সৃজনশীল প্রশ্নের রীতি-প্রকরণ , সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরিতে করণীয় ও ‘আসমানি’ কবিতা থেকে একটি আদর্শ সৃজনশীল প্রশ্নের নমুনা প্রশ্ন-উত্তর:
সৃজনশীল প্রশ্নের রীতি-প্রকরণ ও ‘আসমানি’ কবিতা থেকে একটি সৃজনশীল প্রশ্নের নমুনা উত্তর:
সৃজনশীল প্রশ্নের রীতি-প্রকরণ , সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরিতে করণীয় ্ও
‘আসমানি’ কবিতা থেকে একটি আদর্শ সৃজনশীল প্রশ্নের নমুনা প্রশ্ন-উত্তর:
পতিতপাবন মণ্ডল (পাবন)
বাংলা বিভাগীয় প্রধান
সেন্ট গ্রেগরী হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা
সৃজনশীল প্রশ্নের রীতি-পদ্ধতি
ভূমিকা: কেবল শিক্ষাই পারে জাতিকে উন্নতির চরম শিখরে উন্নীত করতে। আর এর জন্য প্রয়োজন আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক যুগোপযোগী শিক্ষাপদ্ধতি। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি প্রচলন করেছে। যা শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বলে সুশীল সমাজ মনে করেন। ২০১০ সাল থেকে শুরু হওয়া এ পদ্ধতি সম্পর্কে বর্তমানে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সকলে কমবেশি অবগত। একটি সার্থক সৃজনশীল প্রশ্নই কেবল পারে উক্ত উদ্দেশ্যকে সফল করতে। এ জন্য এ পদ্ধতি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা আবশ্যক। এ পদ্ধতি কঠিন কিছু না, পাঠ্যের বিষয়বস্তু সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকলে একজন প্রশ্ন কর্তা যেমন সহজে প্রশ্ন করতে পারেন তেমনি অতি সহজেই একজন শিক্ষার্থী সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর প্রদান করতে পারবে।
সৃজনশীল (রচনামূলক) ও বহুনির্বাচনি উভয় ক্ষেত্রেই চিন্তন দক্ষতার চারটি স্তর-
১. জ্ঞান
২. অনুধাবন
৩. প্রয়োগ ও
৪. উচ্চতর দক্ষতাস্তরের প্রশ্ন থাকে।
সৃজনশীল প্রশ্ন কাকে বলে:
পাঠ্য বইয়ের জ্ঞানের আলোকে নির্মিত একটি মৌলিক উদ্দীপকের সাহায্যে শিক্ষার্থীর জ্ঞান, অনুধাবন, প্রয়োগ ও উচ্চতর দক্ষতা যাচাই করা যায় যে প্রশ্নে তাকে সৃজনশীল প্রশ্ন বলে।
১. জ্ঞানমূলক প্রশ্ন :
কোনো তথ্য বই থেকে মূখস্থ করে লিখতে পারা যায় যে প্রশ্নে, তাকে জ্ঞানমূলক প্রশ্ন বলে। যেমন- বৈদ্য শব্দের অর্থ কী? এ প্রশ্নের উত্তর সরাসরি বইয়ে থাকবে।
২. অনুধাবনমূলক প্রশ্ন:
অনুধাবন হলো কোনো বিষয়ের অর্থ বা তাৎপর্য বোঝার দক্ষতা। যে প্রশ্নে শিক্ষার্থী কোনো বিষয় অনুধাবন বা বুঝে নিজের ভাষায় উত্তর করে তাকে অনুধাবনমূলক প্রশ্ন বলে। এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর সরাসরি বইয়ে থাকে না। যেমন- ‘বৈদ্য ডেকে ওষুধ করে পয়সা নাহি তার’ বলতে লেখক কী বুঝিয়েছেন?
