ads

বন্ধ করে দেওয়া এক অধ্যায়

হেলাল হাফিজ
......…...….................................................................
'হাইড্রোজেনে দুইটি জোকার নষ্ট হওয়ার কষ্ট আছে/কষ্ট নেবে কষ্ট।'- যদি প্রশ্ন আসে, ফেরীঅলা কবিতার এই পঙ্‌ক্তি কীভাবে এলো? বলব, এসেছে আমার যাপিত জীবন থেকে। আরও স্পষ্ট করে বললে, জুয়ার টেবিল থেকে। আমার যত কবিতা তার সবই জীবনাশ্রিত অভিজ্ঞতা থেকে অনুসৃত। তাস খেলা- সেও ফেলে আসা জীবনের বন্ধ করে দেওয়া এক অধ্যায়।
আমি ভালোভাবে কার্ড চিনেছি ১৯৭৪ সালে এসে। এর আগে কার্ড চিনলেও কোনো খেলাই ভালোভাবে জানতাম না। এই খেলা শেখা সেও এক মজার ব্যাপার।
১৯৭২ সালে সাহিত্য বিভাগের দায়িত্ব নিয়ে যখন দৈনিক পূর্বদেশে যোগ দিই, তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। থাকতাম সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে। সেই সময় দৈনিক বাংলা এবং দৈনিক পূর্বদেশ- এ দুটিই ছিল সবচেয়ে বড় দৈনিক। পাশাপাশি ইত্তেফাক, সংবাদ এইগুলিও ছিল। আমি যেহেতু সাংবাদিকতাই করতে চেয়েছি, কাজেই বেশ আনন্দ নিয়েই কাজটা করছিলাম। ১৯৭৪ সালে দেশে একটা বড় রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটে বাকশাল গঠনের মধ্য দিয়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই সেটা করেন। পরিবর্তিত সেই অবস্থায় দৈনিক বাংলা, ইত্তেফাক, অবজারভার ও টাইমস- এই চারটি পত্রিকা রেখে বাকি সব দৈনিক বন্ধ করে দেওয়া হয়। পত্রিকা বন্ধ হলেও সেই সময় নিউজপেপার ম্যানেজমেন্ট বোর্ড গঠন করে সাংবাদিক থেকে কর্মী- সংবাদপত্রের সবাইকে তার যোগ্যতা অনুসারে চাকরির ব্যবস্থা করা হয়। প্রক্রিয়া চলাকালে সরকার সেই বোর্ডের মাধ্যমে সবাইকে বসে বসে বেতন দিয়েছে। আমিও এক বছর বসে থেকেই বেতন পেয়েছি। এরপর আমার চাকরি হয় তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে। যেহেতু আগে থেকেই সিদ্ধান্ত ছিল আমি সরকারি চাকরি করব না, তাই তাদের দেওয়া চাকরি আমি প্রত্যাখ্যান করি। সরকারেরও আমাকে নিয়ে আর কোনো দায় থাকে না। কিন্তু ঘটনা যেটা ঘটল, আমি বেকার হয়ে পড়লাম।
এই বেকারত্বের দিনগুলোতে প্রেস ক্লাবের কার্ডরুমে আমার যাতায়াত শুরু হয়। আগেও মাঝেমধ্যে যেতাম। অন্যদের খেলা দেখেছি, নিজে কখনও খেলতাম না। কিন্তু বেকারত্বের অখণ্ড অবসরে মূলত সময় কাটানোর উদ্দেশ্যেই আমার খেলা শুরু হলো।
আমাদের কার্ডরুম তখন রীতিমতো সেলিব্রেটিতে ভরপুর থাকত। প্রেস ক্লাব তখন সাংবাদিক ছাড়াও সংস্কৃতি অঙ্গনের বড় বড় ব্যক্তিত্ব, বড় ব্যবসায়ী- এ রকম বিভিন্ন পেশার মানুষকে অনারারি মেম্বারশিপ দিত। তারাও ক্লাবে তাস খেলতে আসতেন। সাঁতারু ব্রজেন দাস, সংগীত পরিচালক সমর দাস, গায়ক মাহমুদুন্নবী, রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী জাহেদুর রহিম- এ রকম তারকারা