ads

নিরক্ষরতা দূরীকরণে ছাত্রসমাজের ভূমিকা



ভূমিকা: 
অক্ষর জ্ঞানহীন মানুষই নিরক্ষর। আর মানুষের এই অক্ষর জ্ঞানের অভাবকেই বলা হয় নিরক্ষরতা। বাংলাদেশে নিরক্ষরতার পরিমাণ শতকরা ৪০ জন। নিরক্ষরতা জীবনের সবচেয়ে বড় অসহায়ত্ব। নিরক্ষর মানুষ চোখ থাকতেও অন্ধ। তারা জ্ঞানের জগৎ ও আলোর দুনিয়া থেকে প্রায় বঞ্চিত। নিরক্ষর মানুষ জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন-শিল্প-সাহিত্য ইত্যাদির স্বাদ গ্রহণ করতে পারে না। তাদের জীবনটাই একরকম ব্যর্থ। জীবন ও জগতের কিছুই তারা বুঝতে পারে না। যেমন পারে না অপরের চিন্তাধারাকে উপলব্ধি করতে, তেমনি পারে না নিজের ভাবনা-চিন্তাকে প্রকাশ করতে। কুয়ার ব্যাঙের মতো তাদের জীবন কাটে সংকীর্ণ গণ্ডীর অন্ধকারে। দেশ ও জাতির উন্নয়নে অংশগ্রহণ তো দূরের কথা, নিজের ভালো-মন্দও বুঝতে অন্যের সহায়তার প্রয়োজন হয়।
নিরক্ষরতার ক্ষতিকর প্রভাব: 
আমাদের দেশের শতকরা ৪০ জন নিরক্ষর। বাকি চল্লিশ জনের মধ্যে ১৭/১৮ জনকে প্রকৃত শিক্ষিত বলা যায়। অন্যরা কোন রকমে পড়তে পারে, লিখতে পারে, নাম দস্তখত করতে পারে। একটা স্বাধীন দেশের এতগুলো লোক নিরক্ষর থাকা জাতির পক্ষে ক্ষতিকর এবং লজ্জাকর। বর্তমান যুগ বিজ্ঞান ও সভ্যতার যুগ। এ যুগেও আমাদের অধিকাংশ জনগণ যদি নিরক্ষর থাকে, তাহলে জাতির উন্নতি কোনোভাবে আশা করা যায় না। আমাদের দেশের জনসাধারণ অশিক্ষিত বলে রক্ষণশীল, কুসংস্কার ও গোঁড়ামিতে আবদ্ধ। অজ্ঞতা আমাদের মনকে সংকীর্ণ করে ফেলেছে। তারা উন্নত চিন্তা-ভাবনা করতে পারে না। দেশের উন্নতি হওয়া তাদের দ্বারা সম্ভব নয়। তাই নিরক্ষরতাই আমাদের দেশের উন্নয়নের মূল বাধা। নিরক্ষরতার কারণে জাতীয় পর্যায়ের প্রায় সকল উদ্যোগে আমাদের পরাজয় অপেক্ষা করে।
উন্নত দেশে  নিরক্ষরতা দূরীকরণের সুফলতা: 
কোনো উন্নত দেশই নিরক্ষরতা দূরীকরণে অমনোযোগী ছিল না। পরাধীনতা বা স্বৈরাচারী শাসন হতে সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত রাষ্ট্রগুলোও নিরক্ষরতার সমস্যা সমাধানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাধনা করে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, তুরস্কে বিশ বছরের মধ্যে শিক্ষার মান শতকরা ষাট ভাগ বৃদ্ধি পায়। অথচ এই তুরস্ককে এক সময় রুগ্ন দেশ বলা হত।
নিরক্ষরতার কারণ: 
