ads

অধ্যাপক আবুল ফজল বিচিত্র পথে যাঁর যাতায়াত


“মানুষকে মানুষ হিসেবে এবং মানবিকবৃত্তির বিকাশের পথেই বেড়ে উঠতে হবে আর তার যথাযথ ক্ষেত্র রচনাই মানব কল্যাণের প্রাথমিক সোপান। সে সোপান রচনাই সমাজ আর রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সমাজের ক্ষুদ্রতম অঙ্গ বা ইউনিট পরিবার- সে পরিবারকেও পালন করতে হয় এ দায়িত্ব। কারণ, মানুষের ভবিষ্যৎ জীবনের সূচনা সেখান থেকেই। ধীরে ধীরে ব্যাপকতর পরিধিতে যখন মানুষের বিচরণ হয় শুরু, তখন সে পরিধিতে যেসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তার সংযোগ ঘটে তা শিক্ষা কিংবা জীবিকা সংক্রান্ত যা হোক না তখন সে দায়িত্ব এসব প্রতিষ্ঠানের ওপরও বর্তায়। তবে তা অনেকখানি নির্ভর করে অনুক‚ল পরিবেশ ও ক্ষেত্র গড়ে তোলার ওপর।”
অধ্যাপক আবুল ফজল ওপরের কথাগুলো তার বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘মানব কল্যাণে’ বলেন। উক্ত প্রবন্ধে তিনি আরও বলেন-
“রাষ্ট্রের দায়িত্ব শুধু প্রশাসন চালানোই নয়, জাতিকে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন করে তোলাও রাষ্ট্রের এক বৃহত্তর দায়িত্ব। যে রাষ্ট্র হাতপাতা আর চাটুকারিতাকে প্রশ্রয় দেয়, সে রাষ্ট্র কিছুতেই আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নাগরিক সৃষ্টি করতে পারে না। তাই মানব কল্যাণ অর্থে আমি দয়া বা করুণার বশবর্তী হয়ে দান-খয়রাতকে মনে করি না। মনুষ্যত্বেও অবমাননা যে ক্রিয়াকর্মেও অবশ্যম্ভাবী পরিণতি তাকে কিছুতেই মানবকল্যাণ নামে অভিহিত করা যায় না।”
অধ্যাপক আবুল ফজল বাংলাদেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিক। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি একাধারে শিক্ষাবিদ, সুযোগ্য অধ্যাপক, চিন্তাবিদ, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, গল্পকার এবং একজন রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তি। আবুল ফজল ১৯০৩ সালের ১ জুলাই চট্টগ্রামের সাতকানিয়াউপজেলার কেঁওচিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মৌলভী ফজলুর রহমান এবং মা গুলশান আরার একমাত্র পুত্র সন্তান। প্রাথমিক পড়ালেখা শুরু হয় গ্রামের প্রাইমারি স্কুল থেকে। প্রকৃতির প্রত্যক্ষ সান্নিধ্যে তার শৈশবের দিনগুলো অতিবাহিত হয়েছে। তাই তার স্মৃতি কথায় তিনি লিখেছেন-
“আমাদের ছেলেবেলা বেশ কিছুটা বেপরোয়াভাবেই কেটেছে। বিশেষত যতদিন গ্রামে ছিলাম জীবনটা ছিল রীতিমতো উদ্দাম। … একটু বড় হয়ে দূর দূর গ্রামেও চলে যেতাম যাত্রা কি কবি গান শুনতে … চাঁদনিরাতে ছেলেরা ‘বদর’ দিয়ে উঠলে কিছুতেই ঘরে স্থির থাকতে পারতাম না।”
গ্রাম থেকে বাবার সঙ্গে চট্টগ্রাম শহরে এসে নন্দনকাননে এক হাইস্কুল সংলগ্ন প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হই। ১৯১৩/১৪ সালে আবুল ফজল চট্টগ্রাম সরকারি মাদ্রাসায় দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯২৩ সালে তিনি মেট্রিক পাস করেন। ১৯২৫ সালে ঢাকা ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ১৯২৮ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে বিএ পাস করেন। ১৯৪০ সালে কলকাতা বিশ^বিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেন। শিক্ষকতাকে জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করে তিনি তার কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৩১ সালে বিটি পাস করে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের দ্বিতীয় মৌলভী হিসেবে কিছুদিন চাকরি করেন। চট্টগ্রাম কলেজ আলী হাইস্কুলে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে কাজ করার পর ১৯৩৩ সালে খুলনা জেলা স্কুলে দ্বিতীয় পণ্ডিতের পদে স্থায়ীভাবে যোগদান করেন। 
১৯৩৭ সালে খুলনা ছেড়ে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে সহকারী ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৪১ সালে কৃষ্ণনগর কলেজের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৪৩ সালে যোগ দেন চট্টগ্রাম কলেজে। ১৯৫৯ সালে তিনি চাকরি থেকে অবসর নেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। তিনি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের উপদেষ্টা পরিষদের শিক্ষা বিষয়ক বিষয়ে দায়িত্ব পালন করেন।
অধ্যাপক আবুল ফজল শিক্ষকতার সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্য চর্চা করে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। তিনি সমাজ ও সমকাল সচেতন সাহিত্যিক এবং প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী হিসেবে সমধিক খ্যাত। ছাত্রজীবনেই যুক্ত হন মুক্তবুদ্ধিরআন্দোলন, অন্যদের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেন মুসলিম সাহিত্য সমাজ। কথা শিল্পী হিসেবে পরিচিতি আইন করলেও তিনি ছিলেন মূলত চিন্তাশীল প্রাবন্ধিক। তার প্রবন্ধে সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে গভীর ও স্বচ্ছ দৃষ্টির পরিচয় বিধৃত। আধুনিক অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধ, স্বদেশ ও ঐতিহ্যপ্রীতি, মাবনতা ও শুভবোধ তার সাহিত্যকর্মেও মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।
আবুল ফজল সাহিত্যের গভীরতা, চিন্তা, ভাবনা ও ইচ্ছা বুঝতে হলে তার সাহিত্য চর্চা করতে হবে। তার লেখা ‘মানবতন্ত্র (১৯৭২) গ্রন্থে কিছু অংশ তার চিন্তা গভীরতার পরিচয় বহন করে। তাই নিচে কিছু অংশ উল্লেখ করলাম। তিনি বলেন-
“আমাদের বিশাল মুক্তবুদ্ধির সহায়তায় সুপরিকল্পিত পথেই কল্যাণময় পৃথিবী রচনা সম্ভব। একমাত্র মুক্ত বিচারবুদ্ধির সাহায্যেই বিজ্ঞানের অভাবনীয় আবিষ্কারকে ধ্বংসের পরিবর্তে মানব কল্যাণ হয়ে উঠবে মানব মর্যাদার সহায়ক।”
আবুল ফজল মুসলিম সাহিত্য সমাজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি ‘শিক্ষা’ নামক একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। বাংলা সাহিত্যে অধ্যাপক আবুল ফজল এক বিশেষ স্থান দখল করে গিয়েছেন। সাহিত্য চর্চায় তার সৃষ্টি গ্রন্থসমূহ হচ্ছে :