৩. প্রয়োগমূলক প্রশ্ন:
পাঠ্য বইয়ের জানা কোনো বিষয় বা তথ্য অনুধাবন করে নতুন পরিস্থিতিতে প্রয়োগ করা যায় যে প্রশ্নে, তাকে প্রয়োগমূলক প্রশ্ন বলে। এ প্রশ্নের উত্তর দিতে অবশ্যই শিক্ষার্থীকে উদ্দীপক ব্যবহার করতে হবে। উদ্দীপক ব্যবহার না করে এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া গেলে প্রশ্নটি ত্রুটিযুক্ত প্রশ্ন বলে বিবেচিত হবে। অর্থাৎ শিক্ষার্থীকে অবশ্যই উদ্দীপক ব্যবহার করে প্রশ্নের উত্তর করতে হবে।
৪. উচ্চতর দক্ষতামূলক প্রশ্ন:
যে প্রশ্নে শিক্ষার্থী পাঠ্য বইয়ের জানা কোনো বিষয় বা তথ্য অনুধাবন করে নতুন পরিস্থিতিতে প্রয়োগ করে তা বিশ্লেষণ, সংশ্লেষণ, মূল্যায়ন করে সিদ্ধান্তে উপনিত হতে পারে, তাকে উচ্চতর দক্ষতামূলক প্রশ্ন বলে। এ প্রশ্নের ঠিক উত্তর দিতে হলেও শিক্ষার্থীকে অবশ্যই উদ্দীপক ব্যবহার করতে হবে। উদ্দীপক ব্যবহার না করে এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া গেলে প্রশ্নটি ত্রুটিযুক্ত প্রশ্ন বলে বিবেচিত হবে।
সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়নের নিয়ম-কানুন।
এ পদ্ধতিতে প্রথমে একটি মৌলিক উদ্দীপক তৈরি করতে হবে। এ উদ্দীপকটি শিক্ষার্থীকে উত্তর প্রদানে সাহায্য করবে। অর্থাৎ উদ্দীপকটি শুধু শিক্ষার্থীকে ভাবতে সাহায্য করবে, তার মাঝে জাগাবে উদ্দীপনা। কোনো ভাবেই উদ্দীপকে কোনো উত্তর থাকবে না।
উদ্দীপক প্রণয়নে করণীয়:
১. পাঠ্য বইয়ের কোনো অংশ উদ্দীপক হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। তবে বইয়ের একাধিক অধ্যায় / বিষয় মিলিয়ে প্রশ্ন করা যেতে পারে। যেমন ‘দেনা-পাওনা’ গল্পের প্রশ্ন করতে হৈমন্তী বা ফুলের বিবাহ গল্পের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।
২. পাঠ্যের আলোকে পত্রিকা, সমালোচনা গ্রন্থ, ম্যাগাজিন, ডায়াগ্রাম, সারণী, ইত্যাদির সাহায্যে উদ্দীপক তৈরি করা যেতে পারে।
৩. উদ্দীপকের ভাষা সহজ-সরল, আকর্ষণীয়, সংক্ষিপ্ত অথচ তথ্যবহুল হবে।
৪. মানসম্মত উদ্দীপক তৈরি করতে হলে আগে জানতে হবে ঐ বিষয় বা অধ্যায়ের উদ্দেশ্য ও শিখনফল। তার পর ঐ বিষয় বা অধ্যায়ের বিভিন্ন দিক, ভাব (থিম) খুঁজে বের করে তার যেকোনো একটি বা একাধিক ভাবের আলোকে কাল্পনিক একটি মৌলিক উদ্দীপক তৈরি করতে হবে।
বহুনির্বাচনি প্রশ্ন:
বহুনির্বাচনি প্রশ্নের ভিত্তিতে কতগুলো বিকল্প উত্তর দেওয়া থাকে বিকল্পগুলোর মধ্যে একটি সঠিক উত্তর থাকে এবং বাকিগুলো বিক্ষেপক। এগুলো এমনভাবে প্রণয়ন করতে হবে যেন পরীক্ষার্থীদের (যাদের বিষয়বস্তু সম্পর্কে ধারণা নেই) সে সব বিক্ষেপকের দিকে ধাপিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
মানসম্মত বহুনির্বাচনি প্রশ্ন প্রণয়নের নিয়ম:
১. প্রয়োজনীয় তথ্য থাকবে
২. সহজ ভাষায় সংক্ষিপ্তাকার হবে
৩. অপ্রসঙ্গিক উপাদানমুক্ত
৪. হ্যাঁ বোধক হবে
