কপিরাইট নিবন্ধন প্রক্রিয়া
বাংলাদেশ একুশের মেলায় সবচেয়ে বেশি বই বের হয়ে থাকে। তবে সারা বছরই আমাদের সম্মানিত লেখকগণ লিখে থাকেন। তা যথারীতি প্রকাশও হয়, আর প্রায় সব বইয়ের গায়ে স্বত্ব বা কপিরাইট কার, সে কথা লেখা থাকে। কপিরাইট বইয়ের গায়ে লিখে দিলেই কপিরাইট বিষয়টি সংরক্ষিত হয় না এর জন্য নির্দিষ্ট বিধিমালা মেনে চলতে হয়। যা নিম্নে প্রদান করা হলো -
কপিরাইট কী?
মৌলিক সৃষ্টিকর্মের মালিকানা বা সত্ত্বাধিকারী নিশ্চিত করাই হচ্ছে কপিরাইট। সাহিত্য বা যেকোনো লেখা, শিল্পকর্ম, সংগীত, চলচ্চিত্র, স্থাপত্য, আলোকচিত্র, ভাস্কর্য, লেকচার, কম্পিউটার প্রোগ্রাম, নকশা অর্থাৎ যা কিছু মৌলিকভাবে তৈরি করা হবে, সবকিছুই কপিরাইটের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। লেখক ও প্রকাশক উভয়কেই তাঁর মেধাস্বত্বের অধিকার সম্পর্কেও সচেতন হতে হবে। একটি বইয়ের কপিরাইট কীভাবে অর্জিত হয়, কীভাবে তা বজায় থাকে, তা জানতে ও মানতে হবে। একটি বই লিখে কিংবা প্রকাশ করেই কিন্তু থেমে থাকা উচিত নয়। প্রকাশিত বই হোক বা অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি, এটি একটি সম্পত্তি। এটা হচ্ছে মেধার সম্পত্তি। জায়গা–জমির যেমন দখল ও মালিকানা বজায় রাখতে হয়, তেমনি মেধা–সম্পদেরও দখল ও মালিকানা থাকতে হবে। লেখক বা প্রকাশক যিনিই হোন না কেন, প্রত্যেকেরই কপিরাইট নিয়ে কিছু বিষয় মেনে চলা প্রয়োজন।
কপিরাইট নিবন্ধন প্রক্রিয়া:
যেকোনো বিষয়ের বই সাহিত্যকর্ম হিসেবেই কপিরাইট দাবি করা যাবে। প্রথমত, কপিরাইটের মালিক হচ্ছেন বইয়ের প্রণেতা বা লেখক। সাহিত্যের ক্ষেত্রে লেখকের জীবনকাল এবং মৃত্যুর পর থেকে ৬০ বছর পর্যন্ত কপিরাইট থাকে। এ ৬০ বছর লেখকের উত্তরাধিকারীরা ভোগ করেন। ৬০ বছর পর কপিরাইটের অধিকার সাধারণ জনগণ ভোগ করতে পারবে। কপিরাইট সুরক্ষার জন্য লেখক বা গ্রন্থ প্রণেতার বইটির কপিরাইট নিবন্ধন করে নেওয়া। কপিরাইট শুধু প্রকাশিত বইয়ের ক্ষেত্রেই করা যায় তা নয়, পাণ্ডুলিপিরও কপিরাইট নিবন্ধন করা যায়। কপিরাইটের নিবন্ধনের জন্য ঢাকার শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত কপিরাইট কার্যালয় থেকে নির্ধারিত আবেদনপত্র সংগ্রহ করতে হবে। এই আবেদনপত্রে যে বিষয়টি কপিরাইট করতে চান, তার সব বিবরণ, স্বত্ব কার নামে হবে, শর্ত কী হবে প্রভৃতি বিষয় পূরণ করতে হবে। আবেদনপত্রের তিন কপি জমা দিতে হবে। পাণ্ডুলিপি বা বই দুই কপি করে জমা দিতে হবে। যে বিষয়টি কপিরাইট নিবন্ধন করার জন্য আবেদন করা হয়েছে, তার ধরন অনুযায়ী নির্ধারিত ফি ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে জমা দিতে হবে। এর সঙ্গে ৩০০ টাকার নন–জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে অঙ্গীকারনামা জমা দিতে হবে। কেউ যদি আইনজীবীর মাধ্যমে আবেদনপত্র দাখিল করতে চান, সে ক্ষেত্রে আবেদনপত্রের সঙ্গে ওকালতনামা দাখিল করতে হয়।