আসতেন। কবিদের মধ্যে আসাদ চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুণ; আর আমি তো ছিলামই। সাংবাদিকদের মধ্যে যারা আসতেন তারাও কম বড় তারকা ছিলেন না- অবজারভারের সম্পাদক ও বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা মহাপরিচালক আবদুস সালাম, এনায়েতুল্লাহ খান, এ বি এম মূসা, এম আর আখতার মুকুল- তাদের পদচারণায় কার্ডরুমে যেন আলোর ফোয়ারা ঝরত। আনন্দময় এক স্থান হয়ে উঠত প্রেস ক্লাবের কার্ডরুম। তারা অধিকাংশই অবশ্য ব্রিজ খেলতেন। সময় কাটানো বা বিনোদনই ছিল মুখ্য। টাকা দিয়ে তারা খেলতেন না। ব্রজেন দাস যখন ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিলেন, দুই ঘণ্টা ক্লাস হয়ে আমাদের স্কুল ছুটি হয়ে গিয়েছিল। সেই ব্রজেন দাসকে আমি কার্ডরুমে পেলাম। বয়সে ছোট হওয়ায় আমাকে অনেক স্নেহও করতেন। তাদের মতো মানুষের সঙ্গ পাওয়াও ছিল অনেক আনন্দের।
তবে কার্ডের টেবিলে আমার বিষয়টা ছিল ভিন্ন। চাকরির তিন বছরের মাথায় যেহেতু বেকার, বাড়ির সঙ্গে তেমন যোগাযোগ ছিল না, কাজেই টাকার প্রয়োজন ছিল। সেই প্রয়োজন মেটাতেই বেশিরভাগ সময় হাইড্রোজেন খেলতাম। খেলা শুরু করে দেখি ভাগ্যও অসম্ভব সহযোগিতা করছে। এতে করে কার্ড খেলাটা আমার কাছে নিছক সময় কাটানো বা বিনোদনের বিষয় আর থাকল না; হয়ে উঠল জীবিকা নির্বাহের পথ। মজার বিষয়, পূর্বদেশে আমি যা বেতন পেতাম তার তিন-চারগুণ বেশি মাসিক আয় হতো এই গ্যাম্বলিংয়ে।
এতে করে জীবনযাত্রাও পাল্টে গেল। আগে একটু কমদামি সিগারেট খেতাম, তখন বেনসন খাওয়া শুরু হলো। এক প্যাকেট সিগারেট গিয়ে পৌঁছল তিন প্যাকেটে। আগে কমদামি পানীয় পান করলেও, সে সময় শেরাটন, সাকুরা ছাড়া বসতামই না। যদিও বন্ধুরাই বেশিরভাগ সময় বিল দিত কিন্তু ভদ্রতা করে হলেও তো মাঝেমধ্যে আমাকে দিতে হতো। অন্যকে খাওয়াতে হতো। সেই বিল অনায়াসে দেওয়ার ক্ষমতা আমার হয়ে যায়।
আমার প্রথম বই 'যে জলে আগুন জ্বলে' প্রকাশ পায় ১৯৮৬ সালে। কিন্তু নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়সহ কিছু কবিতা তখন এতই জনপ্রিয় হয় যে, বই ছাড়াই সাহিত্যাঙ্গন এবং পাঠকের কাছে আমি বেশ পরিচিতি পেয়ে যাই। ক্লাবে ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে থেকে আমার অতিথি নিয়মিতই আসতেন। তাদের সবার জানা হয়ে গিয়েছিল হেলাল হাফিজকে পাওয়া যায় প্রেস ক্লাবের কার্ডরুমে। তাদের কাছে ওটাই আমার ঠিকানা। তারা এলে কার্ডরুমের পাশেই একটা ছোট রুম ছিল, সেখানে বসার ব্যবস্থা করতাম। ক্লাবের সদস্য কম ছিল, তাই এখনকার মতো এত নিয়মকানুনও করতে হয়নি। ওপরে গেস্টরুম থাকলেও অতিথিদের নিয়ে সদস্যরা নিচের ক্যান্টিনে বসেই খেতে পারতেন। সে সময় আমার কাব্যানুরাগীর সংখ্যা একটু বেশিই ছিল এবং তারা নিয়মিতই আসতেন। এদের নিয়ে একটু মুশকিলে পড়লাম- গ্যাম্বলিংয়ের