সেভ ওয়াটার, সিকিউর দ্যা ফিউচার’
‘সেভ ওয়াটার, সিকিউর দ্যা ফিউচার’
আমাদের সংস্কৃতি, যাপিত জীবন ও জীবিকার প্রবাহ আবর্তিত হচ্ছে জলকে কেন্দ্র করে। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় জল সম্পদ এক অতীব প্রয়োজনীয়। বলা হয়, জলই জীবন। জলের অপচয় ও দূষণ রোধ করা ও তার সুসম বণ্টন এ সময়ের বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কেন্দ্রীয় ভাবনায় পরিণত হয়েছে। জল যেমন সকল প্রাণের উৎস তেমনি জল ছাড়া কোনো প্রাণী ও উদ্ভিদ জীবন ধারণ করতে পারে না। জলের গুরুত্ব উপলব্ধি করে প্রতি বছর পালিত হয় ‘আন্তর্জাতিক বিশ্ব জল দিবস’। অনুষ্ঠিত হতে শুরু করেছে ‘ওয়াটার সামিট’। ওয়াটার সামিট’-২০১৬ অনুষ্ঠিত হয় হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে।
১৯৯২ সালে জাতিসংঘ পরিবেশ ও উন্নয়ন সম্মেলনে (ইউএনসিইডি) প্রথম বিশ্ব জল দিবস পালনের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবটি উত্থাপিত হয়। ১৯৯৩ সালে প্রথম বিশ্ব জল দিবস পালিত হয় এবং তার পর থেকে এই দিবস পালনের গুরুত্ব ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। ২২ মার্চ ২০১৭ উদযাপন হবে ২৫ তম বর্ষের বিশ্ব জল দিবস। এ বিষয়গুলোতে প্রতীয়মান হয় যে, নিরাপদ জল আগামী বিশ্বের জন্য অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পৃথিবীর সকলেই পানির ওপর নির্ভরশীল। পৃথিবীর ৭০০কোটি মানুষ কোটি মানুষ আজ খাদ্য ও জ্বালানির মতো মৌলিক বিষয়ের পাশাপাশি যে বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি তা হচ্ছে সবার জন্য বিশুদ্ধ ও পর্যাপ্ত নিরাপদ খাবার পানি। আর যেসব অ্যঞ্চলে পানি স্বল্পতা সেসব অঞ্চলে সৃষ্টি হচ্ছে পানি যুদ্ধের সম্ভাবনা। যেমন লেবানন-ইসরায়েল এর মধ্যে হাসবানি নদীর পানি নিয়ে বিরোধ, তেমনি তুরস্ক-সিরিয়া ও ইরাকের মধ্যে ইউফেটিস নিয়ে, সিরিয়া ও ইসরায়েলের মধ্যে গ্যালিলি সাগর নিয়ে। ইসরায়েল-ফিলিস্তান ও জর্দানের মধ্যে জর্দান নদী নিয়ে সুদান, মিশর, ইথিওপিয়া ও আরো কিছু দেশের মধ্যে নীলনদ নিয়ে, সেনেগাল ও মৌরিতানিয়ার মধ্যে সেনেগাল নদী নিয়ে, ইরান ও আফগানিস্থানের মধ্যে হেলম্যান্ড নদী নিয়ে আর বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে বিবাদতো আছেই। তাই পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে আমাদের নুতন করে ভাবতে হবে। না হলে হয়তো পানি নিয়েই পরবর্তী বিশ্বযুদ্ধ সংগটিত হতে পারে।