অনলাইনে কপিরাইট রেজিস্ট্রেশনের নিয়মাবলি:
১. লগইন এর জন্য “ রেজিস্ট্রেশন করুন” নামক বাটন ক্লিক করুন এবং প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হওয়ার পর ই-মেইল/মোবাইল নম্বর এবং পাসওয়ার্ড দিয়ে “প্রবেশ করুন” নামক বাটন ক্লিক করলে আবেদনপত্রে প্রবেশ করতে পারবেন। প্রয়োজনে “পূরণকৃত ফরম ও নির্দেশিকা” পড়ুন এবং নিশ্চিত হয়ে আবেদন করুন।
২. আবেদনপত্রের প্রথম অংশে স্ক্যানকৃত সংযুক্তিসমূহ :
ক. বাংলাদেশ ব্যাংক / সোনালী ব্যাংক লি. এর যে কোন শাখায় জমাকৃত ১-৩৪৩৭-০০০০-১৮৪১ কোড নম্বরে প্রতিটি আবেদেনের জন্য ১০০০ ( এক হাজার টাকা ) ট্রেজারি চালান (JPG/PNG /PDF);
খ. স্বাক্ষর(JPG/PNG)।
৩. আবেদনপত্রের দ্বিতীয় অংশে স্ক্যানকৃত সংযুক্তি:
ক. আবেদনকারীর পাসপোর্ট সাইজের ছবি (JPG/PNG );
খ. জাতীয় পরিচয়পত্র/পাসপোর্ট/জন্ম নিবন্ধন(JPG/PNG /PDF);
গ. হস্তান্তরসূত্রে কপিরাইট এর মালিক হলে ৩০০/-(তিনশত) টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে নোটারি পাবলিক দ্বারা কপিরাইট হস্তান্তর দলিল(JPG/PNG /PDF);
ঘ. কর্মের সংগে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অনাপত্তিপত্র প্রযোজ্য ক্ষেত্রে(JPG/PNG /PDF);
ঙ. প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে কোম্পানীর মেমোরেন্ডাম (শেয়ার হোল্ডারদের মালিকানা স্বত্বের সংশ্লিষ্ট পৃষ্ঠা), ট্রেড লাইসেন্স, টিআইএন সার্টিফিকেট(JPG/PNG /PDF);
চ. নিয়োগকর্তা হিসেবে কোন প্রতিষ্ঠান স্বত্বাধিকারী হলে উক্ত প্রতিষ্ঠান কতৃক প্রদত্ত নিয়োগপত্র(JPG/PNG /PDF);
ছ. আবেদনকৃত কর্মের সফট কপি(JPG/PNG /PDF/JPEG/DOCX/Audio/Video);
জ. সাহিত্যকর্মের ক্ষেত্রে কর্মটি প্রকাশিত হলে প্রচ্ছদ কর্মের হস্তান্তর দলিল (রচয়িতা ব্যতীত ভিন্ন কেউ প্রচ্ছদ কর্মের রচয়িতা হলে) (JPG/PNG /PDF);
৪. আবেদনটি সফলভাবে দাখিল হলে ট্র্যাকিং নম্বর সম্বলিত আবেদনপত্র স্ক্রিনে ভেসে উঠবে। আবেদনটি দাখিলের তারিখ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে নিম্নোক্ত সংযুক্তি সমূহের হার্ডকপি আবেদন ট্র্যাকিং নম্বর উল্লেখসহ কুরিয়ার/ডাকযোগ/ব্যক্তিগতভাবে কপিরাইট অফিসে আবশ্যিকভাবে পৌঁছাতে হবে।
ক. কর্মটি মৌলিক আদালতে কোন মামলা বিচারাধীন নেই এবং প্রদত্ত তথ্য নির্ভুল, ঘোষণা সংবলিত অঙ্গীকারনামা ( কার্টিজ পেপারে লিখিত / টাইপকৃত);
