ads

প্রশ্নটা ছিল, " তাজমহল কে তৈরি করেন? " কাসেম উত্তর লিখেছিলো, " মার্বেল মিস্ত্রিরা"

পরীক্ষার খাতা দেখতে দেখতে চমকে উঠলেন শামীম সাহেব। অষ্টম শ্রেণির ইতিহাস পরীক্ষার খাতা। এটা কি উত্তর! প্রথমে এক চোট হাসলেন, তারপর রাগ হলো এত কষ্ট করে ইতিহাস পড়ানোর এই রেজাল্ট! লাল কালির পেনটা দিয়ে লাইনটা কেটে একটা বড় করে শূন্য বসিয়ে দিলো শামীম সাহেব। হোপলেস! কিস্যু হবে না। খাতা ঘুরিয়ে নামটা দেখলন কাসেম।
ওদিকে আবার দেরি হয়ে যাচ্ছে স্কুলের, বাকি খাতাগুলো স্কুল থেকে এসে দেখতে হবে আার দেরি করলে ট্রেনটা মিস হয়ে যাবে। খাতার বান্ডিলটা বেধে প্ল্যাস্টিকের প্যাকেটে মুড়ে তাকের উপর রেখে স্কুলে যাওয়ার জন্য উঠলেন শামীম সাহেব।
ছবি : সংগৃহীত 