রোজনামচা,
জীবন পথের যাত্রী,
রাঙ্গা প্রভাত (১৩৬৪),
চৌচির (১৯৩৪),
মাটির পৃথিবী (১৩৪৭),
আয়শা,
আবুল ফজলের শ্রেষ্ঠ গল্প,
সাহিত্য সংস্কৃতি ও জীবন,
সমাজ সাহিত্য রাষ্ট্র,
শুভবুদ্ধি (১৯৭৪),
সমকালীন চিন্তা,
রেখাচিত্র,
সফরনামা,
দুর্দিনের দিনলিপি,
প্রদীপ ও পতঙ্গ,
মানবতন্ত্র,
রবীন্দ্রনাথ,
জীবন পথের যাত্রী,
দিনলিপি, রাঙা প্রভাত, আলোক লতা,
অধ্যাপক আবুল ফজল ছিলেন অত্যন্ত রাজনৈতিক সচেতন সাহিত্যসেবী। তিনি রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে কোনো অন্যায়, অনাচার, দুর্নীতি ঘটলে নীরব থাকতেন না। নিবন্ধ লিখে, বিবৃতি দিয়ে তিনি সব সময় তার প্রতিবাদ করে গিয়েছেন। এজন্য তাকে ‘জাতির বিবেক’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। তিনি ছিলেন সর্বপ্রকার কুসংস্কার, কুপমন্ডুকতা, গোঁড়ামি আর ধর্মান্ধতার বিরোধী।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টজাতির জনককে হত্যার সঙ্গে সঙ্গেসাত বছরের শিশু রাসেলকে হত্যা করা হয়েছিল, তিনি তখন একটা গল্প ‘মৃতের আত্মা’ লিখে ও পত্রিকায় ছাপিয়ে এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। তিনি সব সময় জাতির ক্রান্তিলগ্নে দিকনির্দেশনা দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে গিয়েছেন।
৭১-এর শহীদ অধ্যাপক কামাল পাশা ‘কথাশিল্পী আবুল ফজল’ নামে একটি বই রচনা করে তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন।
সাহিত্য সাধনায় অফুরন্ত অবদানের জন্য ২০১২ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ প্রদান করা হয়। তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬২), প্রেসিডেন্ট প্রাইড অব পারফরম্যান্স সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৩), আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬০), নাছিরুদ্দীন স্বর্ণ পদক (১৯৮০), মুক্তধারা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮১), আব্দুল হাই সাহিত্য পদক (১৯৮২), রাষ্ট্রীয় সাহিত্য পুরস্কার এবং সমকাল পুরস্কার লাভ করেছেন।
জাতির এই বিবেক অধ্যাপক আবুল ফজল ১৯৮৩ সালের ৪ মে ৮০ বছর বয়সে ধরণী থেকে বিদায় গ্রহণ করেন।

No comments

Thank you, best of luck

Theme images by sbayram. Powered by Blogger.