টেবিল থেকে তো ঘন ঘন ওঠা যায় না। তাই মেহমান যারা আসতেন তাদের যত্ন, আপ্যায়নের জন্য ক্লাবের এ বেয়ারাকে আলাদাভাবে টাকা দিতাম। খেলার ফাঁকে আমি উঠে যেয়ে একটু হাই-হ্যালো করে আসতাম। এতে তারা হয়তো মন খারাপ করত কিন্তু আমি তো নিরুপায়। কেউ হয়তো আমাকে নিতে এসেছেন। আমি যেতে পারছি না। তারা মন খারাপ করত। খুব প্রিয় কেউ হলে তো যেতেই হতো বা ক্লাবেই সঙ্গ দিতে হতো। কেউ হয়তো কষ্ট পেয়ে আমাকে ত্যাগই করেছে। সে কষ্ট পেয়েছে, আমিও বেদানাক্রান্ত হয়েছি।
এর মধ্যেই একটা ঘটনা ঘটে। সমাজে কিছু উচ্চবিত্ত বা বিত্তশালী নারী থাকেন, যারা সেলিব্রিটিদের সঙ্গ উপভোগ করেন। খেলোয়াড়, কবি বা গায়ক বিভিন্ন অঙ্গনের সেলিব্রেটি হতে পারেন। প্রেস ক্লাবের কার্ডরুমে আসতেন, এমন একজনের মাধ্যমে এমন এক নারীর সঙ্গেও আমার পরিচয় হয়। জানা হয় সেই অজানা জগৎ সম্পর্কে। কার্ডরুমে না ঢুকলে সমাজের এই বিষয়টা সম্পর্কে আমার হয়তো জানাই হতো না।
এই সময় আমার কবি হিসেবে যেমন খ্যাতি ছিল, ঠিক একইভাবে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে গ্যাম্বলার হিসেবেও- 'দারুণ জুয়াড়ি, যিনি কখনও হারেন না। হারলেও কদাচিৎ।' এমন একটা বিষয়। গ্যাম্বলিংয়ের সবচেয়ে বড় বিষয় মেজাজ ধরে রাখা। মেজাজ হারালেই হারতে হবে। সেই সঙ্গে লোভটাকেও সামলে রাখতে হবে। এটা অনেকটা শেয়ার বাজারের মতো- লোভ সামলাতে না পারলে মুহূর্তেই সব শেষ। কার্ডরুমেও তাই লোভ সংবরণ করতে হয়।
এভাবে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত আমি ছিলাম পূর্ণ জুয়ার ঘোরে। এই পাঁচ বছর গ্যাম্বলিংই ছিল আমার নেশা এবং জীবিকার পথ। ১৯৭৯ সালের মাঝামাঝি দৈনিক দেশ থেকে আমাকে সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে যোগ দিতে বললে এবং আমি যোগ দিলাম। দৈনিক দেশের অফিস প্রথমে পুরানা পল্টন ছিল, পরে চলে আসে সেগুনবাগিচা। যেখানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ছিল। প্রেস ক্লাবের ঠিক উল্টো দিকে হওয়ায় আমার জন্য খুব সুবিধার হলো- চাকরি, তাস খেলা, সব একাকার।
দৈনিক দেশে যোগ দেওয়ার তাস খেলাটা আর মুখ্য রইল না। জুয়ার টেবিল থেকে ধীরে ধীরে সাহিত্য সম্পাদকের টেবিলে মনোনিবেশ করলাম। ওখানে খুব পরিশ্রম করতে হয়েছে। বিএনপি, জিয়াউর রহমান, আর্মি ইত্যাদির সঙ্গে সংযুক্ততার কারণে প্রগতিশীল কোনো লেখক দৈনিক দেশে লিখতে চাইতেন না। আমি কোনো রাজনৈতিক দল হিসেবে নয়, পেশাজীবী হিসেবেই চাকরিটা করি। ফলে প্রচুর খাটতে হতো। সে সময় সাপ্তাহিক ছুটি ছিল রোববার। সাহিত্য পাতাও বেরোত রোববারে। আমি যোগ দিয়ে দৈনিক দেশের সাহিত্য পাতাসহ সাপ্তাহিক সাপ্লিমেন্টগুলোর চেহারা একদম পাল্টে দিয়েছিলাম। ফয়েজ আহমদ, ওয়াহিদুল হক, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, আসাদ চৌধুরীসহ সে সময়ের প্রগতিশীল