ads

সমৃদ্ধিতে তথ্য-প্রযুক্তি

তৃণমূলে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) সেবা পৌঁছে দিয়ে কর্মসংস্থান বাড়ানোর মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে চায় সরকার। আর এ জন্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের উদ্যোগে দেশের সব ইউনিয়নে দ্রুতগতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পৌঁছানোর কাজ শেষ পর্যায়ে। ২০২০ সালের মধ্যে গ্রামের ১০ কোটি মানুষ ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের আওতায় আসবে। আর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে দুই কোটি মানুষের। এ ছাড়া ২০২১ সালের মধ্যে আইসিটি পণ্য ও সেবা রপ্তানি করে পাঁচ বিলিয়ন ডলার আয় হবে। তৈরি পোশাকের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত হিসেবে আবির্ভূত হবে তথ্য-প্রযুক্তি খাত। ফলে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ১ শতাংশের বেশি বাড়বে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
মোবাইলে আর্থিক সেবা, রাইড শেয়ারিং, ই-কমার্সসহ বেশ কিছু সরকারি সেবা এখন হাতের নাগালে। এ ছাড়া আগামী বছরের প্রথমার্ধে পঞ্চম প্রজন্মের মোবাইল সেবা (ফাইভজি) চালুর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বিগ ডাটা অ্যানালিসিস, ইন্টারনেট অব থিংকস, ব্লক চেইনের মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে পা রাখবে বাংলাদেশ। উচ্চগতির মোবাইল ইন্টারনেট কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শিল্প ও সেবা খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। এ জন্য সাশ্রয়ী দামে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সরবরাহ, তথ্য-প্রযুক্তি অবকাঠামোয় ধারাবাহিক বিনিয়োগ, দক্ষতা উন্নয়নে ব্যাপক কর্মসূচি এবং গ্রাম ও শহরের মধ্যে ডিজিটাল বৈষম্য কমাতে মতামত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, প্রতি এক হাজার নতুন ইন্টারনেট সংযোগ আটটি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। ১০ শতাংশ ব্রডব্যান্ডের বৃদ্ধি মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়াতে পারে। সেটি নিশ্চিত করতে তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে শ্রমনির্ভর অর্থনীতি থেকে জ্ঞাননির্ভর অর্থনীতিতে এগোচ্ছে বাংলাদেশ। 
“২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ঘোষণার পর জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আরো এক ধাপ এগিয়ে গেছে। আমাদের এক বছর পর ‘ডিজিটাল ব্রিটেন’ কর্মসূচি ঘোষণা করে ইংল্যান্ড। বাংলাদেশের ছয় বছর পর ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’ ঘোষণা করে ভারত। আর আমাদের সাত বছর পর ‘ডিজিটাল মালদ্বীপ’ ঘোষণা করে মালদ্বীপ, ১১ বছর পর ২০১৯ সালে ‘ডিজিটাল পাকিস্তান’ ঘোষণা করেছে পাকিস্তান।” সরকারের সেবাগুলোকে তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে দ্রুততা এবং জবাবদিহির মাধ্যমে জনগণের আরো কাছাকাছি নিয়ে আসাই ডিজিটাল বাংলাদেশের লক্ষ্য বলে জানালেন এই তথ্য-প্রযুক্তিবিদ। 
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহেমদ পলক বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইউনিয়ন পর্যন্ত ফাইবার অপটিক কেবল নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি পূরণে আমরা ইনফো সরকার-৩ প্রকল্প হাতে নিয়েছিলাম। যার মাধ্যমে প্রায় সব ইউনিয়নে ব্রডব্যান্ড সংযোগ পৌঁছে গেছে। এই উদ্যোগে ১০ কোটি মানুষকে কানেকটিভিটির আওতায় আনা হচ্ছে। এতে আউটসোর্সিংসহ অন্যান্য কাজে ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। এ ছাড়া জিডিপি বাড়বে ১ শতাংশ।’
দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষকেও ডিজিটাল উন্নয়ন স্পর্শ করেছে। তথ্য-প্রযুক্তির নানা সূচকে এগিয়েছে বাংলাদেশ। দেশে মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১০ কোটি। মোবাইল ফোন সাবসক্রাইবার ১৬ কোটি ৪১ লাখের বেশি। বিশ্বের ৬৭টি দেশে তথ্য-প্রযুক্তি খাতের বিভিন্ন পণ্য ও সেবা রপ্তানি হচ্ছে। এ খাতের রপ্তানি আয় ছাড়িয়ে গেছে এক বিলিয়ন ডলার (প্রায় সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা)। তবে ২০২১ সালের মধ্যে এ খাত থেকে পাঁচ বিলিয়ন ডলার আয় করতে চায় সরকার। এ জন্য দেশে ২৮টি সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক তৈরি করা হচ্ছে। এ ছাড়া হার্ডওয়্যার খাতে এরই মধ্যে দেশে স্মার্টফোন সংযোজন করছে ৯টি ব্র্যান্ড। প্রডাক্ট ইনোভেশন বাড়াতে ‘ওয়ান থাউজেন্ট প্রডাক্ট বাই ২০২১’ প্রকল্পের আওতায় বৈশ্বিক পর্যায়ে নেতৃত্ব দিতে পারে এমন বড় কম্পানি প্রতিষ্ঠায় সহায়তা দেবে আইসিটি বিভাগ। এ ছাড়া দেশের সফটওয়্যার সেবার বাজার দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশই দেশি সফটওয়্যার নির্মাতারা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন।
