা গোরু পালত। সেই কারণে ছেলের নাম হয়েছে গোরু বাবু। গোরু বাবুর আব্বা ছিলেন প্রথম অথবা দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি অফিসার।
এছাড়া পরিচিত প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাও তখন গোরু পালতেন। সেই গোরু পালা এখন শিক্ষিত সমাজের কাছে প্রেস্টিজিয়াস ব্যাপার। শহরে ফার্ম ছাড়া আর কোথাও গোরু দেখতে পাবেন না। আর গ্রামের অবস্থাও সেই তুলনায় ভয়াবহ। আগে যেখানে প্রত্যেক বাড়ি বাড়ি গোরু থাকত এখন সেই গোরু নেই। অশিক্ষিত কৃষকের 'শিক্ষিত' ছেলে কেন গোরু পালবে? এটা তো 'ছোটো' কাজ। লেখাপড়া শিখেছে কি গোরু পালার জন্য?
ফলাফল -দেশে এখন গোরু নাই। গোরুর মাংসের দাম এখন ঢাকায় ৭০০ ও চট্টগ্রামে ৮০০ টাকা কেজি! খুব শীঘ্রই এটা হাজারে পৌঁছে যাবে। আর দেশি মুরগির কথা কী বলব। দেশি মুরগির নামেএকই রকম কালারের এক ধরনের মুরগি ফার্মে চাষ হচ্ছে। খাঁটি দেশি মুরগি যদিও পান তাহলে দাম হবে ৬/৭ শ টাকা পিস! তাও তার পিউরিটি নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কারণ এখন বাড়িতে পালা মুরগিকেও পোল্ট্রি ফিড খাওয়ানো হয় দ্রুত বড়ো করার জন্য।
কৃষিপ্রধান দেশ এখন আর কৃষি প্রধান নেই। বিদেশিরা আমাদেরকে বুঝিয়েছে -তোমাদের এখন কৃষি কাজ মানায় না। তোমরা লেখাপড়া করে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হবে। না পারলে আমলা, কামলা হবা। এ দেশে শিল্প-প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হবে। তোমরা শার্ট, প্যান্ট ইন করে সেখানে চাকরি করবে। এই-সেই বুঝিয়ে কৃষকদের সন্তানদের কৃষি থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ে টেকনিক্যালি কৃষি সেক্টর দখল করে নিল ইউরোপ, আমেরিকা, চিন, রাশিয়া!
আপনি পরাশক্তিদের দিকে তাকান। তাদের অর্থনৈতিক ভিত্তির বড়ো অংশ কৃষি। আমাদের কৃষকরা সবচেয়ে অবহেলিত, চাষা এখন একটা গালি! আর আমেরিকাসহ দুনিয়ার উন্নত সব দেশে কৃষি কাজ করে। আমরা গার্মেন্টসে কামলা খাটি, বিদেশে কামলা খাটি, সেই কষ্টের টাকা দিয়ে বিদেশ থেকে চাল, ডাল, পেয়াজ, রসুন, গম সবই আমদানি করি।
শিল্প বিপ্লবের একটা পর্যায়ে ইউরোপ আমেরিকা বুঝতে পেরেছিল এইসব মিল ইন্ডাস্ট্রি মূলত পরিবেশের ক্ষতিই করে। এসব দেশে রাখা যাবে না। টেকনিক করে এগুলো গরিব দেশে গছিয়ে দেয়া হলো আর বিনিময়ে ছিনিয়ে নেয়া হলো কৃষি!
অথচ কী হবার কথা ছিল? আমাদের কৃষকদের সন্তানদের কৃষি শিক্ষার উপর গুরুত্ব দিয়ে তাদেরকে উন্নত মানের কৃষকে পরিণত করার দরকার ছিল। কৃষি নিয়ে গবেষণা হওয়ার দরকার ছিল। যে টেক্সটাইল, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি তখন চালু হয়েছিল সেগুলো যাতে নদী দূষণ করতে না পারে সে ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া উচিৎ ছিল। দেশের নদীগুলোতে এখন মাছ নেই৷ ভাতে মাছে বাঙালি এখন নদীর মাছ খায় ১ হাজার টাকা কেজিতে। চাষের পাঙাশের দাম এখন ২০০+ টাকা৷ খাওয়ার কিছুই নাই। আল্লাহ না করুক ৩য় বিশ্ব যুদ্ধের মতো বড়ো কোনো বিপর্যয় ঘটে গেলে এদেশের লোকজন খাবার পাবে না। কারণ আমদানি তখন বন্ধ থাকবে। আর কৃষি প্রধান দেশ দাবি করা দেশ হলেও আমরা চাল আমদানিতে শীর্ষের ২য় অবস্থানে আছি। ডাল আসে মিশর থেকে, রসুন আসে ভারত ও চায়না থেকে। তেল আসে ব্রাজিল থেকে।
পরিশেষে একটা কথা বলি। যার কাছে যতটুকু জমি আছে তা কাজে লাগান। অন্তত কিছু না হলেও লেবু গাছ লাগান। বিশ্ব পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে তাতে এক সময় গুলশান বনানির জমির চেয়েও দামী হবে চাষের জমির। শুধুমাত্র ৩য় বিশ্বযুদ্ধ লেগে গেলে এদেশের কৃষকরা হবে ধনী আর আমার আপনার মতো লোকজন এক লাফে গরিবের কাতারে চলে যাব। অতএব সাধু সাবধান।
সংগৃহীত ও সম্পাদিত
No comments
Thank you, best of luck