পরোপকারী খোকা - পতিতপাবন মণ্ডল (পাবন)
‘তোর ছাতা কই খোকা? এমন ভিজেছিস কেন?’ খোকা হাসিমুখে বলল, ‘মা গো আমার এক গরিব বন্ধুর ছাতা নেই । আমার ছাতাটা ওকে দিয়েছি। মা ছেলের এমন উদারতায় মুগ্ধ হয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বললেন , ‘ভালোই করেছিস বাবা! তোর বাবাকে বলব তোকে আর একটা ছাতা কিনে দিতে। ‘ মা ছেলের কপালে চুমু দেন।
শীতের সময় খোকাকে একটি চাদর কিনে দেওয়া হল। একদিন দেখা গেল চাদর ছাড়াই বাড়ি ফিরে এলো খোকা। মা বললেন। তোর চাদর কই বাবা? ’খোকা বলে, মাগো পথের ধারে গাছের নিচে বসে এক গরিব বুড়ি শীতে খুব কাঁপছিল। আমি তার গায়ে চাদরটি জড়িয়ে দিয়ে এসেছি’।
মা, অবাক হয়ে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে থাকেন। ভাবেন, গরিব মানুষের জন্য ছেলেটির এত দরদ! ও নিশ্চয় বড় হয়ে মানুষের জন্য অনেক কিছু করবে। মায়ের কথা কখনো বিফলে যায় ?
তাই তো একদিন এই খোকা শোষিত, বঞ্চিত, গণ মাসুষের মুক্তির জন্য ৭ই মার্চ ১৯৭১ সালে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ লক্ষ জনতার সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন —
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, / এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
কে এই খোকা-?
এ খোকা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি, জাতির পিতা যিনি বাঙ্গালির অধিকার ও স্বতন্ত্র মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ভাষা-আন্দোলন থেকে শুরু করে, এদেশের গণমানুষের মুক্তির জন্য পরিচালিত সকল আন্দোলনে-ই ছিলেন প্রধান চালিকাশক্তি। তাঁর নেতৃত্বেই ১৯৭১ সালে আমরা মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি এবং দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সশন্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জন করেছি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ। তিনি বজ্রকণ্ঠের অধিকারী, সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাপাঁ মহান পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
আজ ১৭ মার্চ। জাতির শ্রেষ্ঠ এ সন্তানের শুভ জন্মদিন এবং জাতীয় শিশু দিবস। ১৯২০ সালে ১৭ মার্চ দুঃখী বাংলার দুঃখী মানুষের মুক্তির বার্তা নিয়ে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক নেতা, যিনি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। জনসাধারণের কাছে তিনি ‘শেখ মুজিব’ এবং ‘শেখ সাহেব’ হিসেবে বেশি পরিচিত । তিনি বাংলার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত ছুটে বেড়িয়ে বাঙালির কাছে পৌঁছে দেন পরাধীনতার শিকল ভাঙার মন্ত্র। সে মন্ত্রে বলীয়ান হয়ে স্বাধীন দেশে পরিণত হওয়ার পাশাপাশি আজ বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে বিশ্বের অন্যতম সম্ভাবনাময় দেশে।
বাংলা, বাঙালি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একবৃন্তে তিনটি চেতনার ফুল। বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের মাঝে তিনি চির অম্লান চিরঞ্জীব। বাংলার শোষিত-বঞ্চিত-নির্যাতিত-মেহনতি জনতার হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু চিরভাস্বর। তিনি রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা দিয়ে কর্মী থেকে নেতা, নেতা থেকে জননেতা, একটি দলের নেতা থেকে হয়েছেন দেশনায়ক। সাধারণের মধ্য থেকে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক নেতৃত্বের উদ্ভব। তিনি শাশ্বত গ্রামীণ সমাজের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না ছেলেবেলা থেকে গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন। গরিব ও অসহায় মানুষের পাশে সবসময় দাঁড়াতেন শেখ মুজিব। ক্ষুধায় কাতর দরিদ্র কৃষকদের নিজের ঘরের ধান বিলিয়ে দিয়ে তাদের ক্ষুধা নিবারণ করতেন। তিনি সাধারণ মানুষের আশাকে ভাষা দিতে, স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদান করতে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন এবং যৌবনের শ্রেষ্ঠ দিনগুলো কাটিয়েছেন নির্জন কারাবাসে। মানুষের জন্য হাসিমুখে ফাঁসির মঞ্চকে বেছে নিতে কখনও কুণ্ঠিত হননি। ঘাতকের বুলেট বুক পেতে নিয়েছেন। তাই তিনি বাঙালি জাতির হৃদয়ের মণিকোঠায় অমর হয়ে আছেন।