২০২১ সালের মধ্যে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং জিডিপিতে আইসিটি খাতের অবদান ১ শতাংশ বাড়বে বলে আশা করেন তথ্য-প্রযুক্তি বিভাগের সিনিয়র সচিব এন এম জিয়াউল আলম বলেন, ‘সফটওয়্যার এবং হার্ডওয়্যার উভয় খাতে আমরা এগিয়েছি। ফ্রিল্যান্সিংয়ে আমাদের আয় বেড়েছে। এখন আমাদের টার্গেট ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি ও সাইবার সিকিউরিটি।’
‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ব্লকচেইন, রোবটিক্সের মতো প্রযুক্তিগুলো নিয়ে কাজ করতে হলে আমাদের দক্ষ জনবলের বিকল্প নেই। এখন থেকে এগুলোকে পাঠ্যক্রমের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। দেশের তৃণমূল পর্যায়ে সুলভমূল্যে মানসম্মত ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পৌঁছে দিতে হবে। তাহলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছেলে-মেয়েরাও অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারবে। এ জন্য শহর ও গ্রামাঞ্চলের মধ্যে ডিজিটাল বৈষম্য কমাতে হবে। জিডিপিতে ১ শতাংশ অবদান বাড়াতে আমাদের স্থানীয় বাজার বড় করার চেষ্টা করছি। সরকারি-বেসরকারি খাতে অটোমেশনে উৎসাহিত করছি। এ ক্ষেত্রে সরকারকে আরো ভূমিকা রাখতে হবে।’
‘আইসিটিতে আমাদের দক্ষতা উন্নয়ন অত্যাবশ্যকীয় পূর্বশর্ত। ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচি নিয়ে রাজনৈতিক ও নীতিগতভাবে সরকার যতটা উদ্যোমী, বাস্তবায়ন পর্যায়ে ততটা প্রতিফলন ঘটেনি। সরকারি সেবাগুলো এখনো পুরোপুরি আইসিটি ওরিয়েন্টেড হয়ে উঠতে পারেনি। বেসরকারি খাতে যে পরিমাণ আইসিটি অবকাঠামো প্রয়োজন, তার জন্য বিভিন্ন প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে সত্য, কিন্তু বেসরকারি খাতে উদ্যোক্তা তৈরি, আইসিটিনির্ভর ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করতে আরো বেশি অগ্রাধিকার দরকার। আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের মানবসম্পদ মোটেও প্রস্তুত নয়।’
তবে এর মধ্যেও গত চার বছরে ডিজিটাল অর্থনীতিতে অগ্রগতি অর্জন করে ‘গ্লোবাল কানেক্টিভিটি ইনডেক্স ২০১৯’ এর ‘টপ মুভার’ তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশ। তালিকায় থাকা বাকি তিন দেশ হচ্ছে ইউক্রেন, দক্ষিণ আফ্রিকা ও আলজেরিয়া। ২০১৫ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ডিজিটাল অর্থনীতিতে বিশ্বের অগ্রগতি মূল্যায়ন করে সম্প্রতি এই তালিকা তৈরি করেছে হুয়াওয়ে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাঁচ বছরেরও কম সময়ে বৈশ্বিক সূচকে সাত পয়েন্ট এগিয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৫ সালের পর দেশটিতে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর হার ৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪১ শতাংশ হয়েছে। একই সময়ে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর হার ৭% থেকে বেড়ে হয়েছে ৩৪%। এ ছাড়া মোবাইল ফোন, আবাসস্থলে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগের ক্ষেত্রেও তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি সাধন করেছে বাংলাদেশ।
‘আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, বাইরে থেকে কাজ জোগাড় করা। আমাদের গার্মেন্ট খাতের সুবিধা ছিল। সেখানে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে বায়িং হাউস ছিল। কিন্তু আইসিটি খাতে বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং মধ্যস্থতাকারী সংগঠন নেই। ফলে আমাদের নিজেদের যোগাযোগ করে বিদেশ থেকে কাজ আনতে হবে। এটা চীন, ভারত, ফিলিপাইন পেরেছে। আমাদেরও পারতে হবে। কারিগরি শিক্ষাকেন্দ্রগুলোকে আরো দক্ষ করতে হবে।’
‘ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে এরই মধ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং সরকারি দপ্তরের ৭০০ বেশি সেবা ডিজিটাইজ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে এটুআই, আইসিটি বিভাগ, মন্ত্রণালয় এবং দপ্তরের সঙ্গে সমন্বয় করে ডিজিটাইজ কার্যক্রম বাস্তবায়নে সহযোগিতা করছে। ২০২৩ সালের মধ্যে সব সরকারি সেবা (প্রায় ২৮০০) ডিজিটাইজ করার পরিকল্পনা এবং উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে ২০২০ সালে ১০০টি সরকারি সেবা ডিজিটাইজ করা হবে উল্লেখ করে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘বর্তমান সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে জাতিসংঘের ই-গভর্মেন্ট র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশ ১৬২ থেকে ১১ বছরে ১১৫তম অবস্থানে পৌঁছেছে। ২০২১ সালের মধ্যে আমরা ডাবল ডিজিটে নামিয়ে আনতে কাজ করছি। সরকার শহর থেকে গ্রামে ডিজিটাল সুযোগ-সুবিধা পৌঁছে দিতে পাঁচ হাজার ডিজিটাল সার্ভিস সেন্টার স্থাপন করেছে। প্রতি মাসে ৬০ লাখ মানুষ এই ডিজিটাল সেন্টার থেকে ২০০-এর বেশি সেবা পাচ্ছে। আগামী পাঁচ বছরে ৯০ শতাংশ সরকারি সেবা অনলাইনে দেওয়া হবে এবং প্রায় দুই হাজার নতুন সেবা অনলাইনে চালু করা হবে। আশা করি ২০২১ সালের আগেই আমরা আমাদের টার্গেটে পৌঁছে যাব।’
সূত্র : কালের কণ্ঠ 

No comments

Thank you, best of luck

Theme images by sbayram. Powered by Blogger.