৫. এমন কোনো ইঙ্গিত থাকবে না যাতে পরীক্ষার্থী ঠিক উত্তর সহজে বাচাই করতে পারে এবং বিক্ষেপক বাদ দিতে পারে। বিক্ষেপকগুলো যেমন হবে:
৬. বিষয়বস্তু ও ব্যাকরণগত গঠনের দিক থেকে প্রশ্নের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হবে
৮. প্রশ্নের অসম্পূর্ণ বাক্যকে সম্পূর্ণ করবে
৯. প্রতিটি বিক্ষেপক কমপক্ষে ৫% পরীক্ষার্থী কর্তৃক নির্বাচনের সম্ভাবনা থাকবে
১০. ক্রমানুযায়ী তালিকাভূক্ত হবে
১১. প্রতিটির দৈর্ঘ্য সমান হবে
১২. উপরের সবগুলো সঠিক / ‘কোনোটি নয়’ এমন কোনো বিক্ষেপক ব্যবহার করা যাবে না
১৩. প্রশ্নের ক্রমিক লেখার (১. ২. ---) সময় এবং ক. খ. গ. ঘ. লেখার সময় ডট(.) ব্যবহার করতে হবে।
১৪. মোট প্রশ্নের এক চতুর্থাংশ ক / খ / গ/ ঘ ঠিক উত্তর হবে।
উপসংহার:
সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি শিক্ষার্থীবান্ধব একটি পদ্ধতি যা শিক্ষার্থীকে আগামী দিনের জন্য চৌকোস পরিপূর্ণ মানুষ করতে বিশেষ সহায়ক, জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কঠিন কঠিন সিদ্ধান্তে উপনিত হওয়ার প্রয়োজন হয়, সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি সে কাজটি সুচারু রূপে করতে শিক্ষার্থীকে ধীরে ধীরে তৈরি করে তুলে। সৃজনশীল প্রশ্নের সাথে বিতর্কের বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায়, কারণ সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতিতেও বিতর্কের মতো তথ্য, তত্ত্ব, উপাত্ত দ্বারা যুক্তির মাধ্যমে বক্তব্য উপস্থাপন করে সিদ্ধান্তে উপনিত হতে হয়। পরিশেষে বলা যায় সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি শিক্ষার্থীকে যুক্তিবাদী, মমনশীল, সৃজনী শক্তির অধিকারী রূপে পড়ে তোলে।
নিচে ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ্যবই ‘চারুপাঠ’ থেকে ‘আসমানি’কবিতার একটি নমুনা সৃজনশীল প্রশ্ন ও তার উত্তর দেওয়া হলো:
১. উদ্দীপকটি পড়ে প্রশ্নেরগুলোর উত্তর দাও :
গ্রামের দরিদ্র কৃষক লালচাঁন মিয়া। বিঘা তিনেক জমি বর্গাচাষ করে। পরপর দুই বছর বন্যা ও খরায় সে জমিতে ফসল ফলেনি। পরিবারকে দুবেলা পেট ভরে খেতে দিতে পারে না। না খেতে পেয়ে সন্তানদের চোখ কোটরে ঢুকে গেছে, বুকের পাঁজর গোনা যায়। একটিমাত্র মাটির ঘর, তারও আবার ছাউনি নষ্ট হওয়ার উপক্রম। বৃষ্টি-বাদলার রাতে ঘরের কোণে বসে রাত কাটাতে হয়। লালচাঁন মিয়ার দুঃখের শেষ নেই।
ক.আসমানিদের গ্রামের নাম কী? ১
খ.‘মিষ্টি তাহার মুখটি হতে হাসির প্রদীপ রাশি, / থাপড়েতে নিবিয়ে গেছে দারুণ অভাব আসি’- এই চরণ দুটি দ্বারা কী বোঝানো হয়েছে? ২
গ.আসমানিদের ঘরের সঙ্গে লালচাঁন মিয়ার ঘরটির সাদৃশ্য ব্যাখ্যা করো। ৩
ঘ. ‘লালচাঁন মিয়া ‘আসমানি’ কবিতার আসমানিদের প্রতিনিধি।’ মন্তব্যটির সত্যতা নির্ণয় করো। ৩
১ নং প্রশ্নের (ক) এর উত্তর:
আসমানিদের গ্রামের নাম রসুলপুর।
২ নং প্রশ্নের (খ) এর উত্তর:
‘মিষ্টি তাহার মুখটি হতে হাসির প্রদীপ রাশি / থাপড়েতে নিবিয়ে গেছে দারুণ অভাব আসি’- এই চরণ দুটি দ্বারা দারিদ্র্যের নির্মম কশাঘাত আসমানিদের মতো মেয়ের মুখের হাসি কেড়ে নিয়েছে এ কথা বোঝানো হয়েছে।
জসীমউদ্দীন রচিত ‘আসমানি’ কবিতার আসমানি অভাব-অনটনের মধ্যে দিন কাটায়। সে যে পেট ভরে খেতে পায় না, তার হাড়-জিরজিরে শরীরে সেই চিহ্ন ফুটে উঠেছে। সংসারের অভাব-অনটন তার মিষ্টি মুখের হাসিটুকুও নিমেষেই কেড়ে নিয়েছে। ঘরে খাবার না তাকায় তার মনে কোনো সুখ নেই, হৃদয়ে আনন্দের লেশমাত্র নেই। তাই মুখে তার কখনো হাসি দেখা যায় না।
১ নং প্রশ্নের (গ) এর উত্তর:
আসমানিদের ঘরের সঙ্গে লালচাঁন মিয়ার ঘরটির সাদৃশ্য হলো- আসমানিদের মতো তার ঘরও নড়বড়ে জরাজীর্ণ যা যে কোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে।
‘আসমানি’ কবিতায় আসমানিরা রসুলপুরে থাকে। তাদের বাবার তৈরি ছোট্ট বাড়িটিকে বাড়ি না বলে পাখির বাসা বলাই যেন ভালো। সেই বাড়িটির ছাউনি দেওয়া হয়েছে ভেন্না গাছের পাতা দিয়ে। সামান্য একটু বৃষ্টি হলেই সেই ঘরে পানি গড়িয়ে পড়ে। আবার সামান্য বাতাস বইলেই তাদের থাকবার একমাত্র ঘরটি নড়বড় করে যেন তা যে কোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে। অথচ ওই ঘরেই সারাটি বছর তাদের বসবাস করতে হয়।
উদ্দীপকের লালচাঁন মিয়ার ঘরটিও আসমানিদের ঘরের মতো। তারও একটিমাত্র ঘর-যার ছাউনি প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে। বৃষ্টি-বাদলায় ঘরের কোণে বসে রাত কাটাতে হয়। আসমানি কবিতার আসমানিদের ঘর ও উদ্দীপকের লাল চাঁন মিয়ার ঘর নড়বড়ে ও জরাজীর্ণ। তাই বলা যায়, আসমানিদের মতো লালচাঁন মিয়ার ঘরও নড়বড়ে জরাজীর্ণ যা যে কোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে।
১ নং প্রশ্নের (ঘ) এর উত্তর: উত্তর: ‘লালচাঁন মিয়া ‘আসমানি’ কবিতার আসমানিদের প্রতিনিধি।’-মন্তব্যটি সত্য কারণ তিনিও আসমানিদের মতো দারিদ্র্যের কারণে নিদারুণ কষ্টে দিন যাপন করছেন।
উদ্দীপকের লালচাঁন মিয়াও আসমানিদের মতোই হত দরিদ্র। পরিবার-পরিজনকে দু-বেলা পেটপুরে খেতে দিতে পারে না। না খেতে পেরে সন্তানদের চোখ কোটরে ঢুকে গেছে, বুকের পাঁজর গোনা যায়, উদ্দীপকের লালচাঁন মিয়ার দারিদ্র্য পীড়িত জীবন আসমানিদের ন্যায় করুণ। আসমানিদের মতো অভাব, দারিদ্র্যই তার জীবনের নিত্য সঙ্গী। দুঃখ-কষ্ট তার জীবনের সকল সুখ কেড়ে নিয়েছে। ‘আসমানি’ কবিতায় আসমানিদের যে দারিদ্র্যক্লিষ্ট জীবনচিত্র ফুটে উঠেছে, তা উদ্দীপকের লালচাঁন মিয়ার জীবনচিত্রেও প্রতিফলিত হয়েছে।
সুতরাং উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে তাই বলা যায়, ‘লালচাঁন মিয়া ‘আসমানি’ কবিতার আসমানিদের প্রতিনিধি।’-মন্তব্যটি সত্য কারণ তিনিও আসমানিদের মতো দারিদ্র্যের কারণে নিদারুণ কষ্টে দিন যাপন করছেন।
No comments
Thank you, best of luck