পিতা শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা সায়রা খাতুনের চার কন্যা ও দুই পুত্রের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তৃতীয় সন্তান। তার বড় বোন ফাতেমা বেগম, মেজ বোন আছিয়া বেগম, সেজ বোন হেলেন ও ছোট বোন লাইলী; ছোট ভাইয়ের নাম শেখ আবু নাসের। ১৯৩৮ সালে আঠারো বছর বয়সে তার সঙ্গে বেগম ফজিলাতুন্নেসার বিয়ে হয়। এ দম্পতির ঘরে দুই কন্যা এবং তিন পুত্রের জন্ম হয়। কন্যারা হলেন- শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা। আর পুত্রদের নাম শেখ কামাল, শেখ জামাল এবং শেখ রাসেল। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় বঙ্গবন্ধুর তিন পুত্রই তাঁর সঙ্গে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে আততায়ীর হাতে নিহত হন।
৭ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধু পার্শ্ববর্তী গিমাডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এরপর পড়েছেন গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুল ও গোপালগঞ্জ মাথুরানাথ ইন্সটিটিউট মিশন স্কুলে। মিশন স্কুলে পড়ার সময় স্কুল পরিদর্শনে এসেছিলেন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা একে ফজলুল হক ও পাকিস্তানের তৎকালীণ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। সে সময়ে স্কুলের মেরামত কাজ ও ছাদ সংস্কার, খেলার মাঠ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য জরুরিভাবে অর্থ বরাদ্দ দেয়ার দাবি করেন শেখ মুজিবুর রহমান। গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালে তৎকালীন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগদান করায় তিনি জীবনে প্রথম গ্রেফতার হন। ১৯৪২ সালে তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চ শিক্ষার্থে কলকাতায় গিয়ে বিখ্যাত ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। ১৯৪৬ সালে তিনি বিএ পাস করেন। শেখ মুজিবুর রহমান এ সময়ে ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। এ সময়ে তিনি হোসেন সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিমের মতো নেতাদের সান্নিধ্যে আসেন এবং ছাত্র-যুবনেতা হিসেবে রাজনীতির অঙ্গনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। কলকাতার কলেজ জীবনে বঙ্গবন্ধু এ উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের পর পরই ঢাকায় ফিরে নতুন রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা নিয়ে ১৯৪৮ সালে ছাত্রলীগ গঠন করেন। ’৪৮ থেকে ’৫২-এর মহান ভাষা আন্দোলন, ’৫৮-এর আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন এবং পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ প্রধান হিসেবে ’৬৬-এর ঐতিহাসিক ৬ দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় কারারুদ্ধ হন তিনি। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ষাটের দশকে তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। ’৬৯-এর ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ছাত্র-জনতা তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়। ’৭০-এর নির্বাচনে বাঙালি বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার পক্ষে জানায় অকুণ্ঠ সমর্থন। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির এ নির্বাচনী বিজয়কে মেনে নেয়নি। বাঙালির এ নেতা কখনও অন্যায়ের কাছে আপস করেননি। অবিসংবাদিত এ নেতা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে এ দেশের জনগণ মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জন করেন বহু কাঙ্ক্ষিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহরুর জন্মদিনটি শিশু দিবস হিসেবে পালিত হয়। অপরদিকে একটি স্বাধীন দেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনটিও শিশু দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। কিন্তু এ দিনটি কেন জাতীয় শিশু দিবস হল? কেন এ দিনটিকে শুধু শিশুদের দিন হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়েছে? কারণ বঙ্গবন্ধু শিশুদের অত্যন্ত আদর করতেন, ভালোবাসতেন। সংগ্রামী জীবনের শত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি শিশুদের জন্য ভাবতেন। শিশুদের আনন্দ ও হাসি-খুশিতে রাখার প্রতি গুরুত্ব দিতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, আজকের শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আগামীতে দেশগড়ার নেতৃত্ব দিতে হবে তাদেরই। শিশুরা সৃজনশীল মুক্তমনের মানুষ হিসেবে গড়ে উঠুক, সব সময়ই তিনি তা আশা করতেন। শৈশব থেকেই ছোট-বড় সবার জন্য দরদি হওয়ার কারণই মানুষকে তিনি অধিকার আদায়ে উদ্বুদ্ধ করতে, সচেতন করতে, সংগ্রামী করতে পেরেছেন। রাজনীতির কিংবা দেশের কোনো কাজে যখন গ্রামেগঞ্জে যেতেন, তখন চলার পথে শিশুদের দেখলে তিনি গাড়ি থামিয়ে তাদের সঙ্গে গল্প করতেন, খোঁজখবর নিতেন। দুস্থ ও গরিব শিশুদের দেখলে তাদের কাছে টানতেন। কখনও কখনও নিজের গাড়িতে কোনো দুঃস্থ পিতাকে উঠিয়ে অফিসে কিংবা বাড়িতে নিয়ে তাকে কাপড়চোপড়সহ অনেক উপহার দিয়ে তার মুখে হাসি ফোটাতেন।
বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনকে জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। ১৯৯৭ সালের ১৭ মার্চ থেকে দিবসটি পালিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুকে সম্মান দেওয়া মানে বাঙালি জাতিসত্তাকে স্বীকার করে সমগ্র বাঙালি জাতিকে সম্মান দেওয়া।
শিশু দিবসে আমরা আবারও শিশুদের অধিকারের কথা স্মরণ করব। আমরা তাদের জন্য কী করলাম, কী করতে পারছি, আর কী করার বাকি আছে তা খতিয়ে দেখতে হবে। তাদের যথাযথ সম্মান প্রদান করে তাদের কথা মন দিয়ে শুনে, তাদের মত ভেবে তাদের উপকারে সিদ্ধান্ত হবে। তবে বঙ্গবন্ধুর যে স্বপ্ন ছিল সোনার বাংলা গড়ার, সে সোনার বাংলা নতুন প্রজন্মই গড়বে। শিশুদের সঠিকভাবে গড়ে তোলার দায়িত্ব শুধু পিতা-মাতা বা পরিবারের নয়। রাষ্ট্রকেও নিতে হবে শিশুর মেধা বিকাশে সঠিক কর্মসূচি।
এ দিনে বর্তমানের শিশুদের প্রতি আমার আহ্বান, তোমার কথা ও আচরণ দিয়ে তুমি কাউকে কষ্ট দিও না। মনে রেখো, প্রতিটি মানুষের মাঝে সৃষ্টিকর্তা বিরাজমান। বাবা-মা, শিক্ষক ও গুরুজনদের শ্রদ্ধা করতে শেখো। মানুষ ও দেশকে ভালবাসো। প্রতিবেশীর আনন্দ ও কষ্টের সহভাগী হতে চেষ্টা করো। জাতি, ধর্ম ও বর্ণের ঊর্ধ্বে থাকো এবং মানবতাকে সর্বোচ্চে স্থান দাও। মহৎ ব্যক্তিদের জীবনী পড়ো এবং তাঁদের আদর্শগুলো জীবনে ধারণ করো। বর্তমান প্রজন্মর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার করা। প্রযুক্তির অপব্যবহারে ধ্বংস হতে পারে শিশুদের সুন্দর ভবিষ্যৎ। তাই সকলকে প্রযুক্তির অকল্যাণকর দিকের বিষয়ে সতেচন থাকতে হবে। প্রযুক্তিকে যেন তোমরা নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখে ব্যবহার করো। প্রযুক্তির দাস হয়ে ডিজিটাল কোকেনের যেন স্বীকার না হও। তাহলে আমরা সকল ক্ষেত্রে প্রকৃত শিক্ষা অর্জন করে পৃথিবীকে যে অবস্থায় পেয়েছি তার থেকে আরো উন্নত অবস্থায় রেখে যেতে পারব। তোমরা সমৃদ্ধ আগামী সুপ্রতিষ্ঠিত করবে এ আশাবাদ ব্যক্ত করে শেষ করছি।
No comments
Thank you, best of luck