খ. আবেদনকৃত কর্মের দুই কপি;
গ. ট্রেজারি চালানের এক কপি ।
৫. উল্লেখ্য যে, অঙ্গীকারনামা, কপিরাইট / রিলেটেডরাইট হস্তান্তর দলিল , অনাপত্তি / সম্মতিপত্র, ক্ষমতা অর্পণপত্র ও প্রচ্ছদ কর্মের স্বত্ব হস্তান্তর ইত্যাদির নমুনা (ফরমেট) http://www.copyrightoffice.gov.bd ওয়েবসাইটে পাওয়া যাবে।
কপিরাইট আইন:
বাংলাদেশে কপিরাইট আইন প্রথম তৈরি হয় ১৯৭৪ সালে। কিন্তু এরপর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সিডি, মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট ইত্যাদির কারণে সৃষ্টিশীলতা ও কপিরাইট ধারণারও বদল হয়েছে। পরবর্তীতে ২০০০ সালে নতুন একটি কপিরাইট আইন করা হয়, যা পরে ২০০৫ সালে সংশোধন হয়। বিশেজ্ঞদের মতে এই আইনে সাহিত্যকর্ম, চলচ্চিত্র, সঙ্গীত, শিল্পকর্ম ও সাউন্ড রেকর্ডিং কপিরাইট আইনের অন্তর্ভুক্ত বিষয়।
বাংলাদেশে কপিরাইট আইন লঙ্ঘন করলে চলচ্চিত্র বাদে চারটি ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ চার বছরের জেল ও দু লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান আছে। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে শাস্তির পরিমাণ পাঁচ বছরের জেল। কপিরাইট থাকলে বিনা অনুমতিতে সেগুলো ব্যবহার, পুনর্মুদ্রণ, অনুবাদ, প্রকাশ ইত্যাদি করা হলে এই আইনের আওতায় শাস্তি ও জরিমানা হতে পারে। এই আইনে প্রতিকার পেতে হলে লেখক বা বিষয়ের স্রষ্টার মেধা সম্পদটির অবশ্যই রেজিস্ট্রেশন থাকতে হবে।
বই বা পাণ্ডুলিপি নকল করলে:
কেউ যদি কোনো লেখকের বা প্রণেতার বই বা পাণ্ডুলিপি নকল করেন, তাহলে আইনের চোখে এটি অপরাধ। এ জন্য দেওয়ানি আদালতে সরাসরি প্রতিকার চাওয়া যাবে। জেলা জজ আদালতে ক্ষতিপূরণ, নিষেধাজ্ঞাসহ অন্যান্য প্রতিকার চাওয়া যাবে। আবার ফৌজদারি মামলারও সুযোগ রয়েছে। কপিরাইট আইন ভঙ্গকারী হিসেবে প্রমাণিত হলে পেতে হবে সর্বোচ্চ চার বছরের জেল এবং সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা। মনে রাখা জরুরি, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই নকল বই জব্দ করার ক্ষমতা পুলিশের রয়েছে।
যা মেনে চলা উচিত:
যেকোনো মৌলিক পাণ্ডুলিপি প্রকাশকের হাতে তুলে দেওয়ার আগে লিখিত চুক্তি করে নেওয়া উচিত। এর আগে পাণ্ডুলিপিটিও কপিরাইট করে নিতে পারেন। প্রকাশকের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করতে হবে কপিরাইট আইন মেনে। চুক্তিতে অবশ্যই স্বত্বের অধিকার, মেয়াদ, রয়্যালটির পরিমাণ উল্লেখ থাকতে হবে। চুক্তিনামাটিও কপিরাইট অফিস থেকে নিবন্ধন করে নেওয়ার সুযোগ আছে।
No comments
Thank you, best of luck