জনৈক এক কৃষিবিদের নিবন্ধে থেকে জানা যায়, ‘পৃথিবী পৃষ্ঠের তিন-চতুরাংশ পানি। শতকরা হিসেবে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৭১.৪ শতাংশ। এত পানি থাকার পরও চারদিকে শুধু পানির অভাব। আর সেই অভাবটি হলো বিশুদ্ধ পানির। কারণ ৭১.৪ শতাংশ পানির মধ্যে ৯৭% ভাগ পানিই লবণাক্ত পানি, ২% হলো বরফ এবং বাকি মাত্র ১% হলো বিশুদ্ধ পানি। হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের মিলিত রাসায়নিক পদার্থের নামই যে পানি তা অনেক আগেই রসায়নবিদরা আবিষ্কার করেছেন। কিন্তু এটি যে একটি যৌগ তা ১৯৭৮ সালে বিজ্ঞানী ক্যাভেন্ডিস আবিষ্কার করেছিলেন। অর্থাৎ সেখানে রাসায়নিকভাবে দুই পরমাণু হাইড্রোজেন ও এক পরমাণু অক্সিজেন মিলিত হয়ে এক অণু পানি উৎপন্ন করে থাকে। পানির রাসায়নিক গুণাবলির মধ্যে রয়েছে, এর কোনো অম্লত্ব কিংবা ক্ষারকত্ব নেই। অর্থাৎ পানির পিএইচ মান হলো সাত (৭.০)।’
দৈনন্দিন জীবনে পানির নানাবিধ ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। এর মধ্যে পানীয় হিসেবে ব্যবহার, দৈনন্দিন রান্নায়, কাপড়-চোপড় ধোয়ায়, অন্যান্য বস্তু ধোয়ায়, সেচে, শিল্প কল-কারখানায়, ব্রয়লার ও মেশিন শীতলীকরণে, রাসায়নিক ও অন্যান্য পরীক্ষাগারে দ্রাবক হিসেবে, ফটোগ্রাফি ও ঔষধ প্রস্ততিতে, অগ্নিনির্বাপণে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে, মাছ চাষে, খনিজ পদার্থের পৃথকীকরণে, সাগর ও নদীতে পরিবহণ ইত্যাদি কাজে পানি ব্যবহৃত হয়। এতে সহজে অনুধাবন করা যায়, জীবনের একটি অতি জরুরি অনুষঙ্গ পানি।
এ গুরুত্বপূর্ণ উপাদটি প্রতিনিয়ত নানাভাবে দূষিত হচ্ছে। পানি জৈব ও অজৈব উভয়ভাবে দূষিত হয়ে থাকে। একদিকে যেমন মানুষ এবং প্রাণির বর্জ্য বস্তু, বর্জ্যবস্তুর রোগজীবাণু ইত্যাদির মাধ্যমে পানি দূষিত হচ্ছে, অপরদিকে গৃহস্থালি স্যুয়ারেজ, শিল্পবর্জ্য, পেপার ও পাল্প ফ্যাক্টরি, রাসায়নিক ফার্টিলাইজার, তেজস্ক্রিয় পদার্থ, তেল, তাপ, ডিটারজেন্ট ইত্যাদির মাধ্যমেও পানি দুষিত হচ্ছে অনবরত।
আধুনিক বিশ্বে যখন বিজ্ঞানের জয় জয়কার সেখানে প্রায় ১৫০ কোটিরও বেশি মানুষের জন্য নেই নিরপদ পানির ব্যবস্থা, আর প্রতি বছর শুধু পানি বাহিত রোগে ভুগে মারা যাচ্ছে প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ। জারে ভর্তি মিনারেল ওয়াটারের নামে খাওয়ানো হচ্ছে দূষিত পানি। রাজধানী ঢাকা ও তার আশে পাশে বৈধ ও অবৈধভাবে গড়ে ওঠা কারখানায়ই উৎপাদন হচ্ছে দূষিত খাবার পানি। দু-একটি বাদে অধিকাংশ মিনারেল ওয়াটারের কারখানা স্থাপন করা হয়েছে অপরিচ্ছন্ন স্থানে। ঢাকা শহরের পাশের বুড়িগঙ্গার দিকে তাকালে দেখা যাবে, সেটি এখন বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত নদীগুলোর মধ্যে একটি, যাকে একটি রাসায়নিক ময়লা পানির আদর্শ ভাণ্ডার বলা যায়। বুড়িগঙ্গার কালো ও বিষাক্ত জলে এখন শুধু কেমিক্যাল আর কেমিক্যাল।