দারিদ্র্যতাই আমাদের নিরক্ষরতার প্রথম ও প্রধান কারণ। আমাদের দেশের জনগণ এত দরিদ্র যে, দুবেলা দুমুঠো ভাতের যোগাড় করাই তাদের পক্ষে কঠিন। এজন্য তাদের ছেলেমেয়েরা প্রাথমিক শিক্ষার দু/এক ধাপ পৌঁছেই স্কুল থেকে বিদায় নেয়। তাছাড়া ব্রিটিশ এবং পরবর্তীতে পাকিস্তান সরকারের শাসন ও শোষণ আমাদের অজ্ঞতার অন্যতম কারণ। ঔপনিবেশিক শাসন এদেশের মানুষকে অন্ধ রেখে তাদের ওপর শোষণ করার সুযোগ গ্রহণ করেছিল। ব্যক্তিগত চেষ্টায় সেসময়ে দু/একজন সামান্য লেখাপড়া শিখতে পারলেও অধিকাংশ মানুষ পড়ে ছিল অজ্ঞতার অন্ধকারে। এখনো এ ধরনের মানসিকতা আমাদের মধ্যে কাজ করছে। এছাড়া কুসংস্কার, রক্ষণশীলতা ও গোঁড়ামির জন্য এদেশের মানুষ শিক্ষার প্রতি খুব একটা আগ্রহী নয়।
নিরক্ষরতা  থেকে মুক্তির উপায়: 
বেঁচে থাকার জন্য যেমন খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন শিক্ষার। আমাদের দেশ বর্তমান সভ্য দুনিয়ার একেবারে শেষপ্রান্তে আছে। এর কারণ নিরক্ষরতা। আমাদের সমাজ জীবনে মামলা-মোকদ্দমা, জালিয়াতি-জুয়াচুরি,অন্যায়-অপরাধ ও নীতিহীন যত অপকর্ম, তার মূলে রয়েছে এ নিরক্ষরতা। নিরক্ষরতার অন্ধকার থেকে এদেশের মানুষকে আলোতে আনতে হবে।
বাংলাদেশ সরকারের পদক্ষেপ 
বাংলাদেশ পরাধীনতার শিকল ছিড়ে স্বাধীনতা লাভ করেছে। এখন দেশকে শিক্ষিত ও শক্তিশালী করতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছে এবং এই শিক্ষাকে উৎসাহ প্রদানের জন্য শিক্ষার বদলে খাদ্য কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এতে দেশে বিপুল সাড়া পড়েছে এবং প্রাথমিক বিদ্যালয় সমূহে ছাত্রসংখ্যা বহুগুণে বেড়ে গেছে। এছাড়াও দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েদের শিক্ষা অবৈতনিক করা হয়েছে এবং তাদের বৃত্তিদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বয়স্কদের শিক্ষা
প্রাইমারি শিক্ষার জন্য যেমন সরকার দৃষ্টি দিয়েছে, সেরূপ বয়স্কদের শিক্ষার জন্য পরিকল্পনার প্রয়োজন। প্রাইমারি শিক্ষার ফল আস্তে আস্তে পাওয়া যায়, কিন্তু বয়স্কদের শিক্ষার ফল সাথে সাথে পাওয়া যায়। স্বাধীন দেশের বয়স্ক নাগরিক অশিক্ষিত অবস্থায় থাকতে চায় না। বিদেশে এমন কি অন্ধ, বোবা ও বধিরদের রাষ্ট্রীয়ভাবে শিক্ষার সুযোগ দান করা হয়েছে। এ বিষয়ে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টা প্রশংসনীয়। জীবিকা অর্জন অথবা তার প্রয়াসের দরুন বয়স্কদের পক্ষে লেখাপড়ায় বেশি সময় দেওয়া সম্ভব নয়। অবশ্য মাতৃভাষার সাহায্যে সামান্য উদ্যমেই কার্যকর জ্ঞান অর্জন করা তাদের পক্ষে সম্ভব। এতে আমাদের বহির্জগতের সাথে পরিচয়, সাধারণ জ্ঞান এবং ভাষা জ্ঞান শিক্ষার জন্য বিশেষ সুযোগ দান করে। তাই বয়স্কদের শিক্ষাদানের উদ্যোগ আমাদের গ্রহণ করতে হবে।
গণশিক্ষা কেন্দ্র: 