শামীম সাহেব উত্তর চব্বিশ পরগণার অজ পাড়া গ্রামের একটি স্কুলের ইতিহাসের শিক্ষক।ছাত্রদের পড়ানোর ব্যাপারে কোন ত্রুটির কথা বলে সবচেয়ে বড় শত্রুও শামীমের সাহেবের দিকে আঙুল তুলতে পারবে না। প্রায় পঁচানব্বই ভাগ ছাএই খুব গরীব পরিবারের। কারো বাবা ভ্যান টানে, কেউ বা দিন মজুরের কাজ করে, কেউ বা ইট ভাটার শ্রমিকের কাজ করে, ছাএদের মধ্যে অনেকে স্কুল থেকে ফিরে, কেউ বা স্কুল কামাই করে বিভিন্ন কাজ কিছু পয়সা রোজগারের জন্য। তার মধ্যেও শামীম সাহেব স্বপ্ন দেখেন তার ছাএদের নিয়ে। নিজের পকেট থেকে বই পএ কিনে দেন। নিজের খরচেই আঁকা প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। স্কুলছট ছাএদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বুঝিয়ে আবার স্কুলে ফেরত আনেন। তিনি তো কেবল স্কুলের ইতিহাস শিক্ষক নন, একই সাথে প্রধান শিক্ষক।
টিফিনের পর অষ্টম শ্রেণির ক্রমশ ছিলো শামীম সাহেবের। ক্লাসে ঢোকার সময়ই মনে পড়ে গেলো সকালের খাতা দেখার কথা, হ্যাঁ ছেলেটার নাম আছে কাসেম। মনে থাকবে না! ছিঃ ছিঃ কি উত্তর, এতোদিন ইতিহাস পড়ানোর ফল তার। ছেলেটিকে চিনেন শামীম সাহেব? কালো করে, মাথায় ঝাকড়া চুল, কান দুটো একটু খাড়া খাড়া।
ক্লাসে ঢুকেই চক,ডাষ্টার রেখে চেয়ারে বসেই বললেন, "কাসেম কোথায়? এসেছে আজ? " বাকি ছাএরা সমস্বরে উত্তর দিল "না স্যার।" শামীম সাহেব মনে মনেই বললেন, "এদের দিয়ে কিস্যু হবে না, আমারই পন্ডশ্রম। "
তারপর ৫ দিন কেটে গেলো, কাশেম স্কুলে আসছে না। টিচার্স রুমে এসে শামীম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, "আপনারা কেউ ক্লাস ৮ এর কাসেমের ব্যাপারে জানেন ১০ দিন হয়ে গেল আসছে না।" অঙ্কের দীলিপ বাবু মোবাইল খুট খুট করতে বললেন, "দ্যাখেন স্কুল টুল ছেড়ে কোথাও কাজে ঢুকলো হয়তো, ওই বাস স্ট্যান্ডের ওখানে মফিজুলের চায়ের দোকান ও যেন কি একটা হয় কাশেমের, গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসুন। "
ছুটির পর স্কুল থেকে বেড়িয়ে সটান মফিজের চায়ের দোকানে হাজির হলেন শামীম সাহেব।
আর আসেন আসেন মাস্টার মশাই, বুসেন---না গো আমি চা খেতে আসিনি। পরে একদিন আসব, বলছি তুমি কাসেমকে চিন? আমাদের স্কুলে পড়ে, দিন দশেক হলো আসছে না। কি হয়েছে কিছু ---আরে আর বইলেন না, মাস্টার মশাই, ওর বাপ পাথর খাদনে কাজ করত, ফিরেছে কি সব রোগ নিয়ে সিলিকুসিস নাকি যেন একটা, আর বেশি দিন মনে হয় বাঁচবে না----
কথাটা শুনে যেন ধাক্কা লাগলো শামীম সাহেবের, অতটুকু একটা ছেলে, এবার পড়বে ও কি করে? আসার পথে ট্রেন বেশ ফাঁকা ছিল। শামীম সাহেবের মন খচ খচ করছে, কি এমন রোগ যে বাঁচবে না কাসেমের বাবা।
স্মার্ট ফোনটা খুলে শামীম সাহেব সার্চ করলেন, সিলিকুসিস, সার্চ রেজাল্টে আসলো সিলিকোসিসকে বলা যেতে পারে শ্রমঘটিত রোগ, যারা পাথর খাদানে পাথর ভাঙার কাজ করেন তাদের ফুসফুসে দীর্ঘ দিন ধরে সিলিকা জমতে জমতে এই রোগ হয়। শুধু মাএ ভারত বর্ষে এই রোগে ৫০ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত! কোনো রকম সুরক্ষা ব্যবস্হা ছাড়াই অল্প মুজুরিতে বেশি লাভ করার জন্য খাদানের মালিকরা নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় পড়াশোনা না জানা গ্রামের সরল মানুষদের।
শামীম সাহেব তাকিয়ে রইলেন বাড়ির দেওয়ালের দিকে, এই ইমারত,রাস্তা, ব্রিজ তৈরি হচ্ছে, তৈরি হয়ে এসেছে শ্রমিকদের রক্ত, ঘাম আর প্রাণের বিনিময়ে। এক মাস আগে ক্লাস ৫ এর প্রশান্তের বাবা মুম্বাইয়ের বহু তলে কাজ করতে গিয়ে পড়ে মারা যায়, অথচ এ যেন সাধারণ মৃত্যু, কেউ সাজা পাবে না, কেউ এদের হয়ে কথা বলবে না, লিখবে না। চোখের সামনে যেন দেখতে পেলেন একদল মানুষকে, হাড় সর্বস্ব, ধুঁকছে, ক্রমাগত কেশে চলছে তবু্ও একটা বিরাট পাথর বয়ে নিয়ে চলছে। কারর পক্ষাঘাত, কেউ দৃষ্টি হারিয়েছে, কারর হাত নেই, পা নেই, তাদের পিষে দিয়ে ছুটে চলছে অত্যাধুনিক গাড়ি, মাথা তুলছে শপিং মল---
শামীম সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। তাক থেকে লাল পেনটা নিলেন, নীচ থেকে পরীক্ষার খাতার বান্ডিলটা বের করলেন। হ্যাঁ এই তো রোল নং-২৩ কাসেম ১ এর 'ছ' নব্বর কোশ্চনের উত্তর। ৫ দিন আগে কাসেমের এ উত্তরটাই প্রচণ্ড রাগ করে কেটে দিয়েছিলেন শামীম সাহেব। আসলে তিনি উওরটা ভুল শিখেছেন, বরং বলা ভালো ভুল শেখান হয়েছে। দেশের কোটি কোটি ছাএকে যেভাবে ভুল শেখান হয়। শামীম সাহেব নিজের দেওয়া ক্রস চিহ্নটাকে ভালো করে কাটলেন, তারপর বড় করে একটা রাইট দিলেন, পাশে ফুল মার্কস ১
প্রশ্নটা ছিলো, "তাজমহল কে তৈরি করেন? "
কাসম লিখেছিলো, "মার্বেল মিস্তিরা"
কিছু মানুষ হয়ত কিছু তৈরি করে টাকা লাগিয়ে শ্রমকে ক্রয় করে। তারপর শ্রমিককে ভুলে যায়।
কিন্তু কিছু মানুষ তাদের সমস্ত শ্রম দিয়ে একদিন মৃত্যু শষ্যায় পড়ে যায়। তবুও তার কোনো প্রসংশা হয় না, এটাই সমাজের নীতি, আমাদের নীতি ----
সংগৃহীত: 

No comments

Thank you, best of luck

Theme images by sbayram. Powered by Blogger.