প্রায় সব লেখকই দৈনিক দেশে লিখেছেন। আমার মনে আছে একবার সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আমাকে বললেন, 'তুমি তো একেবারে সংবাদকেও ছাড়িয়ে গিয়েছ'। এটা আমাকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। আমি পূর্বদেশ এবং দেশ দুই জায়গাতেই চেষ্টা করেছি তরুণ লেখক-সাহিত্যিকদের লেখা একটু বেশি করে ছাপাতে। তখন তো এই প্রযুক্তির যুগ আসেনি। মোবাইল নেই, ইন্টারনেট নেই। যোগাযোগে চিঠিই একমাত্র ভরসা। সপ্তাহে একটা দিন দুই-আড়াই ঘণ্টা সময় রাখতাম লেখকদের কাছে চিঠি লেখার জন্য। তাদের লেখা প্রাপ্তি, মতামত ইত্যাদি লিখে পাঠাতাম। এটা আমি শিখেছিলাম, দৈনিক বাংলার সাহিত্য সম্পাদক কবি আহসান হাবীবের কাছ থেকে। তিনি সপ্তাহে একদিন লেখকদের কাছে চিঠি লিখতেন। তরুণ, নবীন লেখকরা এতে যে কী খুশি হতেন! চিঠিগুলো মফস্বলের তরুণ ছেলেমেয়েদের খুব উৎসাহিত করত।
দৈনিক দেশে চাকরি করা অবস্থায় জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনাটি ঘটল। ১৯৮৬ সাল, প্রকাশ পেল আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'যে জলে আগুন জ্বলে'। এই বই তিন বছর আগেই ছাপা হয়েছিল। কবি আবু হাসান শাহরিয়ার বইটা প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। 'কার কী নষ্ট করেছিলাম' নামে কভারও ছাপা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু নামটা আমার মনঃপূত না হওয়ায় শেষ মুহূর্তে এসে বইটা প্রকাশ না করার সিদ্ধান্ত নিই। আমার কবিতার বিষয় প্রেম, দ্রোহ, বিরহ, বেদনা- ওই নামটাতে ঠিক আসছিল না। তাই শাহরিয়ারকে বলি, ভাই কিছু মনে কর না। আমি এই নামে বই করব না, কিন্তু মনঃপূত নামও পাচ্ছি না। ওর সেই উদ্যোগ ওখানেই বন্ধ হয়ে যায়।
তখন চাকরির পাশাপাশি আমার একমাত্র নেশা হলো বইয়ের নাম খোঁজা। বইয়ের সব কবিতার চরিত্র একসঙ্গে ধরতে পারে কিছুতেই সে রকম নাম পাচ্ছিলাম না। খুঁজছি আর খুঁজছি। সেদিন আমি ছিলাম বড় ভাইয়ের বাসায়। ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেল। ওয়াশরুমে যেয়ে টুথব্রাশে পেস্ট নিয়ে দাঁত মাজব। ঠিক ওই সময় হঠাৎ বাক্যটা চলে এলো- 'যে জলে আগুন জ্বলে'। আমি চিৎকার দিয়ে উঠেছিলাম। প্রাসঙ্গিক কোনো ভাবনা ছাড়াই ওহি নাজিল হওয়ার মতো করে বাক্যটা যেন নাজিল হয়েছিল আমার ওপর। দ্রুত মুখ ধুয়ে ঘরে এলাম। আনন্দ, উৎকণ্ঠায় মনে হলো জ্ঞান হারাচ্ছি। আমার সমস্ত প্রতীক্ষা সার্থক। এত দ্যোতনা, এত ব্যঞ্জনাময় একটা নাম পেলাম! আমার সমস্ত গা শিহরিত হয়ে উঠল। জল যদি বেদনা, কান্না, বিরহের প্রতীক হয়, তাহলে দ্রোহের প্রতীক আগুন। কিন্তু যে জলে আগুন নেভানোর কথা, সেই জল দিয়ে আমি আগুন জ্বালাতে চেয়েছি। বইটা বের হওয়ার পর অন্তত দুই হাজার মানুষের কাছে প্রশ্নটা পেয়েছি, নামটা আপনি কোথায় পেলেন? এই নামে কী বোঝাতে চেয়েছেন? আমি তো যা চাওয়ার তা পেয়েছি।