বর্তমানে বহু স্থানে স্থানীয় শিক্ষিত তরুণদের উৎসাহ উদ্দীপনায় গণশিক্ষা কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব কেন্দ্রের পরিচালকগণ আন্তরিক হলে নিরক্ষরতা দূরীকরণে বেশি সময়ের প্রয়োজন হওয়ার কথা নয়। প্রত্যেকটি স্কুল-কলেজে তাদের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে কমপক্ষে একটি নৈশ বিদ্যালয় হিসেবে চিহ্নিত করে অবসরকালীন কার্যক্রমের মাধ্যমে পালাক্রমে স্কুলত্যাগী, শ্রমজীবী কিশোর-কিশোরী ও অশিক্ষিত বয়স্কদের শিক্ষার ব্যবস্থা সহজেই করা যেতে পারে। এতে স্কুল বা কলেজের একজন শিক্ষক সপ্তাহে একটি করে ক্লাসও ভাগে পাবেন কিনা সন্দেহ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধানগণ ও শিক্ষকবৃন্দ প্রস্তাবটি বিবেচনা করে দেখতে পারেন।
বাংলা ভাষা সহজীকরণ: 
বাংলা ভাষা ও ব্যাকরণ সহজ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। সরকার কর্তৃক নিয়োজিত ভাষা কমিটি বাংলা ভাষা সহজ এবং সুদূরপ্রসারী করতে সর্বসম্মতিক্রমে সুপারিশ করেছেন। সুপারিশ অনুযায়ী যে ‘সহজ বাংলা শিক্ষা’ পদ্ধতি প্রচলন করা হয়েছে, তার সাহায্যে বাঙালি যেকোনো ব্যক্তি অল্প সময়ে বাংলা শিখতে পারবে। এ সহজ বাংলা শিক্ষা পদ্ধতি বয়স্কদের শিক্ষার কাজকে সহজতর করেছে। সহজ বাংলা শিক্ষা পদ্ধতির বহু কেন্দ্রে বহু বয়স্ক নরনারী শিক্ষালাভ করে।
নিরক্ষরতা দূরীকরণে ছাত্র সমাজের ভূমিকা: 
নিরক্ষরতা দূরীকরণে ছাত্রদের দায়িত্ব অপরিসীম। স্কুল-কলেজের ছাত্ররা যদি ছুটির দিনে নিরক্ষর মানুষের পাশে এসে অক্ষরজ্ঞান দান করে এবং শিক্ষার গুরত্ব সম্পর্কে তাদের আগ্রহী ও সচেতন করে তোলে, তাহলে সবচেয়ে বেশি সুফল পেতে পারে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে ছাত্ররা এ দায়িত্ব পালন করে থাকে। দেশের শিক্ষিত লোক ও সমাজ কর্মীদের চেষ্টায় নিরক্ষরতা দূর হতে পারে। তারা যদি গ্রামে-গঞ্জে গিয়ে পল্লির অশিক্ষিত নরনারীকে তাদের অজ্ঞতার পরিণাম, কুসংস্কার, গোঁড়ামি ও রক্ষণশীলতার ফলাফল সম্পর্কে ভালো করে বোঝান, তাহলে জনমনে সাড়া জাগবে।
উপসংহার: 
নিরক্ষরতা আমাদের জাতীয় জীবনে একটি দুরারোগ্য ব্যাধি, দেশ ও জাতির চরম শত্রু। এ শত্রুকে ধ্বংস করতে না পারলে জাতীয় উন্নতি আসবে না। সরকারি উদ্যোগ ও দেশপ্রেমিক জাগ্রত জনগণের প্রচেষ্টায় সমস্যার সমাধান সম্ভব। মনে রাখতে হবে শুধু নিজে শিক্ষিত হলে চলবে না। কেননা, শরীরের সমস্ত রক্ত মুখে জমা হওয়া সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়। দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে গুটিকতক লোক শিক্ষিত হলে তাকে শিক্ষিত জাতি বলা যাবে না। তাতে দেশের উন্নতিও আসবে না। তাই দেশের নিরক্ষর মানুষকে অক্ষরজ্ঞান দান করে নিরক্ষরতার অভিশাপ মুক্ত করতে সংগ্রাম করে যেতে হবে।

No comments

Thank you, best of luck

Theme images by sbayram. Powered by Blogger.