শহুরে জীবনে পানি প্রতিদিন নানা কারণে অপচয় হয়। ১. কারণে অকারণে টয়লেটের ফ্লাশ ছেড়ে দিয়ে অনেকেই প্রচুর পানি অপচয় করে। ২. গোসল করার সময় প্রচুর পানি অপচয় হয়। ৩. শেইভ করার সময়, দাঁত ব্রাশ করার সময় বেসিনে কল খোলা রাখলে অপরিমাণ পনি অপচয় হয়। এ সময় ছোট মগে করে পরিমাণ মত পানি নিলে বা দরকার মতো বেসিনের কল ছোট করে ছাড়তে হবে। ৪. পানির কল শক্ত করে না লাগানোর ফলে কল থেকে ফোটা ফোঁটা পানি পড়তে থাকে। এই ফোঁটা ফোঁটা পানির হিসেব করলে দেখা যায় প্রতিদিন প্রায় ১৫ লিটার পানি অপচয় হয়। ৫. বাগানে হোসপাইপ দিয়ে পানি দেয়ার ক্ষেত্রে প্রতি ঘণ্টায় ১০০০ লিটার পর্যন্ত পানি খরচ হতে পারে। যদি বাগানে পর্যাপ্ত পরিমাণ জৈব সার দেয়া যায় এবং খুব সকালে এবং বিকেল বেলা পানি সেচ দেয়া যায় তাহলে পানি বাষ্পীভবন অনেকটাই কমে যায়। ফলে পানির প্রয়োজনীয়তা অনেকটাই কমে যায়। ৬. অনেক সময় দেখা যায় সূর্যের উত্তাপে পানির পাইপ উত্তপ্ত হয়ে যায়। ফলে অনেক সময় ধরে পানির কল চালু রাখা হয় ঠাণ্ডা পানি বের হওয়ার জন্য। ৭. পানির কল চালু করে অন্য কোন কাজে মনোনিবেশ করা যাবে না। ৮. অনেকেই তাড়াহুড়ো করে বাইরে বের হওয়ার সময় জল না থাকা কল ছেড়ে দিয়ে চলে যায়। এটা একটি ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। ৯. জলের প্রতি দরদ বা ভালোবাসা থাকতে হবে। ১০. পানির লাইনের ছিদ্রের করণে পানির অপচয় হয়।
বিশ্বকে বাস যোগ্য রাখতে ও প্রাণের অস্তিত্ব রক্ষায় নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে হবে। কাজেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো আমাদের দেশেও পানিকে সংশোধন করে তার ব্যবহার বৃদ্ধি করে এবং নদ-নদীকে দখল মুক্ত রেখে তাদের নাব্যতা ধরে রাখতে পারলে বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারা আরো সুসংহত হবে। সেই সাথে সুরক্ষিত হবে পরিবেশ, আমাদের সুন্দর পৃথিবী ফুলে-ফলে, সৌরভে, পাখির কলরবে ভরে ওঠবে, রক্ষা পাবে জলবায়ু পরিবর্তনের করাল থাবা থেকে। আগামীকে সুরক্ষিত করতে অবশ্য পানির অপচয় ও দূষণ রোধ করতে হবে।
লেখাটি ‘বিজ্ঞান মেলা-২০১৭’ এর ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল থিম ফিচার হিসেবে।
পতিতপাবন মণ্ডল (পাবন)
শিক্ষক, বাংলা বিভাগ
সেন্ট গ্রেগরী হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা।
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া; বাংলাপিডিয়া ও বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকা।
No comments
Thank you, best of luck