নাম তো পেলাম। কিন্তু লজ্জায় শাহরিয়ারকে আর বই প্রকাশের কথা বলিনি। চুপচাপ আছি। প্রেস ক্লাব আর আমার অফিস যেহেতু রাস্তার এপার-ওপার, কিছুক্ষণ কাজ করে ক্লাবে চলে আসি, আড্ডা দিই, ভাত খাই, আবার অফিসে যাই এভাবেই চলছিল। এক শনিবারের বিকেল। সেদিন আমার পেজ পেকআপের দিন। পরদিন সাহিত্য পাতা বেরোবে। শামসুদ্দিন নামে এক শিল্পী ছিলেন, তাকে লেখার ইলাস্ট্রেশন, হেডিং ইত্যাদি বুঝিয়ে দিয়ে ক্লাবে এসে দুপুরের ভাত খেয়ে কার্ডরুমে বসেছি। যেহেতু পেজ মেকআপ আছে তাই বেরোব বেরোব করছি। এই সময় হুমায়ূন আহমেদ, নির্মলেন্দু গুণ আর সালেহ চৌধুরী কার্ডরুমে ঢুকলেন। তারা আমাকে চেপে ধরলেন, অনিন্দ্য প্রকাশনী তোর একটা কবিতার বই প্রকাশ করতে চায়, তুই বই দে। প্রকাশনীর মালিক নাজমুল হককে আমি ভালোভাবেই চিনতাম। পাণ্ডুলিপি যেহেতু তৈরিই ছিল, ওটা তাদের হতে দিয়ে দিলাম। চট্টগ্রামের শিল্পী খালেদ আহসান অসাধারণ একটা প্রচ্ছদ করলেন। সংবাদের তৎকালীন সাহিত্য সম্পাদক আবুল হাসনাত একটা লেখাই লিখে ফেললেন সে বছর বইমেলার বইয়ের প্রচ্ছদের ওপর।
বের হলো 'যে জলে আগুন জ্বলে'- এর পরের ইতিহাস সবারই তা জানা। সেই বছর অনিন্দ্য প্রকাশনী শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ ও আমার 'যে জলে আগুন জ্বলে' বের করেছিল। যে জলে আগুন জ্বলে শুধু ওই বছর নয়, পরের কয়েক বছর বেস্ট সেলার ছিল।
চাকরির চাপ আর বই প্রকাশের পর আমার ভেতরে যে প্রশান্তি কাজ করেছিল সেটা আমাকে গ্যাম্বলিং, মদ্য এবং সিগারেটের নেশা থেকে বের করে নিয়ে আসতে সহযোগিতা করেছে। এর মধ্যে স্বাস্থ্যগত নানা সমস্যা দেখা দিল। আস্তে আস্তে পানাহার কমল, সিগারেট কমল, কিন্তু একেবারে ছাড়তে পারছিলাম না কোনোটাই। বহু চেষ্টা করে মদ্যপান ছাড়লেও সিগারেটটা ছাড়তে কষ্ট হচ্ছিল। ক্লাস এইট থেকে যে নেশার অভ্যাস, সেটা কি সহজে ছাড়া যায়। তখন একজন আমাকে পরামর্শ দিলেন, তামাক পাতা চুন দিয়ে খৈনি বানিয়ে খান। দেখবেন সিগারেটের নেশা কেটে যাবে। আমি সেটাই শুরু করলাম। এইসব করে অনেক কষ্টে সিগারেট ছাড়ি, আবার ধরি। ১৯৯৮ বা ২০০০ সালের দিকে তৃতীয়বার যখন ছাড়লাম সেটাই শেষ ছাড়া। আর কার্ডরুম ছেড়েছি তার আগেই।
তবে, এখনও ক্লাবে গেলে একবার না একবার কার্ডরুমে ঢুকি। খেলি না, দেখতেই যাই। অনেক পরিবর্তন হয়েছে। স্ট্রাকচারাল পরিবর্তন এসেছে, পরিবেশগতও। মানুষগুলোও সেই আগের মানুষ নেই। পরিণত এই বয়সে এসেও মিস করি সেই দিনগুলি। তবে বন্ধ করে আসা সেই অধ্যায় খুলতে চাই না আর।

ছবি: সংগৃহীত



2 comments:

  1. This comment has been removed by a blog administrator.

    ReplyDelete
  2. This comment has been removed by a blog administrator.

    ReplyDelete

Thank you, best of luck

Theme images by sbayram. Powered by Blogger.