ads

নীল নদের দেশ। পিরামিডের দেশ


মিসর। নীল নদের দেশ। পিরামিডের দেশ। ঘোরাঘুরি করার জন্য একদম আদর্শ একটা দেশ। সে দেশে যাওয়াটা অবশ্য চাট্টিখানি কথা নয়। খরচ ও পরিশ্রম দুই-ই আছে। তবে সেই আক্ষেপ দূর করার ব্যবস্থাও আছে। সে ব্যবস্থা করে গেছেন সৈয়দ মুজতবা আলী। তিনি নিজে কায়রোর আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছিলেন। সে সময়ে গোটা মিসর ঘুরে বেড়িয়েছেন। আর সেই অভিজ্ঞতা থেকেই লিখেছেন এই ভ্রমণকাহিনী- জলে ডাঙায়।


অবশ্য বইটার যে কাহিনী, তাতে তিনি আসলে যাচ্ছিলেন ইউরোপে। সে উদ্দেশ্যেই বন্দরের রাজ্যের ছোটাছুটি আর চেঁচামেচির মধ্যে মিসর হয়ে ইউরোপ যাওয়ার জাহাজে উঠলেন তিনি। বন্দরে আকাশে-বাতাসে খালাসিদের উচ্চারিত রাজ্যের কটুবাক্য, আর জাহাজের ভেপুর ভোঁ ভোঁ শব্দ। জাহাজ তখনো ছাড়েনি, তিনি জুড়ে দিলেন আড্ডা। তাও দুই ছোকরার সঙ্গে- পল আর পার্সি। আর আড্ডাবাজিতে মুজতবা আলী অতুলনীয়। কত গল্পই যে তিনি করতে পারেন! বেদে-বেদুইনদের গল্প থেকে শুরু করে আকবর-আওরঙ্গজেব আর ফিরিঙ্গিদের গল্প, আফ্রিকার ঝড়ের গল্প থেকে শুরু করে ইউরোপীয়-মুঘল আর ভারতীয়দের অর্থাৎ আমাদের খাবার-দাবারের গল্প, কোন গল্প জানেন না তিনি! আর কী যে রসিয়ে রসিয়ে সে সব গল্প তিনি বলেন! গল্পের লোভে পল আর পার্সি তো তার পিছুই ছাড়ে না। ওদের মধ্যে পার্সিটা একটু চঞ্চল। সারা দিন পুরো জাহাজে তিড়িং বিড়িং দাপিয়ে বেড়ায়। পল আবার শান্ত স্বভাবের। কিন্তু গল্প শোনার সময় দুজনেই সমান শান্ত আর মনোযোগী।

কলম্বো বন্দর ছাড়ার দিনদুয়েকের মধ্যেই তারা পৌছে গেল আরব সাগরে। আর সেখানে গ্রীষ্মের গরমে ভাজা ভাজা হতে হতে একদিন তার সঙ্গে পরিচয় হলো এক অদ্ভুত মানুষের। নামটাই তার আড়াইগজী- আবুল আসফিয়া নূর উদ্দীন মুহাম্মদ আবদুল করীম সিদ্দিকী। গায়ে তার হাঁটু পর্যন্ত নেমে আসা কোট, ঢিলে পাজামার চেয়েও ঢিলে পাতলুন, আর তার দাড়ি তার টাইটাকেই ঢেকে ফেলেছে। পোশাক-আশাক অদ্ভুতুড়ে হলে কী হবে, আবুল আসফিয়া কিন্তু রীতিমতো বড়লোক। তাঁর এক পকেটে সোনার একটা ভিজিটিং কার্ডের কেস, আরেক পকেটে সোনার বড় আকারের এক সিগারেটের কেস! তাঁর সবই ভালো, কেবল সমস্যা একটাই- তিনি খুব কম কথা বলেন।

এরই মাঝে ঝড় আর সি-সিকনেসে কাহিল হয়ে পড়ল অনেকেই। জাহাজ দাপিয়ে বেড়ানো পার্সিও ঝড়ের মাঝে সি-সিকনেসে বিছানা নিল। কিন্তু ওকে বিছানায় আর কয়দিনই বা আটকে রাখা যায়? পরদিনই আবার পুরো জাহাজ দাপিয়ে বেড়াতে লাগল। আর সুসংবাদটাও সে-ই নিয়ে এলো। সুসংবাদটা আর কিছু নয়, মিসর ঘুরে দেখার এক সুযোগ এসেছে তাদের সামনে।

ভারত থেকে জাহাজ ইউরোপে যাওয়ার সময় আরব সাগর থেকে লোহিত সাগর বা লাল দরিয়া যেতে সুয়েজ খাল পাড়ি দেয়। খালটি লম্বায় একশ মাইল। কিন্তু দুইপাশে মরুভূমির বালু বলে জাহাজকে এগোতে হয় ঘণ্টায় পাঁচ মাইল বেগে। খালের এ মাথার সুয়েজ বন্দর থেকে ও মাথার সঈদ বন্দরে যেতে যেতে জাহাজের প্রায় একদিন লেগে যায়। এর মধ্যেই চাইলে সুয়েজ বন্দরে নেমে ট্রেনে কায়রো গিয়ে পিরামিড দেখে আবার ট্রেনে সঈদ বন্দরে গিয়ে তারা তাদের জাহাজটাই ধরতে পারবে।

কিন্তু যদি কোনো অঘটন ঘটে যায়? তারা ফের জাহাজ ধরতে না পারে? সে দায়িত্ব নেওয়ার জন্য আছে কুক কোম্পানি। তারা তাদের এই যাত্রার সব ব্যবস্থা করবে। এমনকি তারা যদি জাহাজ মিসও করে, সে দায়িত্বও কুক কোম্পানির। প্রথমটায় তারা তো একেবারে আনন্দে নাচতে লেগে গেল। কিন্তু পরে টাকার অঙ্ক দেখে তাদের সব উৎসাহ একেবারে জল হয়ে গেল। শেষমেশ তারা যখন সিদ্ধান্ত নিল, তাদের কপালে পিরামিড-দর্শন নেই, তখন আবার দৃশ্যপটে এলেন আড়াইগজী নামের আবুল আসফিয়া। কুক কোম্পানির বাতলানো পথেই নিজেরা গেলে কত কম খরচে পিরামিড-দর্শন সম্ভব, সে কথা বলে তিনিও ১২ জনের কুক কোম্পানির দলের বিপরীতে নয়জনের দল বানিয়ে ফেললেন। আর তাতে পল-পার্সি সমেত জুটে গেলেন মুজতবা আলীও। জাহাজ ধরতে না পারার দায়িত্ব? সে তো আবুল আসফিয়া নিশ্চিন্তে নিয়ে বসে আছেন, যেন জাহাজ মিস করার মতো অসম্ভব ঘটনা ঘটার আগে পৃথিবী দুই ভাগ হয়ে যাবে!

প্রথমেই কিন্তু তারা ট্রেন মিস করলেন। বন্দরের এক কর্মকর্তার সহায়তায় কোনোমতে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে ছুটলেন কায়রোর পানে। মরুভূমির ভেতর দিয়ে যেতে যেতে উপভোগ করলেন মরুভূমির বুকে জ্যোৎস্নার অপরূপ রূপ। তারপর তারা প্রবেশ করলেন কায়রোর বুকে।

কায়রোতে ঢুকতে না ঢুকতেই তাদের একেকজনের ক্ষিধে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। আর কায়রো তো রাতের শহর নামেই বিখ্যাত। সেখানে এমন ক্যাফে হরদম আছে, যেগুলো খোলাই হয় রাত ১২টায়।

খেয়েদেয়ে তারা রওনা দিলেন পিরামিডের পথে। আর সেখানে যেতে যেতে দেখা পেলেন মিসরের আরেক বিস্ময়ের- নীল নদের। তারপর পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত তিন পিরামিড। তারপর কায়রোর সবচেয়ে পুরোনো জনপদ আজহারপাড়া। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়টিও কিন্তু এই আজহারপাড়াতেই, নাম আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন মুজতবা আলী।



সবশেষে ট্রেনে চেপে রওনা দিলেন স্ইদ বন্দরের পথে। তাঁদের জাহাজ সইদ বন্দর ছাড়বে রাত ৮টায়, তার আগেই সেখানে পৌঁছাতে হবে। তবে তাদের জাহাজ সুয়েজ খাল পার হতে যদি আরো বেশ কিছুদিন সময় লাগাত, তাঁরা বোধহয় খুশিই হতেন।

বই : জলে ডাঙায়
লেখক: সৈয়দ মুজতবা আলী
ধরন : ভ্রমণকাহিনী/শিশুসাহিত্য
ভাষা : বাংলা
প্রকাশক : স্টুডেন্ট ওয়েজ
পৃষ্ঠা : ১০২

No comments

Thank you, best of luck

Theme images by sbayram. Powered by Blogger.